প্রবাস ডেস্ক:
বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত পুরোটাই দাঁড়িয়ে আছে প্রবাসীদের পাঠানো ক’ষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের ওপর। উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন তারা। বিদেশে প্রবাসীদের দেখভালের দায়িত্ব কনস্যুলেট কর্মকর্তাদের। দূতাবাসটাই প্রবাসীদের কাছে এক টুকরো স্বদেশ। কিন্তু সেবার পরিবর্তে দূতাবাস কর্মকর্তারা উল্টো খুলে বসেছেন ব্যবসাকেন্দ্র!
সৌদি আরবের জেদ্দায় অবস্থিত বাংলাদেশ কনস্যুলেট কিছু কর্মকর্তার জন্য হয়ে উঠেছে বাণিজ্যকেন্দ্র। সম্প্রতি জেদ্দা কনস্যুলেটের নানাবিধ দুর্নীতি আর অ’নিয়মের খবর উঠে এসেছে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এমআরপি ও ডিজিটাল পাসপোর্ট সংক্রান্ত নানা দুর্নীতি, মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গাদেরকে অ’নৈতিক উপায়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যু করা, বাংলাদেশি শ্রমিকদের আউটপাস অনুমোদন, পাসপোর্ট নবায়নসহ নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতি এবং অ’নিয়মের মাধ্যমে অ’বৈধ অর্থ উপার্জনের অনেক তথ্য প্রমাণ নিয়ে চলছে তোলপাড়। এর সাথে জড়িত অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নামও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তাদের বিরু’দ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাই দিন দিন বেড়েই চলেছে তাদের অপরাধের মাত্রা। বলা হয়, রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় তারা পার পেয়ে যাচ্ছেন। দেশেও তাদের শুভাকাঙ্খী রয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
বিশ্বের যেসব দেশে বাংলাদেশিরা রয়েছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে সৌদি আরবে। যার ফলে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পায় সৌদি থেকেই। অথচ এই প্রবাসীরাই এখানে সবচেয়ে বেশি দু’র্ভোগ পোহাচ্ছেন নিজ দেশের কর্মকর্তাদের দ্বারা। দূতাবাসের ক্ষমতাধর কর্মকর্তাদের আসল চেহারা প্রকাশ করার জন্য কিছু প্রমাণ সংগ্রহ করা হলো-
জেদ্দা কনস্যুলেট এর ফার্স্ট সেক্রেটারি, মোস্তফা জামিল খান কর্মস্থলে যোগদানের শুরু থেকেই তার রাজত্ব কায়েম করেন। এখানে তার একটা সিন্ডিকেট রয়েছে, যার হোতা আজাদ রহমান এবং তার কিছু নির্দিষ্ট অনুচর। যারা জেদ্দার কিছু অঞ্চল থেকে শি’কার ধরেন।
সম্প্রতি নাসির মিয়া নামের কোরআনে হাফেজ এক প্রবাসী শ্রমিকের সন্ধান পায় সময় এখন এর প্রতিনিধি, যিনি আড়াই বছর পূর্বে সৌদি আরবে এসেছিলেন। কিন্তু তার নিয়োগদাতার অ’মানবিক আচরণের কারণে তিনি আর এখানে থাকতে রাজি নন। তিনি কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যান। সৌদি আরবের চাকরিদাতারা সাধারণত কর্মীদের পাসপোর্ট নিজেদের কাছে জমা রেখে দেন, নাসিরের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিল। নাসির পালিয়ে যাওয়ার সময় স্বভাবতই পাসপোর্ট হাতে পাননি। ফলে পাসপোর্টহীন অ’বৈধ অভিবাসী হিসেবে পুলিশের খাতায় নাসিরের নাম উঠে যায়। আর তিনি গা ঢাকা দিয়ে এক দু’র্বিষহ জীবনযাপন করছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, কনস্যুলেট থেকে একটি আউটপাস সংগ্রহ করে দেশে ফিরে যাবেন। সৌদি আইনের হয়রা”’নির হাত থেকে বাঁচতে এ ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না।
তিনি বিভিন্ন লোক মারফত জানতে পারেন আসির অঞ্চলের বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আজাদ রহমানের কথা। চট্টগ্রাম নিবাসী আজাদের মাধ্যমে আউটপাস পাওয়া যেতে পারে কিছু অর্থ খরচ করলে- এমনটা তিনি শোনেন কয়েকজনের কাছ থেকে। তাদের কাছ থেকে যোগযোগের নাম্বার নিয়ে নাসির মিয়া ফোন করে আজাদকে আউটপাসের কথা বলেন। আজাদ তাকে ফোনে এত তথ্য দিতে রাজি ছিলেন না, তাই তাকে একটি বিশেষ জায়গায় দেখা করতে বলেন। তারপর তাদের দেখা হলে আজাদ সরকারি খরচ হিসেবে ১০০ সৌদি রিয়াল এবং কনস্যুলেট এর কর্মকর্তাদের ‘খুশি করার’ জন্য আরও ৪০০ সৌদি রিয়াল, অর্থাৎ সব মিলে ৫০০ রিয়াল খরচের কথা বলেন। [কথোপকথনের অডিও রেকর্ড সংবাদের নিচে দেওয়া হলো]। নাসিরের সামনেই আজাদ রহমান জেদ্দা কনস্যুলেট এর ফার্স্ট সেক্রেটারি মোস্তফা জামিল খানকে ফোন করে ৫০০ রিয়ালের বিষয়টি ফয়সালা করে নেন।
ছবি: মোস্তফা জামিল এবং আজাদ একসাথে উপবিষ্ট
মানবেতর জীবনযাপন করা নাসিরের কাছে ৫০০ রিয়াল অনেক বড় অংকের অর্থ। তিনি একটু দরদামের চেষ্টা করলেও আজাদ ছিলেন অনড়। অগত্যা নাসিরের সামনে আর কোনো উপায় ছিল না। তিনি রাজি হয়ে যান। এক সপ্তাহ পর আজাদের সাথে দেখা করে আউটপাস সংগ্রহ করার বিষয়ে তাদের চুক্তি হয়ে যায়। [নাসির মিয়ার নিজের মুখে ঘটনার বিস্তারিত ভিডিও ফুটেজ সংবাদের নিচে যুক্ত হলো]।
হাফেজ নাসির মিয়া এখানে দুর্নীতির তথ্যচিত্রের মাত্র একটি কলাম। এমন অসংখ্য নাসির এই সিন্ডিকেটের হাতে জি’ম্মি। করোনাকালে জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেট সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার জন্য ভবনে জনসমাগম স্থ’গিত করে। সে সময় আসির প্রদেশ থেকে মোস্তফা জামিল খান এবং তার সিন্ডিকেট শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসেই নবায়নের জন্য প্রায় ৭ হাজার পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। যার মধ্যে ৩ হাজার পাসপোর্ট অনানুষ্ঠানিকভঅবে বিতরণ করা হয়েছিল। আর প্রতিটি পাসপোর্টের জন্য আজাদ রহমান ৫০০ সৌদি রিয়েল করে আদায় করেন; যা বাংলাদেশি টাকায় ১১ হাজার ৩১৫ টাকা।
একটি সূত্র জানিয়েছে, আজাদ রহমান, মোস্তফা জামিল খান এবং কনস্যুলেট এর উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারা এভাবেই মাত্র কয়েকদিনে হাতিয়ে নেন প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার মত।
জেদ্দা কনস্যুলেট এর অধিপতি মোস্তফা জামিল খানের এই সিন্ডিকেটের খবর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়েও অবগত। কিন্তু বড় অদ্ভূত কারণে এবং বিশেষ কারো শুভ দৃষ্টির কল্যাণে তিনি নিরিবিলি তার এহেন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি তাকে পাকিস্থানে বাংলাদেশ হাইকমিশনে বদলি করা হয়। গত ১ নভেম্বর তাকে কনস্যুলেট এর সহকর্মীরা বিদায় অনুষ্ঠানও করেন, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অনেক পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ৩ নভেম্বর তার পাকিস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথাও ছিল। কিন্তু কোনো এক যাদুমন্ত্রে এবং অদৃশ্য কোনো ইশারায় সেই বদলি আদেশ স্থ’গিত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে তিনি তার পুরনো রাজ্যে পুনর্বহাল হন। সেই সাথে চলমান রয়েছে তার সিন্ডিকেটের কার্যক্রম।
যাবতীয় তথ্য প্রমাণ এবং বিভিন্ন ছবি নিচে সংযোজন করা হলো।
নাসির ও আজাদের মধ্যে অডিও কথোপকথনের লিংক, শোনার জন্য ক্লিক করুন:
(১)
ছবি: নাসির মিয়ার আউট পাস (ইস্যুর তারিখ ১২/১১/২০২০)
(২)
ছবি: আজাদ রহমান ১২/১১/২০২০-এ খামিস মোশায়েতে যাওয়ার পথে তায়েফে অবস্থান করছিলেন (নাসির মিয়ার আউট পাসের সরবরাহের তারিখ)
(৩)
ছবি: জনাব মোস্তফা জামিল খানকে জন্মদিনের শুভেচ্ছায জানিয়ে আজাদ রহমানের ফেসবুক ট্যাগই প্রমান করে তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টিকে।
(৪)
ছবি: জেদ্দা দূতাবাসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে আজাদ রহমানের ছবিটি প্রমান করে জেদ্দা কনস্যুলেটের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও যোগাযোগের বিষয়টি।
(৫)
ছবি: এক্সপার্টিয়েটস ডিজিটাল সেন্টার (ইডিসি) সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের বিরু’দ্ধে আজাদ রহমানের ফেসবুক পোস্ট।
(৬)
ছবি: মোস্তফা জামিল খানকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেয়ারওয়েল দেয়া হলেও তিনি এখনও জেদ্দা কনসুলেটে বহাল তবিয়তে অবস্থান করছেন।
ভিডিও: