বাগেরহাট সংবাদদাতা:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকে অস্বীকারকারী এবং মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, ধ্বংসযজ্ঞ চালানোসহ যুদ্ধাপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্তের পাশাপাশি নিবন্ধন বাতিলকৃত সংগঠন জামায়াতে ইসলামী দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের যোগ্যতা হারিয়ে এখন বিএনপির প্রতীক ধানের শীষে ভোটে নেমেছে। কিন্তু পোস্টারে দলটি জোটের প্রধান বেগম খালেদা জিয়ার ছবি বা নাম ব্যবহার করছে না। এ নিয়ে বিএনপিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
বিএনপি এবার মোট ২২টি আসনে জামায়াতকে ছাড় দিয়েছে। এর মধ্যে ২১টিতে জামায়াতের প্রার্থী ধানের শীষ এবং ১টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন।
বিএনপির জোটের শরিক এলডিপি, কল্যাণ পার্টি এবং অন্যরা তাদের পোস্টারে খালেদা জিয়ার ছবি এবং নাম ব্যবহার করছে। কেবল জামায়াতই এ বিষয়টি নিয়ে ‘আপত্তি’ করছে। বিষয়টি জানতে পেরে অবাক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে কর্মীরা যে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তার সঙ্গে আমি একমত। আমারও ভাষ্য, যেহেতু তারা ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করছেন, তাদের তো জিয়া পরিবারের ছবি ব্যবহার করা উচিত ছিল। এটা ঠিক হচ্ছে না।’
এ বিষয়ে জামায়াতের প্রার্থীদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একাধিক প্রার্থী আছেন কারাগারে। কেউ কেউ আত্মগোপনে। সাতক্ষীরায় জামায়াতের দুই প্রার্থী ভোট চেয়েছেন স্থানীয় ৪টি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে জামায়াতের নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ারের সঙ্গে কথা বলতে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তা সম্ভব হয়নি তিনি ফোন না ধরায়। তিনি নিজেও খুলনা-৫ আসনে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছেন।
তবে কথা হয় বাগেরহাট-৪ আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল আলীমের নির্বাচনী প্রচারণার দায়িত্বে থাকা মোরেলগঞ্জ উপজেলা জামায়াত নেতা হাফিজুর রহমান এর সাথে। তিনি জানান, বেগম জিয়া একজন নারী, তাই পোস্টারে উনার ছবি ব্যবহার করাটা ঠিক নয়। তাই আলীম স্যারের পোস্টারে উনার ছবি রাখা হয়নি।
এ বিষয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য এহসানুল মাহবুব জুবায়ের বলেন, ‘পোস্টারে ছবি ব্যবহারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নির্বাচনে প্রতীকটাই আসল। আমরা সেটা ফোকাস করার চেষ্টা করেছি। এ বিষয়ে জোটের সঙ্গে বোঝাপাড়া আছে। তাই কোনো সমস্যা হবে না এ নিয়ে।’
তবে জামায়াতের প্রার্থীদের এমন উদ্যোগে ক্ষুব্ধ স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ কারণে বেশির ভাগ আসনেই শরিক দলের প্রার্থীদের পাশে নেই তারা। খুলনা-৬ আসনে বিএনপির নেতাকর্মীদের নামাতে নানা অনুনয়-বিনয় করছেন জামায়াতের নেতারা। কিন্তু তাতেও কাজ হচ্ছে না।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শেখ হাসানুল বান্না বলেন, ‘যারা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন কিন্তু দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছবি পোস্টারে ব্যবহার করছেন না, তারা নিমক হারাম। ভুল করছে তারা। যার মার্কা ছাড়া নিজেদের কোনো অস্তিত্ব নেই, তাকেই অবজ্ঞা করছেন।’
যেসব আসনে লড়বে জামায়াত
জামায়াতের আসনগুলো হলো- ঠাকুরগাঁও-২ আবদুল হাকিম, দিনাজপুর-১ আবু হানিফ, দিনাজপুর-৬ আনোয়ারুল ইসলাম, নীলফামারী-২ মনিরুজ্জামান মন্টু, নীলফামারী-৩ আজিজুল ইসলাম, রংপুর-৫ গোলাম রাব্বানী, গাইবান্ধা-১ মাজেদুর রহমান, সিরাজগঞ্জ-৪ রফিকুল ইসলাম খান, পাবনা-৫ ইকবাল হোসাইন, খুলনা-৫ মিয়া গোলাম পরওয়ার, খুলনা-৬ আবুল কালাম আজাদ, বাগেরহাট-৩ আবদুল ওদুদ, বাগেরহাট-৪ আবদুল হালিম, সাতক্ষীরা-২ আবদুল খালেক, সাতক্ষীরা-৪ গাজী নজরুল ইসলাম, যশোর-২ আবু সাঈদ মো. শাহাদাত হোসেন, ঝিনাইদহ-৩ মতিয়ার রহমান, পিরোজপুর-১ শামীম সাঈদী, ঢাকা-১৫ শফিকুর রহমান, কুমিল্লা-১১ সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, চট্টগ্রাম-১৫ আ ন ম শামসুল ইসলাম ও কক্সবাজার-২ হামিদুর রহমান আযাদ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে জামায়াতের নুরুল ইসলাম বুলবুল ও পাবনা-১ আসনে নাজিবুর রহমান মোমেন লড়বেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে।
তাদের মধ্যে ঠাকুরগাঁও-২ আসনে আবদুল হাকিম, দিনাজপুর-১ (কাহারোল-বীরগঞ্জ) আসনে মোহাম্মদ হানিফ এবং দিনাজপুর-৬ (বিরামপুর-নবাবগঞ্জ-ঘোড়াঘাট ও হাকিমপুর) আসনে আনোয়ারুল ইসলামের পক্ষে জামায়াতের কর্মীরা ভোট চাইলেও মাঠে নামেননি বিএনপির নেতা-কর্মীরা।
দিনাজপুর-৬ আসনের বিএনপির এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কেন্দ্রীয়ভাবে জামায়াতকে কেন রাখা হয়েছে জানি না। জামায়াতের এই কাজটি খুব খারাপ হয়েছে। কিন্তু আমাদের তো করার কিছু নেই। ভোট চাইতে হবে তাদের জন্য।’
চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনে ২০ দলীয় জোটের প্রার্থী আ ন ম শামসুল ইসলামের সঙ্গেও বিএনপির যোগাযোগ নেই বলে জানিয়েছেন লোহাগাড়া বিএনপির সভাপতি শেখ মহিউদ্দিন। সিরাজগঞ্জ-৪ আসনে জামায়াতের রফিকুল ইসলামের পোস্টারে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি না দেখে খেপেছেন বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা।
উল্লাপাড়া উপজেলা জামায়াতের আমির শাহজাহান আলী বলেন, ‘বিএনপির দু-একজন নেতার কথায় কোনো সমস্যা হবে না।’
সাতক্ষীরা-২ ও ৪ আসনে জামায়াতের প্রার্থী আব্দুল খালেক ও গাজী নজরুল ইসলামের পোস্টারে খালেদা জিয়ার নাম বা ছবি না দেখে ক্ষুব্ধ বিএনপির নেতাকর্মীরা। এ বিষয়ে সাতক্ষীরা জেলা বিএনপির সভাপতি রাহমতুল্লাহ পলাশ বলেন, ‘জামায়াতের আদর্শ আর আমাদের আদর্শে ভিন্নতা থাকলেও যেহেতু জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করছি, তাই এ নিয়ে মনের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও জোটের স্বার্থে আমাদের মেনে নিতে হয়েছে।’
অবশ্য ছবি না থাকা নিয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন সাতক্ষীরা জেলা জামায়াতের প্রচার সম্পাদক আজিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা কখনো জামায়াতের প্রধানের ছবি ব্যবহার করতাম না। শুধু প্রতীক আর প্রার্থীর ছবি থাকত। আমার বিশ্বাস, এই চিন্তা থেকেই এবারও এমনটা করা হয়েছে। তবে এটা দলের কোনো ফোরামের সিদ্ধান্ত নয়।’
বাগেরহাটের দুটি আসনে ধানের শীষে নির্বাচন করছেন জামায়াতের দুজন নেতা। বাগেরহাট-৩ এ আবদুল ওদুদ ও বাগেরহাট-৪ আসনে আব্দুল আলীম নির্বাচন করছেন। তাদের প্রচার-প্রচারণায়ও নেই খালেদা জিয়া বা জিয়া পরিবারের কোনো ছবি।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি নাজমুল হোসেন বলেন, ‘জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রতীক ব্যবহার করবেন কিন্তু তাদের কারও ছবি ব্যবহার করবেন না, এটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জামায়াতের প্রার্থীদের উচিত ছিল তাদের আসনগুলোতে লাখ লাখ নেতাকর্মীর আবেগকে মূল্যায়ন করা।’
কুমিল্লা-১১ সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের আসনেও একই চিত্র দেখা গেছে। এখানেও জামায়াতের প্রার্থীর ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারে নেই জিয়া পরিবারের কোনো ছবি।