আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
বাড়িতে আগুন লেগেছে। দূর থেকে মা সেটি দেখতে পেয়ে ঘরে থাকা ২ সন্তানকে দ্রুত আগুন থেকে উদ্ধার করেন তিনি। তবে ওই সময় ঘরের দেয়ালে টাঙানো রাষ্ট্রনেতাদের ছবি বাঁচাতে ভুলে গেলেন। এতেই অপমান করা হয়েছে রাষ্ট্রনেতাদের। এরপর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ওই মাকে।
ঘটনাটি ঘটেছে অবাক নিয়ম-কানুনের দেশ উত্তর কোরিয়াতে।
দেশটির আইনে কোনো ক্ষয়ক্ষ’তির হাত থেকে সাবেক রাষ্ট্রনেতা কিম ইল-সাং এবং কিম জং-ইলের ছবি বাঁচানো জাতীয় কর্তব্য। রাষ্ট্রনেতাদের ছবি বাঁচাতে গিয়ে কেউ যদি জীবন খোয়ান, তবে দেশবাসীর চোখে তিনিই ‘হিরো’।
ঘটনাটি চীন সীমান্ত সংলগ্ন নর্থ হ্যামগঙ্গ প্রদেশের। সেখানের অনসং কাউন্টির বাড়িটিতে ২টি পরিবারের বাস। দুই পরিবারের মা-বাবাই কাজে বাইরে গিয়েছিলেন। দু’টি বাচ্চা ছিল বাড়িতে। বাড়ি থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখে দৌড়ে আসেন বাবা-মা। বাচ্চা দু’টোকে উদ্ধার করা গেলেও বাঁচানো যায়নি উত্তর কোরিয়ার সাবেক রাষ্ট্রনেতাদের ছবি দু’টি।
খবর পেয়েই তদন্ত শুরু করে নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রণালয়। গ্রেপ্তার হন ২ মা। দোষী সাব্যস্ত হলে দীর্ঘ কারাবা’স করতে হবে তাদের। দক্ষিণ কোরিয়া ভিত্তিক উত্তর কোরিয়া সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যম ডেইলি এনকে এ খবর দিয়েছে।
উত্তর কোরিয়ার নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি বাড়িতে সাবেক রাষ্ট্রনেতা কিম ইল-সাং এবং কিম জং-ইলের ছবি রাখা বাধ্যতামূলক। সকলে সেই নিয়ম পালন করছে কি না, দেখতে বাড়ি বাড়ি চলে সরকারি পরিদর্শন। শুধু বাড়িতেই নয়, দেশের সবক’টি স্কুল, রেলস্টেশন, সাবওয়ে ট্রেনে সাবেক রাষ্ট্রনেতাদের ছবি রাখা বাধ্যতামূলক এবং তা যথেষ্ট সম্মান ও যত্ন সহকারে।
কিম জং-উনের ছবি অবশ্য এই তালিকায় যুক্ত হয়নি। ক্ষমতায় আসার ৭ বছর পর, ২০১৮ সালে তার প্রথম অফিসিয়াল পোট্রেট সামনে আসে। কিন্তু তা এখনও পাবলিক প্লেসে রাখা বাধ্যতামূলক হয়নি। তবে, শুধু ছবি বা পোট্রেট রেখেই দায়িত্ব শেষ নয়। প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতাদের ছবির কোনও রকম অব’মাননা গুরুতর অপরাধ বলে গণ্য হবে, সেই অনুযায়ীই হবে শা’স্তি।
ঘটনার পর পরই গ্রেপ্তার হওয়ায় আহত সন্তানদের হাসপাতালেও নিয়ে যেতে পারেননি ২ মা, দিতে পারেননি ও’ষুধও। প্রতিবেশীরা সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু নিজেদের বিপদ আঁচ করে নিরস্ত থেকেছেন। তদন্ত শেষ হলে তবেই বাচ্চাদের চিকিৎসা করানোর অনুমতি পাবেন ২ মা।
উত্তর কোরিয়ার এই ‘একুশে আইনে’র কথা প্রকাশ্যে আসে ২০১৫ সালে। সে সময় উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা জুন ইয়ো-সাং এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একটা বাড়িতে আগুন লাগার পর বেশ কয়েকটি বাচ্চার দেহ উদ্ধার হয়েছিল। প্রত্যেকে রাষ্ট্রনেতাদের ছবি আঁকড়ে ধরেছিল। অর্থাৎ, নিজেদের জীবন নয়, ছবি বাঁচানোই মূল লক্ষ্য।
২০১২ সালে সিনহাং কাউন্টিতে জলোচ্ছ্বাস হয়। তখন কিমের ছবি বাঁচাতে গিয়ে ডুবে মা’রা যায় ১৪ বছরের এক কিশোর। মৃ’ত্যুর পর তাকে ‘কিম জং-ইল ইয়ুথ অনার’ এ সম্মানিত করা হয়। তার নামে নামাঙ্কিত করা হয় তার স্কুলটিকে। অনসং কাউন্টির এক যুবক কিমের ছবি বাঁচিয়ে এমন সম্মান পেয়েছিলেন, যে অপরাধে জেল খাটা সত্ত্বেও তিনি এলাকার সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি বলে গণ্য!
মার্কিন শিক্ষার্থী ওত্তো ওয়ার্মবিয়ার একবার কিম ইল-সাংয়ের নাম লেখা পোস্টার ছিঁড়ে ফেলেছিলেন বলে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদ’ণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। মার্কিন পর্যটক রে কানিংহাম ৬ বার উত্তর কোরিয়া গিয়েছেন। তার কথায়, ওদের কাছে দেশাত্মবোধ আর কিমের পরিবারের প্রতি আনুগত্য সমার্থক। আমাদের কাছে এটা পাগলামো ছাড়া আর কিছুই নয়।
বাড়িতে উত্তর কোরিয়ায় সাবেক রাষ্ট্রনেতাদের ছবি রাখার নিয়ম-
# লিভিংরুমের চোখে পড়ার মতো জায়গায় ঝোলাতে হবে ছবিগুলো
# পরিবারের সবচেয়ে লম্বা সদস্যের মাথার চেয়ে বেশি উচ্চতায় ছবি টাঙাতে হবে। যাতে আর কেউ প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতাদের থেকে বেশি মাথা উঁচু করে না থাকতে পারেন
# ছবিগুলি নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে। এতটুকু ধুলোর পরত থাকলে হবে জরি’মানা। ধুলোর পরত যত মোটা, তত মোটা জরি’মানার অঙ্ক
# ছবিগুলির সঙ্গে একই দেওয়ালে শুধু প্রশাসনের তরফে পাওয়া কোনো পুরস্কার বা রাষ্ট্রনেতাদের সঙ্গে গ্রুপ ছবি ঝোলানো যাবে।