আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
গোটা দুনিয়ায় এখন আলোচিত নাম কাসেম সোলেইমানি। ইরাকে মার্কিন বাহিনীর হাম’লায় ইরানের এই মেজর জেনারেল নিহ’ত হওয়ার পর ঝাঁকুনি খেয়েছে বৈশ্বিক তেলের বাজার।
শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ভোরে জেনারেল সোলেইমানি নিহ’ত হওয়ার কয়েকঘণ্টার মধ্যে তেলের দাম বেড়ে যায় ৪ শতাংশ। ইরানি জনগণের পাশাপাশি এই ঘটনার পরিণতি নিয়ে শ’ঙ্কিত পুরো বিশ্বমিডিয়া।
কে ছিলেন জেনারেল সোলেইমানি? কেন তাকে হ’ত্যার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও পর্যন্ত সবাই উচ্ছ্বাসের টুইট করছেন? কেন দফায় দফায় বিবৃতি দিচ্ছে মার্কিন সরকার। এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। এতে কাসেম সোলেইমানির একজন ‘নিভৃতচারী’ অথচ ‘সবচেয়ে ক্ষমতাধর’ জেনারেল হয়ে ওঠার ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়েছে।
কাসেম সোলেইমানির পরিচয়
ইরানের বিপ্লবী গার্ডের (আইআরজিসি) অভিজাত শাখা কুদস্ বাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল সোলেইমানি। আনকনভেনশনাল যু’দ্ধের জন্য তৈরি কুদস্ বাহিনীকে বৃহৎ স্পেশাল অপারেশন ইউনিট বলা যায়। শ’ত্রুর চোখে চোখ রেখে চলা নীতিতে বিশ্বাসী জেনারেল সোলেইমানি কুদস্ বাহিনীর প্রধান কর্মক্ষেত্র ইরানের বাইরে নিয়ে গিয়ে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে তেহরানের যে সামরিক প্রভাব তৈরি করেছেন, তা তাকে দেশে এবং বিদেশে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বর মর্যাদায় আসীন করেছে।
ইরানে বিপ্লবের পর যুগ-যুগ ধরে দেশটির ওপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষে’ধাজ্ঞা থাকলেও তেহরান দিনে দিনে মধ্যপ্রাচ্যে যে উত্থানের গল্প লিখেছে, তাতে বড় অবদান এই সোলেইমানির। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, সামরিক ভারসাম্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া এনে ইরানের অর্থনীতিকে পত’নের কিনার থেকে রক্ষা করেছেন তিনিই।
এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইসরায়েল সোলেইমানির তৎপরতা অনুমান করতে পারলেও তাকে থামাতে পারছিল না। যদিও গত ২০ বছরে সৌদি, ইসরায়েল ও পশ্চিমা কিছু দেশের বিভিন্ন সংস্থা সোলেইমানিকে গুপ্তহ’ত্যার চেষ্টা চালায় বহুবার। কিন্তু শুক্রবারের আগে সববারেই তারা ব্যর্থ হয়।
যেভাবে সবচেয়ে পরা’ক্রমশালী জেনারেল হলেন
সোলেইমানির উঠে আসা ইরানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কেরমান প্রদেশের একটি দরিদ্র পরিবার থেকে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে পরিবারের সচ্ছ্বলতার জন্য কাজ শুরু করেন তিনি। অবসরে ভারোত্তোলন চর্চার পাশাপাশি তৎকালীন খামেনীর অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থিত হতেন সোলেইমানি।
১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের সময় তরুণ সোলেইমানি প্রথম সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। মাত্র ৬ সপ্তাহ সামরিক প্রশিক্ষণ শেষ না করতেই ইরানের পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশে প্রথম যু’দ্ধক্ষেত্রে নামতে হয় তাকে।
ইরান-ইরাক যু’দ্ধের (১৯৮০-১৯৮৮) সময় সীমান্তে বীরোচিত ভূমিকার জন্য ‘জাতীয় বীর’ বনে যান সোলেইমানি। এরপর সামরিক বাহিনীতে তিনি হয়ে ওঠেন অন্যতম আস্থাভাজন জেনারেল।
এই আস্থাভাজন জেনারেলের হাতে ১৯৯৮ সালে তুলে দেয়া হয় বিপ্লবী গার্ডের প্রধানের দায়িত্ব। তারপর অনেকটা নিভৃতে তিনি কাজ করতে থাকেন। তার কৌশলের কারণে লেবাননের হিজবুল্লাহ, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের অনুগত বাহিনী এবং ইরাকের শিয়াপন্থি সশ’স্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোরদার সম্পর্ক গড়ে ওঠে ইরানের।
সোলেইমানির কুদস্ বাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে ইরান সীমানার বাইরে কর্মক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সফলতার পরিচয় দিয়েছে সিরিয়া এবং ইরাকে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ যখন গৃহযু’দ্ধের কারণে পত’নের দ্বারপ্রান্তে, তখন সোলেইমানির নেতৃত্বে তার বাহিনী যু’দ্ধক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নেয়, এই ভূমিকার কাছে হেরে যায় আসাদবিরোদী সুন্নি সশ’স্ত্র গোষ্ঠীগুলো। এছাড়া ইরাকে এবং সিরিয়ার বিশাল অংশে জ’ঙ্গি গোষ্ঠী আইএস দম’নে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার পাশাপাশি সোলেইমানির বাহিনীও রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
দীর্ঘদিন নিভৃতে কাজ করলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী ও অন্য শিয়া নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে দেখা যেতে থাকে। গত বছরের মার্চে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী জেনারেল সোলেইমানিকে অর্ডার অব জুলফিকার পদক দেন। বিপ্লব-পরবর্তী ইরানে এ পদক সোলেইমানিই প্রথম পান। এ অনুষ্ঠানের প্রচারিত ছবিতে দেখা যায়, সোলেইমানির ঘাড়ে চুম্বন করছেন খামেনী। শিয়া সংস্কৃতিতে এমন চুম্বনের তাৎপর্য ব্যাপক।
জানা যায়, সোলেইমানি তার কুদস্ বাহিনীর কার্যক্রমের বিষয়ে জবাবদিহি করতেন কেবল আয়াতুল্লাহ আলী খামেনীর কাছে। সেজন্য খোদ ওই বাহিনীর সদস্যরাই তাদের সামর্থের ব্যাপারে পুরোপুরি স্পষ্ট ছিলেন না।
সিরিয়া-ইরাকে ইরানের উপস্থিতি
সাদ্দাম হোসেনের পত’নের পর পশ্চিমাদের তদারকিতে ইরাকে সরকার গঠিত হলে সে সময় ওই দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতা বাড়াতে তৎপর হন সোলেইমানি। ইরাকের দুই প্রধানমন্ত্রী ইব্রাহিম আল-জাফরী ও নুরী আল-মালিকীর সময়ে তিনি এই তৎপরতা বেশি বাড়ান। ওই সময় ইরাকে ইরানের পুরোনো ছদ্মবেশী শক্তি বলে পরিচিতি বদর অর্গানাইজেশনের রাজনৈতিক শাখা থেকে স্বরাষ্ট্র ও পরিবহনমন্ত্রী দায়িত্ব পেলে সোলেইমানির কীর্তি নজর কাড়ে তেহরানের।
অন্যদিকে ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযু’দ্ধ শুরু হলে সোলেইমানি তার ছত্রছায়ায় থাকা ইরাকের সশ’স্ত্র গোষ্ঠীগুলোর একটি অংশকে বাশারের পক্ষে লড়া’ইয়ের জন্য পাঠান। সেক্ষেত্রেও সফলতা এখন সবার সামনে। শিয়াপন্থি বাশার টিকে গেছেন আরব বসন্তের ঝড়েও।
এছাড়া আইএসের বিরু’দ্ধে ইরাকের সামরিক বাহিনীর যু’দ্ধের সময় তাদের সঙ্গে সশ’স্ত্র গোষ্ঠী হাশদ আল-শাবিও লড়ে সোলেইমানির নির্দেশনায়।
এই দুই যু’দ্ধক্ষেত্রে জেনারেল সোলেইমানির ভূমিকা তাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায় ইরানিদের কাছে। যেমন- ইউনিভার্সিটি অব তেহরানের আমেরিকান স্টাডিজ বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ মারান্দি বলছিলেন, আইএসকে পরা’ভূত করতে ভূমিকার জন্য ইরানি জনগণ ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যদেশগুলোর নাগরিকদের কাছে তিনি জাতীয় বীর বনে গেছেন। তার মতো একজন দায়িত্ব না নিলে এই অঞ্চলে হয়তো কালো পতাকা (আইএসের) উড়ত।
‘টার্গেট’ সোলেইমানি
সেনাবাহিনীতে যখন থেকে সোলেইমানির প্রভাব চোখে পড়তে থাকে, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরবের টার্গেট-এ পরিণত হন তিনি। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি মনে করে, লেবাননের হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের হামাস, পাকিস্থান ও আফগানিস্তানের ফাতেমিয়ুন ও জাইনাবিয়ুন এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের পেছনে বড় শক্তি ইরান।
আর ইরানকে এই ভূমিকায় এনেছেন সোলেইমানি। অর্থাৎ সোলেইমানির কারণেই সীমানার বাইরে সামরিক প্রভাব বেড়েছে ইরানের। এই প্রভাব ইসরায়েলের সীমান্তঘেঁষা দেশগুলোতে বেশি হওয়ায় সোলেইমানিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথা ছিল তেল আবিবের। তারা মনে করতো, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সোলেইমানি ইরান-ইসরায়েলের ভৌগোলিক দূরত্ব ঘুচিয়ে ‘কৌশলগত’ দিক থেকে কাছাকাছি করে ফেলেছেন।
আর ইরানকে এভাবে শ’ত্রুর চোখে চোখ রেখে ল’ড়াইর সাহসী ভূমিকায় নিয়ে যাওয়ায় গত ২০ বছরে বহুবার হ’ত্যাচেষ্টার শি’কার হয়েছেন সোলেইমানি। কখনো ইরানের ভেতরের শক্তির সহায়তায়, কখনো ভাড়াটে খু’নির সহায়তায় এ চেষ্টা চালিয়েছে শ’ত্রুপক্ষ।
এক্ষেত্রে সোলেইমানি নিহ’ত হয়েছেন বলেও গুজব ছড়ায় কয়েকবার। ২০০৬ সালে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একটি বিমান বিধ্ব’স্ত হয়ে কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার পাশাপাশি তিনিও মা’রা যান বলে খবর ছড়ায়। এরপর ২০১২ সালে বাশার আল-আসাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর বো’মা হাম’লায় সোলেইমানিও নিহ’ত হন বলে দাবি করা হয়। ২০১৫ সালে আলেপ্পোয় বাশার আল-আসাদ বাহিনীর হয়ে যু’দ্ধের সময় সোলেইমানি নিহ’ত বা গুরুতর আহত হন বলেও খবর ছড়ায়। প্রতিবারই তেহরান জানিয়ে দেয়, এই জেনারেল বেঁচে আছেন।
গত বছরের আগস্টে সিরিয়ায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের কথিত ঘাঁটির ওপর দফায় দফায় বিমান হাম’লা চালায় ইসরায়েল। সে সময় তারা দাবি করে, ইরানের ওই বাহিনী ইসরায়েলে খু’নে ড্রোন হাম’লা চালানোর ছক কষছিল। হাম’লার পর ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েল কাৎস সরাসরিই বলে দেন, সোলেইমানিকে নি’র্মূল করতে কাজ করছে ইসরায়েল।
সবশেষ গত অক্টোবরে তেহরান জানায়, সোলেইমানিকে হ’ত্যা করতে সৌদি ও ইসরায়েলের একটি যৌথ চক্রা’ন্ত ন’স্যাৎ করে দিয়েছে তারা। কিন্তু শেষতক সোলেইমানিকে প্রাণ দিতেই হলো।
তবে অন্যতম আস্থাভাজন জেনারেলের শাহাদাতে শোকাহত ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী হুং’কার দিয়ে বলেছেন, অপরাধীদের বড় মাশুল দিতে হবে।