তাজ-কন্যার সাক্ষাৎকার: আব্বু ছিলেন স্বপ্নের রাজপুত্র

0

সময় এখন ডেস্ক:

‘৩ নভেম্বর সারাদিন নানা জল্পনা-কল্পনা আর গুজবের মধ্যে কেটেছে। জেলখানায় কি হয়েছে তা জানায়নি। তবে পরের দিন অন্যরকম গুজব ছিল। জেলখানায় পরশু রাতে পাগলা ঘণ্টা বেজেছে, গুলির শব্দ শোনা গেছে। ওইদিন বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় ফোন করেছি। আমি তাজউদ্দীনের মেয়ে পরিচয় দিয়ে কথা বলেছি বিভিন্ন জায়গায়, কিন্তু কোনো কিছুই জানতে পারিনি। তাই আমি আর রিপি পাশেই মফিজ কাকুর বাসায় গিয়েছি। কিছুক্ষণ পর কয়েকজন নারী বাসায় ঢুকে একজন নিজেকে খালেদ মোশারফের মা পরিচয় দেন। পরে তিনি আমার ছোট ফুফুর ছেলে ঢাকা কলেজের ছাত্র বাবুলকে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে বাবার হত্যার কথা জানান। বাবুল ভাই বলল, মামা মানে আব্বু আর নেই।’

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ সব কথা বলেন।

জেলহত্যার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তাজউদ্দীন কন্যা বলেন, ‘ওইদিন ভর সন্ধ্যায় আব্বুর কয়েকজন বন্ধু বাসায় আসেন। তারা এসে আমাদের ডা. করিম কাকুর মাধ্যমে আব্বুর হত্যার ঘটনা জানান। আমার মা এই কথা জানার পর মনে হল এক প্রাণহীন পাথর। আমি যেন শক্তিহীন হয়ে পড়ি। পরে আমি আবার মফিজ কাকুর বাসায় যাই। সেখানে পরে জানতে পারি যে, রাত ১২টা ২৫ মিনিটে আব্বুর লাশ বাসায় এসেছে। আমি রাতভর আব্বুর পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়েছি। সে দিন সোহেলকে সঙ্গে নিয়ে আব্বুর কাছে গিয়ে দেখি, ডান পায়ের গোড়ালিতে বুলেটের রক্তাক্ত ক্ষত।’

রিমি বলেন, ‘ময়নাতদন্ত রিপোর্টে লেখা আছে, বুলেটবিদ্ধ হওয়ার পর রক্তক্ষরণে আব্বুর মৃত্যু হয়েছে। এরই মধ্যে মনসুর কাকুর মৃতদেহ আমাদের বাসার পেছনে তাদের এক আত্মীয়র বাসায় রাখা আছে জেনে আমি সেখানে গিয়ে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানিয়ে আসি।’

তিনি বলেন, ‘আমার আব্বু ছিলেন স্বপ্নের রাজপুত্র। আকাশের তারার মাঝে তাকে খুঁজতাম। তাই যে দিন থেকে আব্বু মিশে গেল বাংলাদেশের মানচিত্রের মাটিতে আমার মনে হয় তখন তিনি আরও শক্তিশালী।’

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার এবং অন্যান্য সদস্যরা ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলহত্যাকাণ্ডের প্রায় ৩৬ ঘণ্টা পর জানতে পারেন।

রিমি জানান, সেই সময় জানাজা ও লাশ দাফন নিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছিল। অনেককে আটকও করেছিল। পরে সেনা সদস্যরা এসে জোর করে লাশ নিয়ে যায় এবং বনানীতে দাফন করেন।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের জেলহত্যার ক’দিন আগে, অর্থাৎ অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী বাবার সঙ্গে সাক্ষাৎকালের কিছু স্মৃতিকথা উল্লেখ করেন। বাবার সঙ্গে আলাপকালে তিনি যে সব কথা বলেছিলেন, তার মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে স্বপ্নে দেখে যে উক্তি করেছিলেন তা ছিল ‘আমাদের আর বাঁচিয়ে রাখবে না। আমি মুজিব ভাইকে স্বপ্নে দেখেছি। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, তাজউদ্দীন তুমি চলে এসো, সেই ১৯৪৪ সাল থেকে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয়। তারপর থেকে আমরা দুজন এক সঙ্গে ছিলাম। এখন তোমাকে ছাড়া আর ভাল লাগে না।’

‘আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ’ গ্রন্থেও এ সব বিষয় লিখেছেন সিমিন হোসেন রিমি এমপি।

তিনি আরও বলেন, ‘মৃত্যুর দুই দিন আগে ১ নভেম্বর স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন লিলির সঙ্গে কারাগারে তাদের শেষ কথা হয়। হাইকোর্টে রিট করে কীভাবে তার বাবাকে মুক্ত করা যায় এই ব্যাপারে আইনজীবী নিয়ে তার মা জোহরা তাজউদ্দীন কারাগারে গিয়েছিলেন।’


ছবি: তাজউদ্দীন আহমদ- এর কন্যা সিমিন হোসেন রিমি

রিমি তার বইতে লিখেছেন, তাজউদ্দীন আহমদ তার স্ত্রীকে আরও বলেছিলেন, ‘লিলি (সৈয়দা জোহরা তাজদ্দীন) আমি আমার এই জীবনে কোনোদিন সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করিনি। ১৫ আগস্ট বাসা থেকে বের না হওয়াটাই আমার জীবনের মারাত্মক ভুল ছিল।’

তিনি বলেন, ‘২ নভেম্বর রাতে ছোট ভাই সোহেল তাজকে সঙ্গে নিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। ওইদিন মাকে বেশ উদ্বিগ্ন ও অন্যরকম মনে হয়েছে। জেলখানা থেকে বাসায় ফিরে মা আমাকে বললেন, আজ জেলখানার পরিবেশ অন্যরকম মনে হয়েছে। তারা আমার সঙ্গে ভাল আচরণ করেনি। রাতে মা অনেক চিন্তিত ছিল। ভোররাতে মার ডাকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাবার আগে আমি দেখেছি বাবা যেন বাসায় এসেছিলেন। ওইদিন সকালে আকাশে যুদ্ধবিমানের খুব শব্দ ছিল। ভোর হতেই মনটা যেন কেমন হয়ে গেল।’

শেয়ার করুন !
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!