চট্টগ্রামে শেখ হাসিনাকে হ’ত্যাচেষ্টা: যা ঘটেছিল সেদিন

0

ফিচার ডেস্ক:

১৯৮৮ সালে স্বৈ’রাচার এরশাদ সরকারের আমলে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার জনসভার আগে গু’লি চালিয়ে ২৪ জনকে হ’ত্যা মামলার রায়ে ৫ জনকে ফাঁ’সি দেয়া হয়েছে। ঘটনার ৩২ বছর পূর্ণ হওয়ার মাত্র ৪ দিন আগে এ রায় এলো।

সোমবার বিকেল ৩টার কিছু পরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ (ভারপ্রাপ্ত) ইসমাইল হোসেনের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন।

যাদের মৃ’ত্যুদ’ণ্ড দেয়া হয়েছে তারা হলেন- মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, প্রদীপ বড়ুয়া, গোপাল চন্দ্র (জেসি) মণ্ডল ও আব্দুল্লাহ। এরা প্রত্যেকেই পুলিশের সাবেক সদস্য এবং একমাত্র গোপাল চন্দ্র পলাতক, বাকিরা কারাগা’রে আছেন।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি নগরীর লালদীঘি ময়দানে সমাবেশে যাওয়ার পথে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহরে পুলিশ এলোপাতাড়ি গু’লি চালালে ২৪ জন মা’রা যান। আহত হন ৩ শতাধিক মানুষ।

সেদিন যা ঘটেছিল:

২৪ জানুয়ারি, র’ক্তস্নাত চট্টগ্রাম গণহ’ত্যা দিবস। স্বৈ’রাচার বিরো’ধী আন্দোলনে উত্তাল সময়। ১৯৮৮ সালের সেই দিনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরো’ধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা নগরীর লালদীঘি ময়দানে আয়োজিত এক জনসভায় যোগ দিতে গেলে সম্পূর্ণ বিনা উ’স্কানিতে তৎকালীন স্বৈ’রাচার এরশাদ সরকারের আজ্ঞাবহ পুলিশ বাহিনী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ জনতার ওপর নি’র্বিচারে গু’লি চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই মা’রা যান ২৪ জন। পরে অ’জ্ঞাত পরিচয় আরও ৮ জন নিহ’তের খবর পাওয়া যায়। আহত হন প্রায় ৩ শতাধিক মানুষ।

সেদিন শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে গু’লি চালালেও নিতান্তই ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি। শেখ হাসিনার উপর গু’লি করার সময় এক পুলিশ সদস্য মেশিনগানের গু’লির বেল্ট খুলে ফেলায় তিনি বেঁচে যান। এ সময় আওয়ামীপন্থী আইনজীবী ও নেতা কর্মীরা মানব ঢাল তৈরী করে শেখ হাসিনাকে কর্ডন করে আইনজীবী সমিতি অফিসে নিয়ে রক্ষা করেন।

নৃ’শংস এই ঘটনার ৩২ বছর রায় হয়েছে আজ। সেই নার’কীয় হ’ত্যাকাণ্ডে নিহ’তদের স্মরণে আদালত ভবনের প্রধান গেটে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে প্রতি বছর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন।

১৯৯৬ সালে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি কর্মকর্তা কাদের খান আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করার পর ২০০০ সালের মে মাসে আসামিদের বিরু’দ্ধে অভিযোগ গঠন (চার্জ ফ্রেম) করা হয়। ১৬৮ জনের মধ্যে ৪১ জন সাক্ষী ইতিমধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দেন। এরপর ৮ বছর যাবত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরা হাজির না হওয়ায় বা রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষীদের হাজির করতে না পারায় মামলার বিচার কার্যক্রম বিলম্বিত হয়।

জানা গেছে, ৮ বছরে মাত্র ১ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন। ২০১৮ সালে ৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। মামলায় সাক্ষীদের হাজির না করা প্রসঙ্গে এই আদালতের সাবেক বিচারক গোলাম সরওয়ার এক আদেশে বলেন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি মোতাবেক আদালতে সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব সংশিষ্ট পুলিশের। এরই মধ্যে মা’রা গেছেন মামলার বাদি শহীদুল হুদাও।

এদিকে চট্টগ্রাম গণহ’ত্যায় নিহ’ত শহীদদের স্মরণে নগরীর কোর্ট বিল্ডিংয়ের পাদদেশে নির্মাণ করা হয়েছিল স্মৃতিফলক। বছরের একটি দিন শহীদদের স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানালেও বাকি সময় আর কেউ খবর রাখে না তাদের।

জানা যায়, ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারির ওই দিনে বৃষ্টির মতো এলোপাথাড়ি গু’লিতে শেখ হাসিনা ও কেন্দ্রীয় নেতারা ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও প্রাণ হারান মোট ৩২ জন ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী জনতা। আহত হয় আরও প্রায় ৩ শতাধিক। নৃ’শংসতার এক পর্যায়ে পুলিশের কড়া পাহারায় নিহ’ত অধিকাংশের লা’শ রাতের অন্ধকারে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নগরীর অভয়মিত্র মহাশ্মশানে পুড়িয়ে ফেলা হয়।

অন্যদিকে চলে লা’শ গু’ম করার চেষ্টা। এই ঘটনার ৪ বছর পর ১৯৯২ সালের ৫ মার্চ আইনজীবী শহীদুল হুদা বাদী হয়ে চট্টগ্রামের মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে তৎকালীন পুলিশ কমিশনার কাজী রকিবুল হুদা এবং কোতয়ালি জোনের পুলিশ পরিদর্শক (পিআই) গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডলসহ মোট ৪৬ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। ইতিহাসে দিনটিকে চট্টগ্রাম গণহ’ত্যা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মামলাটি পুনরুজ্জীবীত করা হয়। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, সিআইডির চার্জশিটভুক্ত ৮ আসামি হলেন- সাবেক সিএমপি কমিশনার মির্জা রকিবুল হুদা, কোতয়ালি থানার সাবেক টহল পরিদর্শক (পিআই) গোবিন্দ চন্দ্র মন্ডল এবং ৬ কনস্টেবল- প্রদীপ বড়ুয়া, মোস্তাফিজুর রহমান, মমতাজ উদ্দিন, শাহ আবদুল্লাহ, আবদুস সালাম এবং বশির উদ্দিন।

এদের মধ্যে গোবিন্দ চন্দ্র ঘটনার শুরু থেকেই পলাতক রয়েছেন। আর প্রদীপ বড়ুয়া, মমতাজ উদ্দিন, মোস্তাফিজুর রহমান, শাহ আবদুল্লাহ এবং মির্জা রকিবুল হুদা ২০০৩ সাল থেকে জামিনে রয়েছেন বলে জানা যায়। অন্যদিকে বশির উদ্দিন ও আবদুস সালাম জামিনে থাকা অবস্থায় মা’রা যান। মামলার বাদী আইনজীবী মো. শহীদুল হুদা এবং সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি আবদুল কাদেরও মা’রা গেছেন।

গণহ’ত্যায় নিহ’ত সেই ২৪ জন হলেন- মোহাম্মদ হাসান মুরাদ, সীতাকুন্ড থানা ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন শামীম, ছাত্রনেতা স্বপন কুমার বিশ্বাস, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা এথেলবাট গোমেজ কিশোর, স্বপন চৌধুরী, অজিত সরকার, ক্ষেতমজুর নেতা রমেশ বৈদ্য, বদরুল আলম, হোটেল শ্রমিক ডি কে চৌধুরী, ছাত্রনেতা সাজ্জাদ হোসেন, আবদুল মান্নান, সবুজ হোসেন, কামাল হোসেন, বি কে দাশ, পঙ্কজ বৈদ্য, বাহার উদ্দিন, চান্দ মিয়া, সমর দত্ত, হাসেম মিয়া, মোহাম্মদ কাশেম, পলাশ দত্ত, আবদুল কুদ্দুস, গোবিন্দ দাশ এবং শাহাদাত।

২৪ জানুয়ারি গণহ’ত্যার প্রত্যক্ষদর্শী নগর আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল বলেন, চট্টগ্রামের এ গণহ’ত্যা সারাদেশে স্বৈ’রাচার বিরো’ধী আন্দোলনকে আরও জোরদার করেছিল। গণতন্ত্রের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে চট্টগ্রামের এ আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

গণহ’ত্যায় নিহ’ত স্বপন চৌধুরীর নিকটাত্মীয় আইনজীবী শিবুচন্দ্র মজুমদার বলেন, কেবল ২৪ জানুয়ারি এলে সবাই গণহ’ত্যার শহীদ পরিবারের খোঁজ করেন। তাছাড়া সারা বছর কেউ একটি খবরও নেয় না।

কী রকম নি’গৃহীত জীবনযাপন করছে ওরা তা বলাবাহুল্য। আমরা চাই সরকার আসামিদের শা’স্তির আওতায় আনার পাশাপাশি ক্ষ’তিগ্রস্থ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসুক সরকার।

শেয়ার করুন !
  • 1.5K
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!