সময় এখন ডেস্ক:
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি- এটা পুরনো খবর। দীর্ঘদিন ধরেই নির্বাচনের দাবি করে এসেও শুধুমাত্র কিছু অনুপযোগী সিদ্ধান্তের বশে এবং সুযোগ্য নেতৃত্বহীনতায় নির্বাচনী প্রস্তুতি ও গণসংযোগে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে অনেকটাই পিছিয়ে আছে দলটি।
আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় বিএনপির এবারের নির্বাচনী অভিজ্ঞতা অনেকটাই ভিন্ন। ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে সব নির্বাচনে সামনে থেকে বিএনপির নেতৃত্ব দিয়েছেন দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২০০১ সালের নির্বাচনী কর্মকাণ্ডে খালেদা জিয়াকে সহায়তা করেন তার বড় ছেলে তারেক রহমান। পরে যিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং বর্তমানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে ভরাডুবি হয় দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপির। এর পর নির্বাচনী রাজনীতি থেকে এক দশক দূরে বিএনপি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়নি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া এ দলটি। ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কট করে আন্দোলন চলাকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিদেশে মারা যান জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত আরাফাত রহমান। ওই সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের অবস্থান কর্মসূচি চলছিল। দলের চেয়ারপারসন তখন গুলশান কার্যালয়ে অনেকটাই গৃহবন্দি।
এর পর থেকে বিএনপি বারবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু পেরে ওঠেনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরও কিছু দিন অবরোধ কর্মসূচি চালু রাখে দলটি। কিন্তু পরে ঘোষণা ছাড়াই তা প্রত্যাহার করা হয়। গত সাড়ে ৪ বছরে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দেয়নি রাজপথের এ বিরোধী দল। বিক্ষোভ, অনশনের মতো অহিংস পথেই নিজেদের দাবি তুলে ধরেছে দলটি। আদালত দলের চেয়ারপারসন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সাজার রায় দিলেও বিএনপি সহিংস কর্মসূচি দেয়নি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন না করা দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দলটি এবার যে কোনোভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। তাই তো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগমুহূর্তে দলীয় চেয়ারপারসনের সাজা বৃদ্ধির প্রতিবাদে কঠিন কোনো কর্মসূচি দেয়নি। বিএনপি নেতাদের বিবেচনায় ছিল- হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপি নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করবে। পুলিশের ধরপাকড়ে নির্বাচনী প্রস্ততি বিঘ্নিত হবে।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা আসার পর বিএনপির রাজনৈতিক তৎপরতা নির্বাচনমুখী রূপ নিয়েছে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল বিএনপি। নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি না মানায় দলটি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে। এবার ১০ বছর পর সেই দাবি আদায় ছাড়াই জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে তারা।
দলটির মনোনয়ন ফরম বিক্রির কার্যক্রম চলছে। বহিষ্কৃত ও কথিত সংস্কারপন্থী নেতাদেরও দলে ভেড়ানো হচ্ছে। এ পর্যন্ত সংস্কারপন্থী ও বহিষ্কৃত গোট ত্রিশেক নেতাকে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপির হাইকমান্ড। নির্বাচন সামনে রেখে দলকে চাঙ্গা ও শক্তিশালী করতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
কিন্তু যে দলটি দীর্ঘদিন নির্বাচন বর্জন ও অহিংস আন্দোলনের পথে এগোচ্ছিল, তারা মাত্র মাস দেড়েক পরেই একটি ভোটযুদ্ধে নামার জন্য কতটা প্রস্তুত।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির যে নির্বাচন, সেটিতে অংশ না নিলেও পরবর্তী সময় স্থানীয় প্রতিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে বিএনপি। তাই দীর্ঘদিন ধরে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করিনি-এটি ঠিক না।
বিএনপি এবার একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করছে, এমনটি জানিয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ স্থায়ী কমিটির এ সদস্য বলেন, আমাদের দল যেহেতু গণতান্ত্রিক। আমাদের আন্দোলন, সংগ্রাম ও চেতনার উদ্দেশ্য হল-একটি নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন আনা। জনগণের অংশগ্রহণ ও মতামতের ভিত্তিতে একটি সরকার গঠন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলেই, এ দেশে প্রকৃতপক্ষে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট শুরু থেকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি শর্ত দিয়েছিল। এর মধ্যে দুটি দাবি স্পষ্ট ছিল-এক. খালেদা জিয়ার মুক্তি। দুই. সংসদ ভেঙে নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এসব দাবিদাওয়ার ক্ষেত্রে বিএনপির মধ্যে দুটি অবস্থান ছিল স্পষ্ট। এর মধ্যে একটি পক্ষ চেয়েছিল, তাদের দাবিগুলো পূরণের পরেই নির্বাচনে যাওয়া, না হলে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া। আরেক পক্ষ ছিল, যারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
বিএনপির একটি অংশ এখনও খালেদা জিয়ার মুক্তি ব্যতিরেকে নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষে।
নির্বাচনে অংশ নেয়ার পক্ষের বিএনপি নেতাদের যুক্তি হচ্ছে-এক দশক ধরে বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের বাইরে। এবারও অংশ না নিলে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখা কঠিন হয়ে যেতে পারে। অনেকে স্বতন্ত্র কিংবা অন্য প্লাটফর্মে গিয়ে নির্বাচন করতে পারে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের বিধি অনুযায়ী বিএনপির নিবন্ধনও বাতিল হয়ে যাবে। তখন দল আরও গভীর সংকটে পড়বে।
তাদের যুক্তি হচ্ছে-অবাধ নির্বাচনের ন্যূনতম পরিবেশ সৃষ্টি হলে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত। এতে করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট কিংবা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনাই বেশি। আর যদি ক্ষমতায় নাও আসা যায়, তাহলে বড়সংখ্যক আসনে জয়ী হয়ে বিরোধী দলের দায়িত্ব নিয়ে সংসদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা যাবে। তখন স্বাভাবিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। এতে করে দলীয় নেত্রীকে মুক্তির আন্দোলন আরও বেগবান করা সম্ভব হবে।
তবে বিএনপি জোটে যারা নির্বাচনে অংশ না নেয়ার পক্ষে তাদের মত হচ্ছে-সাত দফা দাবির কোনো দাবিই আজও সরকার মানেনি। দুই দফা সংলাপ করেও দৃশ্যমান কোনো ফল আসেনি। এমতাবস্থায় বিএনপি জোট নির্বাচনে গিয়ে কি করবে? নির্বাচনের সমতল ভূমি সৃষ্টি না হলে আর দলীয় নেত্রীকে জেলে রেখে নির্বাচনে অংশ নিলে ফল বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন তারা। এমতাবস্থায় নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপি জোট সরকারের পাতা ফাঁদে পা দেবে বলে মনে করছেন তারা।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা- এমন প্রশ্নে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বিএনপি অবশ্যই একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে। দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবেই নির্বাচনে যাবে বিএনপি।
তবে এর বিপরীত মত দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায়। একটি বেসরকারি টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, সাত দফার কোনো দাবিই সরকার মানেনি। এমতাবস্থায় বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়া মানে সরকারের পাতা ফাঁদে পা দেয়া।
এখন এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তের পর, দলের পক্ষ থেকে যে দাবিগুলো তোলা হয়েছিল সেগুলোর কী হবে? এমন প্রশ্নে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমাদের যে সাত দফা আছে, সেগুলো আদায়ে আমরা অবিচল আছি। আমাদের নেত্রীর মুক্তি দাবি করছি। যদি সরকার এসব দাবি পূরণ না করে, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আন্দোলনের অংশ হিসেবে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব।
তিনি বলেন, এ নির্বাচনে আমাদের মূল স্লোগান হবে-খালেদা জিয়ার মুক্তি চাই, ধানের শীষে ভোট চাই। অর্থাৎ এই ধানের শীষে ভোট চাই একটি আন্দোলনের অংশ। ভোটের মাধ্যমে দেশের জনগণ বাংলাদেশে একটি ‘ভোটের বিপ্লব’ ঘটাবে। ভোটের সিদ্ধান্তে দলের মধ্যে যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গেছে, সেটি নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়ার আভাস দেয়। নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্তের পর নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে সব পর্যায়ের নেতাকর্মীর মধ্যে একটি উদ্দীপনা, একটি উৎসাহ দেখা গেছে এবং সারাদিন জনজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, আমাদের তৃণমূল নেতাকর্মীরা চাইছেন যে নির্বাচন চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়ার জন্য।
একাদশ নির্বাচনের বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটের শরিকরা বেশ আগে থেকেই তাদের প্রস্তুতি শুরু করেছে, মাঠ পর্যায়ে যোগাযোগ শুরু করেছে। কিন্তু বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা এসেছে তফসিল ঘোষণার ঠিক আগ মুহূর্তে। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক সক্ষমতা বা উপযুক্ত নেতৃত্ব কি বিএনপির আছে?
এমন প্রশ্নের জবাবে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আমি মনে করি আমাদের সাংগঠনিক শক্তি ও জনসমর্থন আছে। এবং এই শক্তিকে দাবিয়ে রাখার জন্য সরকার হেন কোনো পরিকল্পনা নেই যে নেয়নি। আমাদের নেতাকর্মীদের এখনও মামলা দিয়ে গ্রেফতার করছে, আমাদের হাজার হাজার কর্মী জেলে। লাখ লাখ কর্মী মামলার আসামি।
তারপরও বিএনপি কার্যালয়ের সামনে নেতাকর্মীদের এই উদ্দীপনা দেখে তিনি মনে করেন, গত ১০ বছর ধরে সরকারের কোনো চেষ্টাই নেতাকর্মীদের মনোবল হারাতে পারেনি।