ফিচার ডেস্ক:
অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিয়ে বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসছে ‘আম্ফান’। ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। নানা সময়ে ভ’য়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে এদেশ। হয়েছে ব্যাপক প্রাণহা’নিও। ১৯৬০-২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট ৩৫টি বড় সাইক্লোনের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে অন্তত ১০টির ক্ষয়ক্ষ’তি ও প্রাণহা’নি ছিল অনেক বেশী। এখানে দেশে আঘা’ত হানে প্রলয়’ঙ্করী কিছু ঘূর্ণিঝড়ের কথাই তুলে ধরা হলো-
♣ ১৯৬০ সালের ঘূর্ণিঝড়
১৯৬০ সালের ১১ অক্টোবর চট্টগ্রামে আঘা’ত হানে এই ‘সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ বা প্রবল ঘূর্ণিঝড়। সে সময় ঘূর্ণিঝড়ের নাম ঠিক রাখার কোনো প্রচলন ছিল না। এই ঘূর্ণিঝড়টির বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৬০ কিলোমিটার। এসময় ১৫ ফুটের মত জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। এতে কত প্রাণহা’নি হয়েছিল, সুনির্দিষ্টিভাবে তার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে এতে নিহ’তের সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নয় বলে ধারণা করা হয়।
♣ ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়
১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়টি ছিল সবচেয়ে ভ’য়াবহ। সেবার ১২ নভেম্বর সবোর্চ্চ ২২৪ কিলোমিটার বেগে চট্টগ্রামে আঘা’ত হানে এই ঘূর্ণিঝড়। ফলে ১০ থেকে ৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। অসংখ্য গবাদি পশু এবং ঘরবাড়ি ডুবে গিয়েছিল। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল লাখ লাখ মানুষ। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, ১৯৭০ এর সালের ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৫ লাখ মানুষ নিহ’ত হয়েছিল। যদিও পাকিস্থানি শাসকরা ক্ষয়ক্ষ’তির পরিমাণ কম দেখাতে বহুগুণ কমিয়ে বলেছে বলে জানা যায়।
♣ ১৯৮৮ এর ঘূর্ণিঝড়ে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস
১৯৮৮ সালে হওয়া এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বাংলাদেশে যে বন্যা হয়, তা ইতিহাসে অন্যতম সর্বনা’শা বন্যা হিসেবে পরিচিত। ১৬০ কিলোমিটার গতিতে ২৯ নভেম্বর বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তের স্থলভূমিতে আঘা’ত করে এটি। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সে সময় বাংলাদেশের ৫ হাজার ৭০৮ জন প্রাণ হারান।
♣ ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়
প্রবল এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ২২৫ কিলোমিটার। এটি মূলত চট্টগ্রামে আছড়ে পড়েছিল। এতে ১২ থেকে ২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল। ২৯ এপ্রিলের এই ঘূর্ণিঝড়কে আখ্যা দেওয়া হয় ‘শতাব্দীর প্রচণ্ডতম ঘূর্ণিঝড়’ হিসেবে। এতে প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মা’রা যায়।
♣ ১৯৯৭ সালের ঘূর্ণিঝড়
১৯৯৭ সালের ১৯ মে আরেকটি ঘূর্ণিঝড় হয়। এটি ২৩২ বেগে সীতাকুণ্ডে আঘা’ত হানে। এতে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। এরপর আরো কয়েকটি প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। তবে সেগুলো বাতাসের গতিবেগ ছিল কম।
♣ সিডর-২০০৪
২০০৪ সাল পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের কোনো নামকরণ করা হয়নি। ২০০৭ সালে এসে নামকরণ হয়। এই বছরের ১৫ নভেম্বর যে ঘূর্ণিঝড় হয় তার নাম সিডর। ২২৩ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা সিডরের তা’ণ্ডবে খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় এলাকায় ১৫-২০ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস হয়। সিডরে রেডক্রসের হিসেবে ১০ হাজার মানুষ মা’রা গেছে বলা হলেও সরকারিভাবে ৬ হাজার বলা হয়। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষ’তি হয় লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়া ফসলি জমির। এখনো সেখানে ফসল হয় না।
♣ নার্গিস-২০০৮
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভ’য়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে একটি হলো নার্গিস। ২০০৮ সালের মে মাসে এটি মিয়ানমারে আঘা’ত হানে। এতে প্রাণ হারায় ১ লাখ ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষ। ৪ লাখ ৫০ হাজার ঘর-বাড়ি পুরোপুরি বিধ্ব’স্ত হয়। এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়লেও তেমন বেশি ক্ষয়ক্ষ’তি হয়নি।
♣ আইলা-২০০৯
পশ্চিমবঙ্গ-খুলনা উপকূলীয় এলাকায় আঘা’ত হানা প্রবল ঘূর্ণিঝড় হলো ‘আইলা’। এটি ২০০৯ সালের ২৫ মে আঘা’ত হানে। যার বাতাসের গতিবেগ ছিল ৭০-৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত। এই ঝড়েও ক্ষ’তি হয় ফসলি জমির। লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ায় বহু ক্ষেত এখনো অনাবাদি অবস্থায় আছে।
♣ মহাসেন-২০১৩
ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ ২০১৩ সালের ১৬ মে নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপকূলে আঘা’ত হানে। এটির গতি ছিল ১০০ কিলোমিটার।
♣ কোমেন-২০১৫
ঘূর্ণিঝড় কোমেন ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে আঘা’ত হানে। বাতাসের গতি ছিল ৬৫ কিলোমিটার। কোমেনের তা’ণ্ডবে মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও ভারতে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছিল।
♣ রোয়ানু-২০১৬
রোয়ানু একটি ছোট ঘূর্নিঝড়, যা ২০১৬ সারে ২১ মে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে এবং ভারতে আংশিক আঘা’ত হানে। ধারনা করা হয় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ব্যাপ্তি ছিল দুটি বাংলাদেশের সমান আকৃতির।
♣ মোরা-২০১৭
উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় অবস্থানরত প্রবল ঘূর্ণিঝড় এটি। ২০১৭ সালের ৩০ মে কক্সবাজারে ১৪৬ কিলোমিটার বেগে আঘা’ত হানে ঘূর্ণিঝড় মোরা। এর তা’ণ্ডবে হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ধ্বং’স হয়ে যায়। কক্সবাজারে বিদ্যুৎব্যবস্থা বিচ্ছি’ন্ন হয়ে পড়ে। জমির ফসল এবং লবন চাষীদের জমাকৃত লবন ন’ষ্ট হয়ে যায়। ২ জন নারীসহ ৩ জন মা’রা যায়।
♣ ফণী-২০১৯
ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র নাম দেয় বাংলাদেশ। এর অর্থ সাপ (ফণা আছে যার)। ফণী ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল ভারতীয় মহাসাগরে সুমাত্রার পশ্চিমে গঠিত একটি ক্রান্তীয় নিম্নচাপ থেকে সৃষ্টি হয়। ৩০ এপ্রিল তীব্র ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়। ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে মোট ৮৯ জনের মৃ’ত্যু হয়। ভারত ও বাংলাদেশ মিলিয়ে ব্যাপক ক্ষ’তি হয়, যার বেশিরভাগই হয় উড়িষ্যায়।
♣ বুলবুল-২০১৯
২০১৯ সালের নভেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের উপকূল ঘেঁষে প্রথম আঘা’ত হানার পর বুলবুল প্রায় ১৫০ কিলোমিটার বেগে বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে আসে। কিন্তু বুলবুলের পূর্ব এবং পশ্চিম দু’দিকেই ৩ কোণার মতো অবস্থানে ছিল সুন্দরবন। সুন্দরবনের গাছপালার কারণে বুলবুল বেশ দুর্বল হয়ে যায়।
ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এ দেশে প্রতি বছর আঘা’ত হানে একাধিক ঘূর্ণিঝড়। তবে আশার কথা হলো বিগত কয়েক দশকে বাংলাদেশের দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে ঝড়ে প্রাণহা’নির পরিমাণ কমে এসেছে। বিশ্বে বাংলাদেশকে দুর্যোগ মোকাবেলায় রোল মডেল ধরা হয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই বিভিন্ন সভা সেমিনারে অংশ নেন, নিজেদের অভিজ্ঞতা ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে জানান অন্যদের।
68