ফিচার ডেস্ক:
মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য জরুরী। খাবার ছাড়া মানুষের পক্ষে বাঁচা অসম্ভব। খাদ্যের অভাবে মা’রা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। পথে-প্রান্তরে পড়ে আছে হাজারো ডেডবডি, এগুলো দু’র্ভিক্ষপী’ড়িত একটি দেশের নি’র্মম বাস্তবতার করুণ চিত্র। কালে কালে এমন কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে পৃথিবীর অনেক দেশকে।
আফ্রিকা থেকে আমেরিকা, ইউরোপ থেকে এশিয়া, চীন-রাশিয়া কিংবা এই বাংলাতেও দু’র্ভিক্ষের করা’লগ্রাসে মা’রা গেছে অনেক মানুষ। বাস্তবতা হলো হাইব্রিড, উচ্চফলন কোনো কিছুই তীব্র খাদ্য সং’কটে মানুষের মৃ’ত্যু এড়িয়ে যেতে পারে না।
কিন্তু যদি বলা হয় ভাত কিংবা রুটি নয়, শুধু আলু না খেয়ে মা’রা গেছে লাখ লাখ মানুষ। অনেকের কাছে অ’বিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কারণ খাদ্য হিসেবে আলু আমাদের দেশে ভাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু আমার আপনার কাছে অ’কল্পনীয় মনে হলেও পৃথিবীর এমনও দেশ আছে যেখানে আলু প্রধান খাদ্য। আয়ারল্যান্ড তেমনই একটি দেশ। বাঙালির পাতে যেমন দু’বেলা ভাত না পড়লে তারা হাঁসফাঁ’স করে, আলুর বেলায় আইরিশরাও তেমন। ইতিহাসে এই দু’র্ভিক্ষ ‘দ্য গ্রেট ফ্যামিন অব আয়ারল্যান্ড’ নামে পরিচিত।
দু’র্ভিক্ষের শুরু ১৮৪৫ সালে। শেষ হয় ১৮৫২ সালে। মোট ৭ বছরব্যাপী এই দু’র্ভিক্ষে মৃ’ত্যুবরণ করে প্রায় ১০ লাখ আইরিশ। ক্ষুধার য’ন্ত্রণা সইতে না পেরে দেশান্তরি হয় আরও ১০ লাখ। অথচ প’রিতাপের বিষয় দু’র্ভিক্ষ শুরুর মাত্র ১ শতাব্দী আগেও আলু আইরিশদের প্রধান খাদ্য ছিল না। দেশটিতে আলু চাষের গোড়াপ’ত্তন ব্রিটিশদের হাতে। তখন আয়ারল্যান্ড ছিল ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে। ১৮০১ সালে আয়ারল্যান্ড ব্রিটেনের সঙ্গে একীভূত হয়। এরপর থেকেই আইরিশদের দু’র্ভাগ্যের শুরু। তখন আয়ারল্যান্ডের যাবতীয় রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনায় থাকতো ব্রিটেনের লেফটেন্যান্ট ও চিফ সেক্রেটারি অব স্টেট। আয়ারল্যান্ড থেকে মাত্র ১০৫ জন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নিন্মকক্ষ হাউজ অব কমন্স এবং ২৮ জন উচ্চ কক্ষ হাউজ অব লর্ডসে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেত। তবে এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও কোন না কোনভাবে ব্রিটিশ জমিদার বা তাদের পরিবারের সদস্য ছিল। অর্থাৎ আইরিশরা ছিল একেবারেই ক্ষমতাশূন্য।।
উপরন্তু আইরিশদের কাছে ম’রার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে ‘পেনাল লজ’ নামক এক হাস্যকর আইন। এই আইনের দ্বারা ক্যাথলিক আইরিশদের জমির মালিকানা, সম্পত্তি ও ভোটের অধিকার রদ করা হয়। যদিও চাপের মুখে ১৯২৯ সালে এই আইন বাতিল করা হয়। তবে সিংহভাগ জমির মালিকানা আগের মতো ব্রিটিশদের হাতেই থেকে যায়। আইরিশরা পরিণত হয় ভূমিদাসে।
যেহেতু অধিকাংশ জমির মালিক ছিল ব্রিটিশ, তাই তারা আইরিশদের জোর করে অন্য ফসল চাষ করা বাদ দিয়ে আলু চাষে বাধ্য করে। অনেকটা ভারতবর্ষে নীল চাষের মতো। ব্রিটিশদের এই অ’ন্যায় আবদার মেনে নিতে বাধ্য হয় আইরিশরা।
প্রচুর আলু চাষের ফলে অন্য ফসল চাষ যেমন উঠে গেল, তেমনি পরবর্তীকালে আইরিশদের খাদ্যাভাসও বদলে গেল। তারা আলুর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। তারপরও সবকিছু মেনে নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই চলার চেষ্টা করছিল আইরিশরা। কিন্তু তাদের এই স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় বাগ’ড়া দিল প্রকৃতি।।
১৮৪৫ সালে ফাইটোপাথরিয়া ইনফেসট্যান্স নামক এক ধরনের ফাঙ্গাস ছড়িয়ে পড়ল আলুক্ষেতে। এই ছত্রাকের প্রভাবে ধ্বং’স হয়ে গেল দেশটির প্রায় অর্ধেক জমি। তারা অনেক চেষ্টা করল ছত্রাকের আক্র’মণ ঠেকাতে। কিন্তু সব চেষ্টাই বি’ফল হয়। মাঠের পর মাঠ আলুক্ষেত উজাড় হতে শুরু করে। দেশজুড়ে আলুর তীব্র সং’কট শুরু হয়।।
হঠাৎ বিপ’ত্তিতে অ’সহায় হয়ে পড়ে আইরিশরা। বিশেষ করে গ্রামের লোকেরা যারা নির্ভরশীল ছিল আলুর ওপর। দিনে দিনে পরিস্থিতি এতটাই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় যে, পরবর্তী ৭ বছরের মধ্যে আইরিশদের দুই-তৃতীয়াংশ আলুর জমি বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়। ফলাফল খাদ্যাভাবে দেখা দেয় দু’র্ভিক্ষ। এই ভ’য়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে গোদের ওপর বিষফোঁ’ড়ার মতো হয়ে আসে ব্রিটিশদের হাস্যকর এক ফসল নীতি। এই নীতির আলোকে তখনকার আয়ারল্যান্ডে উৎপাদিত শস্য এবং গবাদি পশু ব্রিটেনে রপ্তানী করা হতো। আলু সং’কটের সময় ব্রিটেনে খাদ্য রপ্তানী পরিস্থিতিকে আরও ভ’য়াবহ করে তোলে।।
আইরিশরা বরাবরই এই দু’র্ভিক্ষের জন্য ব্রিটিশদের দায়ী করে। আর ব্রিটিশ রাজারা আলুর রোগের দোহাই দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ব্রিটিশ রাজনীতিকরা এই দু’র্ভিক্ষের জন্য তৎকালীন শাসকদের একপেশে নীতিকেই দায়ী করেছেন। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এই দু’র্ভিক্ষের জন্য আইরিশদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন।
ইতিহাসখ্যাত এই দু’র্ভিক্ষের জন্য পৃথিবীর মানুষের সমবেদনা পেয়েছে আইরিশরা। যুক্তরাষ্ট্র, স্কটল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর বহু দেশে পটেটো ফেমিন বা আলু দু’র্ভিক্ষে মৃ’ত মানুষদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে স্মৃ’তিস্তম্ভ।