কূটনৈতিক ডেস্ক:
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের শেষদিকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিসের অন্যতম ‘কন্টাক্ট পারসন’ (যোগাযোগ করার মাধ্যম)। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পদে বাবর বয়সে নবীন হলেও তার দুর্নীতি নিয়ে কানাঘুষা ছিল।
২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন সার্ভিস থেকে অবসরে যাওয়ার পর দেশটির পররাষ্ট্রবিষয়ক কথ্য ইতিহাস প্রকল্পকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস এভাবেই লুৎফুজ্জামান বাবরের প্রসঙ্গ টেনেছেন।
বাবরের দেশ ছাড়ার পরিকল্পনার বিষয়ে কথা বলেন বিউটেনিস। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাবর বলেছিলেন, তার শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা আছে এবং চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে যাওয়া প্রয়োজন। তবে আমরা জানতাম, নিরাপদে থাকার জন্য তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন। আমার মনে হয়, তিনি কী বিষয়ে আলোচনা করতে চাইছেন তা আমরা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলাম এবং আমাদের জবাব কী হতে পারে তা-ও আমরা আগেই আলোচনা করে ঠিক করে নিয়েছিলাম।
বাবরের সঙ্গে আমাদের আলোচনা ছিল কঠিন। কারণ এর ফলাফল (দেশ ছাড়তে না পারা) তার জন্য ‘বিপদ’ হয়ে এসেছিল। এরপর তিনি গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গেছেন।
সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাকিস্থান ও ভারত— দুই দেশেরই গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বাংলাদেশে সক্রিয় থাকার বিষয়টি ছিল স্পষ্ট। বিএনপি ঐতিহ্যগতভাবে পাকিস্থানের অতি ঘনিষ্ঠ, আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক ভারতের। পাকিস্থানের গোয়েন্দা সংস্থা ‘আইএসআই’ বিএনপিতে বিপুল অর্থ ঢালছিল— এমন তথ্য ছিল আমাদের হাতে। তবে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। ভারতের তৎকালীন হাইকমিশনার ছিলেন একজন সন্মানিত জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক। তার সঙ্গে আমার আলোচনায় স্পষ্ট ছিল যে, ভারত আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্খী।
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটার কথা উল্লেখ করে বিউটেনিস বলেন, উভয় দলের রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হচ্ছিল। ধারণা ছিল এমন যে, সামরিক বাহিনী অ’কার্যকর রাজনৈতিক চক্র ভা’ঙার ও দুর্নীতি দূর করার চেষ্টা করছে।
বিউটেনিস জানান, গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা যাতে মুক্তি পান সে জন্য তাকে হস্তক্ষেপ করতে বলছিলেন। তার মতে, ব্যক্তিবিশেষের ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে আমি অনীহা দেখিয়েছি। ওই আলোচনা করা যথার্থ হতো না। কারণ ওই ব্যক্তিবিশেষ দুর্নীতিবাজ বা দুর্নীতিবাজ নন, সে বিষয়ে আমার কোনো ধারণা বা তথ্য ছিল না।
তবে গ্রেপ্তার হওয়া সবার সঙ্গে মানবাধিকারের দিক থেকে সদাচরণ করা হয়, সে জন্য তারা (মার্কিন দূতাবাস) প্রকাশ্যে বিবৃতি দিচ্ছিলেন।
বিউটেনিস এমন এক ব্যক্তির প্রসঙ্গ সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন, যিনি বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম ছিলেন। তবে ওই ব্যক্তির নাম তিনি উল্লেখ করেননি। ওই ব্যক্তির স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের বাসায় অনেকবার এসেছিলেন। অন্য রাষ্ট্রদূতদের কাছেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার স্ত্রী বিউটেনিসের সঙ্গে দেখা করে স্বামীর মুক্তির জন্য হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন।
ওই ব্যক্তির বিরু’দ্ধে তখনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়েছিল কি না সে বিষয়টি সাক্ষাৎকারে বিউটেনিস মনে করতে পারেননি। তবে তিনি ওই ব্যক্তির স্ত্রীকে বলেছিলেন, আমরা ব্যক্তিবিশেষের জন্য বলতে পারি না। বরং আমরা সবার নাগরিক অধিকার ও মানবাধিকারের প্রতি সন্মান দেখাতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে চাপ দিয়ে যাচ্ছি।
বিউটেনিস বলেন, আমি জানি, তিনি (কন্টাক্ট পারসনের স্ত্রী) এ কথা শুনতে চাননি। এখন আমারও মনে হয়, এ ধরনের কথা আমলাতান্ত্রিক। তবে সেটিই ছিল আমাদের নীতি।
কয়েক বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। বিউটেনিস সে সময় একটি সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছিলেন। আওয়ামী লীগে বিউটেনিসের সেই ‘কন্টাক্ট পারসনও’ মুক্তি পেয়েছেন। অন্য কন্টাক্ট পারসনদের মতো আওয়ামী লীগের সেই ব্যক্তির সঙ্গেও দেখা করেছিলেন বিউটেনিস। একটি হোটেলে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় ওই ব্যক্তি আটক অবস্থায় তার ওপর চালানো নির্যা’তনের কথা তাকে জানিয়েছিলেন।
বিউটেনিস তার সাক্ষাৎকারে বলেন, তিনি যখন রাষ্ট্রদূত হিসেবে বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন ইসলামের নামে উ’গ্রবাদের লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত কারও হুম’কির কারণে বাংলাদেশ থেকে ‘পিস কোর’ প্র’ত্যাহার করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
ভারত অভিযোগ করে আসছিল, বাংলাদেশ ভারত থেকে স্বাধীনতার জন্য ল’ড়াইরত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছি’ন্নতাবাদীদের আশ্রয় দিচ্ছে। অন্য এক প্রসঙ্গে বিউটেনিস আবারও বলেন, তার সঙ্গে আলোচনায় তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার বলেন, পরবর্তী নির্বাচনের জন্য শেখ হাসিনা ভারতের পছন্দের প্রার্থী।
অন্যদিকে খালেদা জিয়ার সরকারের অনেক কাছের ছিলেন পাকিস্থানের হাইকমিশনার। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল, বিএনপি সরকারে পাকিস্থানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর প্রভাব ছিল।
বিউটেনিসের মতে, আওয়ামী লীগ অধিকতর অ’সাম্প্রদা’য়িক, প্রগতিশীল ও পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে— এমন ধারণা আগে থেকেই ছিল। অন্যদিকে পাকিস্থানের সঙ্গে বিএনপির নৈকট্য প্রতিফলিত হয়েছিল। আমার মনে হয়, সাম্প্রদা’য়িক যোগসূত্রই আইএসআই ও পাকিস্থানের সামরিক বাহিনীকে সে সুযোগ করে দিয়েছিল।
বিউটেনিস আবারও বলেন, আইএসআই বিএনপিকে অনেক টাকা দিচ্ছে বলে আমাদের কাছে তথ্য ছিল। অবশ্যই, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড উইংও (র) বাংলাদেশে সক্রিয় ছিল বলে ধারণা করা হতো। যদিও তাদের দৃশ্যমান তৎপরতা চোখে পড়েনি। অপরদিকে পাকিস্থানের সঙ্গে আরেকটি যোগসূত্র ছিল বাংলাদেশের উ’গ্রপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াত (জামায়াতে ইসলামী)। জামায়াতের অনেক নেতা পাকিস্থানে আসা-যাওয়া করেন নিয়মিত।
বাংলাদেশে মাত্র ১৪ মাস রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস যখন ঢাকা ছাড়েন, তখন তার অবস্থাও হ্যারি কে টমাসের চেয়ে খুব বেশি আলাদা ছিল না।
বিউটেনিস বলেন, সে সময় বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় খবরে এমন শিরোনাম এসেছিল- ‘বাংলাদেশের চার রানী। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনা, ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি এবং আমি (বিউটেনিস)।’ ভাবনাটা এমন যে আমরাই এখানে সব কিছুর কলকাঠি নাড়ি। পত্রিকাগুলোর এমন খবর মানুষকে প্রভাবিত করে।