বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি ডেস্ক:
নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন পুরো পৃথিবীকে আলোড়িত করে সত্তরের দশকে চাঁদে প্রথম পা রাখেন। ১৯৬৯ সালে সেই চন্দ্র অভিযান পুরো পৃথিবীকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। যার নেপথ্যে কাজ করেছিলেন একজন বাংলাদেশি। তার নাম রফিক উদ্দিন আহমেদ। বাড়ি সিলেটের গঙ্গানগর গ্রামে।
এই মানুষটি পাখি মিয়া নামেই বেশি পরিচিত। রফিক উদ্দিন আহমেদ পেশায় ছিলেন তড়িৎ প্রকৌশলী। মহাকাশচারীদের অ্যাপোলো ১১ নভোযান থেকে চাঁদে নিয়ে যায় যে লুনার মডিউল, সেটার নকশা প্রণয়ন ও কারিগরি কাজে যুক্ত ছিলেন রফিক উদ্দিন আহমেদ।
রফিক উদ্দিন আহমেদ তখন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রুম্মান অ্যারোস্পেস কর্পোরেশনের তরুণ কর্মী। সামরিক ও বেসামরিক বিমান তৈরি করত এই প্রতিষ্ঠান। তিনি তখন এফ-১৪ ফাইটার জেট তৈরির একটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত।
তিনি বলেন, এই প্রকল্প চলার সময়ই আমাকে এবং সহকর্মী আরও কয়েকজন প্রকৌশলীকে অ্যাপোলো-১১ প্রকল্পের জন্য নির্বাচন করা হয়। নাসার কাজের ধরনটাই এমন, তারা মূল প্রকল্পকে ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে আলাদাভাবে কাজ করায়। আমাদের প্রতিষ্ঠান পেল লুনার মডিউল প্রকল্পের কাজ।
লুনার মডিউলের কাজ ছিল মহাকাশচারীদের অ্যাপোলো ১১ থেকে চাঁদে নিয়ে যাওয়া। চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করানো এবং সেখানে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ শেষ হলে আবার তাদেরকে মহাকাশযানে ফিরিয়ে আনা।
রফিক উদ্দিন আহমেদ ও তার দলের কাজ ছিল লুনার মডিউলের নকশা তৈরি ও কারিগরি দিকগুলো দেখা। একজন তড়িৎ প্রকৌশলী হলেও তিনি মহাকাশবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠান থেকেও পেয়েছেন প্রশিক্ষণ। তাই কাজটি তাকে যেমন রোমাঞ্চিত করেছিল, তেমনি নতুন অভিজ্ঞতারও স্বাদ দিয়েছিল।
একসময় লুনার মডিউল তৈরি হয়ে গেল। চন্দ্রাভিযানের নভোচারীদের এই যন্ত্র ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়ার দায়িত্ব পড়ল রফিক উদ্দিন আহমেদ ও তার দলের ওপর। লুনার মডিউল কীভাবে কাজ করে, কীভাবে এটিকে নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে হয়, সেসব বিষয় শিখিয়ে দেওয়াই ছিল প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য। দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজ করায় মহাকাশচারীদের সঙ্গে রফিক উদ্দিন আহমদের গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল।
শেষমেশ ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই চাঁদের উদ্দেশে পৃথিবী ছাড়ে অ্যাপোলো ১১, চন্দ্র অভিযানের অধিনায়ক ছিলেন নভোচারী নিল আর্মস্ট্রং, লুনার মডিউলের পাইলট ছিলেন বাজ অলড্রিন। চাঁদের অভিযাত্রীরা পৃথিবীতে সফলভাবে অবতরণের মধ্য দিয়ে কাজ সমাপ্ত হয় তার। আর তারই মাধ্যমে রচিত হলো নতুন ইতিহাস। সে ইতিহাসের সঙ্গে গোপনেই জড়িয়ে রইলেন বাংলাদেশের প্রকৌশলী রফিক উদ্দিন আহমেদ।
এই মানুষটির জন্ম সিলেটের গঙ্গানগর গ্রামে ১৯৩৬ সালের ২০ আগস্ট। বাবা ইদ্রিস আলী ছিলেন অবস্থাসম্পন্ন মানুষ। ৪ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে রফিক ৩য়। গঙ্গানগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এরপর ভর্তি হন সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক এবং সিলেট এমসি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।
স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে ১৯৫৪ সালে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ইন্ডিয়ানা টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন তড়িৎ প্রকৌশলে। পড়াশোনা শেষে তড়িৎ প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি নেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন সামরিক ও বেসামরিক বিমান তৈরির প্রতিষ্ঠান গ্রুম্মান অ্যারোস্পেস কর্পোরেশনে। মুক্তিযু’দ্ধের সময় প্রবাসে থেকে দেশের জন্য কাজ করেছেন। বহির্বিশ্বে জনমত গঠনের কাজ করেছেন। জাতিসংঘের সামনে মানববন্ধন করেছেন বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, রফিক উদ্দিন আহমেদের খালাতো ভাই ছিলেন মুক্তিযু’দ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী।
লুনার মডিউল নিয়ে একটু বিস্তারিত জানা যাক:
লুনার মডিউলের কাজ কোনো রকম সমস্যা ছাড়াই সফলভাবে সম্পন্ন হয়। পরবর্তী সময়ে চাঁদের অভিযানটাই সফলভাবে সমাপ্ত হয়। লুনার মডিউল সব মিলিয়ে ১৫টি তৈরি করা হয়, যার মধ্যে ১০টি ব্যবহার করা হয়। ১২ জন মহাকাশচারী এগুলোতে করে চাঁদে ঘুরে আসেন।
রফিক উদ্দিন আহমেদ বলছিলেন, লুনার মডিউলের নাম রাখা হয়েছিল ঈগল। লুনার মডিউলটি চাঁদের কক্ষপথে পৌছার পর কমান্ড বা সার্ভিস মডিউল থেকে আলাদা হয়ে চাঁদে অবতরণ করে। লুনার মডিউল প্রধানত ২টি অংশে বিভক্ত- অবতরণ অংশ ও আরোহণ অংশ। অবতরণ অংশ কমান্ড বা সার্ভিস মডিউল থেকে আলাদা হওয়ার পর চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণ করে একটি পূর্ণ মহাকাশযান হিসেবে। কিন্তু নভোচারীরা চাঁদ থেকে ফেরত আসার সময় শুধুমাত্র লুনার মডিউলের উপরের অংশ রকেটের সাহায্যে চাঁদের ভূমি থেকে ফিরে এসে মূল মহাকাশযানের সাথে সংযুক্ত হয়। এই অংশকে আরোহণ অংশ বলা হয়ে থাকে। লুনার মডিউলের অবতরণ অংশ চাঁদের মাটিতে রয়ে যায়। আরোহণ অংশ মূল মহাকাশযানের সাথে সংযুক্ত হওয়ার পর, নভোচারীরা কমান্ড বা সার্ভিস মডিউলে চলে আসেন। আরোহণ অংশ তারপর মূল মহাকাশযান থেকে আলাদা হয়ে চাঁদের কক্ষপথে রয়ে যায়।
ধারণা করা হয়, পরবর্তী ১ থেকে ৪ মাসের মধ্যে সেটি চাঁদের মাটিতে আছড়ে পরে, যদিও নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়।
চাঁদে প্রথম পা রাখলেন নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অলড্রিন। অ্যাপোলো ১১-এর কমান্ডারের পুরো নাম- নিল এ্যাল্ডেন আর্মস্ট্রং। লুনার মডিউলের পাইলটের পুরো নাম- এডউইন ইউজিন বাজ অলড্রিন জুনিয়র। ১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই চাঁদের উদ্দেশ্যে পৃথিবী ছাড়ে এ্যাপলো ১১।
১৯৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর শেষবারের মতো লুনার মডিউলটি ব্যবহার করা হয়। অ্যাপলো ১১ প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পর নাসা আরেকটি অভিযান পরিচালনা করে চাঁদে। অ্যাডভান্স রিসার্চের জন্য ‘কমান্ড মডিউল’ নামে আরেকটি মডিউল তৈরি করা হয়।
কিন্তু অভিযান চলাকালে সেটিতে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। তখন ব্যাকআপ হিসেবে নিয়ে যাওয়া রফিক উদ্দিন এবং তার দলের সদস্যদের তৈরী লুনার মডিউল ব্যবহার করে অভিযাত্রীদের নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা হয়। এই ব্যাকআপটি না থাকলে কাউকেই হয়ত ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতো না মহাশুন্য থেকে।
আমরা এই গল্পগুলো জানিনা। জানার চেষ্টাও হয়তো করিনা। নতুন নতুন ইস্যুর আড়ালে হারিয়ে যায় বাঙ্গালির বিশ্বজয় থেকে চন্দ্রজয়ের গর্বের ইতিহাস।
তথ্য: প্রথম আলো, ব্লগ ও বিদেশি জার্নাল