ফিচার ডেস্ক:
রাবার গাছ থেকে যে সাদা কষ বের হয়, মূলত তা-ই রাবারের মূল উপাদান। রাবারের এই কষকে বলা হতো ‘সাদা সোনা’। আশির দশকে সরকার থেকে রাবার উৎপাদনে ব্যাপক উৎসাহ দেওয়া হয়। তখন সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠে অনেকগুলো রাবার বাগান। কর্মসংস্থান হয় কয়েক হাজার বেকারের।
বিশেষ করে মৌলভীবাজার অঞ্চলের চা শিল্পের চেয়ে রাবার উৎপাদনে শ্রম ও খরচ ৭৫% কম হওয়ায় দিনেদিনে রাবার চাষের দিকে ঝোঁক বাড়ে। কিন্তু গত কয়েক বছরের ব্যাবধানে রাবারের দাম কয়েকগুণ কমে যাওয়া এবং বিদেশ থেকে রাবার আমদানির ফলে আগ্রহ হারিয়েছেন রাবার বাগানের মালিকরা। ফলে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে রাবার বাগান। যা এ শিল্পকে ধ্বং’সের শেষপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে।
বাগান মালিকরা বলছেন, এ শিল্প নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা না থাকা, সনাতন চাষ পদ্ধতি, নতুন শিল্পোদ্যোক্তাদের আগ্রহ সৃষ্টি না হওয়া এবং সরকারের উদাসীনতার কারণেও রাবার শিল্প তার সুদিন হারাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে মহাসং’কটে পড়বে এ খাত। ইতোমধ্যে অনেক উদ্যোক্তা বাগান বিক্রি করে দিয়েছেন। অনেকে বিক্রির কথা ভাবছেন।
রাবার বাগানের মালিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আশির দশকে বাগান শুরু করার পর ৯০ সালের দিকে প্রতি কেজি রাবারের কষ ২৮০ টাকায় বিক্রি হতো। তা কমতে কমতে বর্তমানে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। গত ১৫ বছরে রাবারের দাম কমলেও শ্রমিকসহ সব কিছুর মূল্য বেড়েছে কয়েকগুণ। সব মিলিয়ে এ ব্যবসায় এখন লাভের চেয়ে লোকসানই বেশি।
কুলাউড়া উপজেলার কলিমউল্লা রাবার বাগানের মালিক টিপু চৌধুরী জানান, ১ কেজি রাবার উৎপাদনে খরচ হয় ৬০ থেকে ৭৫ টাকা। সাথে আছে ১৫% ভ্যাট। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকা লিটার। তাই রাবার বাগান করায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন সব বাগান মালিক।
একই উপজেলার সুইট খান জানান, তার দুটি রাবার বাগান ছিল। ৩ বছর আগে একটি বাগান বিক্রি করে দিয়েছেন। করোনার কারণে ক্রেতা না থাকায় অন্য বাগানেরও কষ সংগ্রহ বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। তিনি এরই মধ্যে অবশিষ্ট বাগানটি নিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন।
তিনি বলেন, ৯০ সালে আমি বাগান শুরু করি। তখন ২৮০ টাকায় প্রতি কেজি রাবার বিক্রি করেছি। কিন্তু গত ১৫ বছর ধরে রাবারের দাম এত কমছে, বর্তমানে প্রতি লিটার রাবারের কষ বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। ৪ লিটার কষে ১ কেজি রাবার হয়। ১ কেজি রাবার বিক্রি করে দাম পাচ্ছি ১০০ টাকা। অথচ ১ কেজি উৎপাদনে খরচ পড়ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। তার উপর আছে ১৫% ভ্যাট।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে সরকারি রাবার বাগান ১৮টি। এরমধ্যে চট্টগ্রাম জোনে ৯টি, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ জোনে ৫টি, সিলেট জোনে ৪টি বাগান রয়েছে। সবমিলিয়ে দেশে প্রায় ৭০ হাজার একর ভূমিতে রাবার চাষ হয়। দেশে বছরে ১৬ থেকে ২০ হাজার টন রাবার উৎপাদন হয়। আর দেশীয় বাজারে এ পণ্যের চাহিদা বছরে ৩০ হাজার টন।
চাহিদা থাকলেও দেশের বাজারে দাম কমে যাওয়ায় রাবার বাগানের মালিকরা জানান, বিদেশ থেকে রাবার আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দেশে উৎপাদিত রাবারের দাম কমে গেছে। এ ছাড়া রাবার কৃষিপণ্য হওয়া সত্ত্বেও শিল্পপণ্য হিসেবে দেশের বাজারে ভ্যাট দিতে হচ্ছে ১৫ শতাংশ। এ কারণে আরও বিপাকে পড়েছেন বাগানের উদ্যোক্তারা। লোকসান গুনছে সরকারি বাগানগুলোও।
বেসরকারি রাবার বাগানের মালিকরা জানান, ২০১০-২০১২ সালে রাবারের দাম ছিল কেজি প্রতি ২৮০-৩২০ টাকা, ২০১৩-২০১৪ সালে এসে দাঁড়ায় ১২০-১৩০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি রাবার ১০০-১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সিলেট অঞ্চলে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের ভাটেরা, সাতগাঁও শাহজী বাজার ও রূপাইছড়া বাগানে মোট ৮ হাজার ৪৪২ একর জমিতে রাবার চাষ হয়। এ ছাড়া এ অঞ্চলে বেসরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন শতাধিক রাবার বাগান রয়েছে।
রাবার বাগানের কষের দাম কমে যাওয়ায় বাগান মালিকরা গাছ কেটে ফেলছেন। কুলাউড়া উপজেলার রাবার বাগান মালিক আবদুল মতলিব। তিনি বলেন, প্রায় ৫ বছর ভর্তুকি দিয়ে বাগান চালু রেখেছিলাম। দাম বাড়ার আশায় ছিলাম। কিন্ত দিনদিন দাম কমছেই। ফলে পুঁজি হারিয়ে সং’কটে পড়েছিলাম। এ কারণে সব গাছ কেটে বিক্রি করে ফেলেছি।
এ ছাড়াও এ অঞ্চলের বন বিভাগও রাবারের জন্য নতুন জমি দিতে আগ্রহী নয়। সরকারি বাগানগুলোর ১ লাখ ৩২ হাজার রাবার গাছের জীবনচক্র এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। আয়ুষ্কাল হারানো গাছগুলোকে শ্রীমঙ্গলে রাবার কাট প্রেসার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে নিয়ে ফার্নিচার তৈরির উপযোগী করা হচ্ছে।
ট্রিটমেন্ট প্লান্টের জেনারেল ম্যানেজার জামিল আক্তার বকুল বলেন, রাবার গাছ সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করা গেলে দারুণ টেকসই হয়। যা সেগুন কাঠের মতো আসবাব শিল্পে ব্যবহার করা যায়। গতবছর ১ লাখ ঘনফুট কাঠ ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে, যার বাজার মূল্য ৫ কোটি। সব খরচ বাদ দিয়ে সরকারের ১ কোটি টাকা লাভ হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ২ মাস কাজ চললেও বর্তমানে করোনার কারণে তা বন্ধ আছে।
বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন (বাশিউক) রাবার বিভাগ, সিলেট অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক ওয়ালিউর রহমান জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলা যাবে না। আগে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে পরে কথা বলবেন। পরদিন এ ব্যপারে যোগাযোগ করার কথা বলেন। কিন্তু পরপর ২ দিন ফোনে যোগাযোগ করলেও তিনি কোনো তথ্য দেননি।
প্রতিবেদক: রিপন দে