সভায়, আলোচনায়, ব্যানারে সর্বত্র উপেক্ষিত খালেদা, ক্ষুব্ধ তৃণমূল

0

সময় এখন ডেস্ক:

জিয়াউর রহমানের বিএনপি প্রতিষ্ঠা এবং ১৯ দফা কমসূচির বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ দর্শন মানুষের মাঝে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। তার হ’ত্যাকান্ডের পর সাধারণ এক গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে যুক্ত হন বর্তমান চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। যদিও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম ডিবিসি নিউজকে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, রাজনীতি করতে হলে লেখাপড়া জানা দরকার, অভিজ্ঞতা দরকার, সেসব খালেদা জিয়ার নাই। জিয়া মা’রা যাওয়ায় তার বউ হিসেবে তিনি (খালেদা) প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, এই তো। দ্য ওনলি কোয়ালিটি এন্ড দ্য ওনলি ক্রিডেনশিয়াল ইজ দ্যাট শি ইজ দ্যা উইডো অব জিয়াউর রহমান।

পড়ুন: খালেদার যোগ্যতা ও সরকারের সাথে সমঝোতা নিয়ে মুখ খুললেন শাহ মোয়াজ্জেম (ভিডিও)

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই বিএনপি জালিয়াতির মাধ্যমে তিনবার রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব পায়। ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় জেলে যান খালেদা। এরপর ওই বছরের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি ঘোষণা দিয়েছিল খালেদা জিয়াকে মুক্ত না করলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না, আন্দোলনের মাধ্যমে তাকে মুক্ত করবে।

পরবর্তীতে সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভারাডুবি হয়। খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে কার্যকর কোনো আন্দোলনই দেখাতে পারেনি দলটি। গুটিকয়েক নেতা বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ জানান। পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে এবং সরকার প্রধানের নির্বাহী আদেশে গতবছরের ২৫ মার্চ শর্তসাপেক্ষে মুক্ত হয়ে গুলশানের বাসভবন ফিরোজে রয়েছেন তিনি।

খালেদা জেলে যাওয়ার পর কিছুদিন বড় সভা-সমাবেশ, ইফতার পার্টিতে তার সম্মানে আসন খালি রাখা হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাকে উপেক্ষা করার অভিযোগ করে আসছিলেন দলটির মধ্যমসারির নেতারা। বিশেষ করে স্থায়ী কমিটির সভায় খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে কোনো আলোচনা না করা, মুক্তি দিতে সরকারকে চাপ প্রয়োগে ব্যর্থতা, মুক্তির আন্দোলনে সিনিয়র নেতাদের অনীহার অভিযোগ তোলা হয়।

আর সর্বশেষ গত ১ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে বিএনপি পক্ষ থেকে বছরব্যাপী কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যানারে খালেদা জিয়ার নাম না থাকায় ক্ষুব্ধ তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। বিষয়টি আলোচনায় আসার পর থেকেই সিনিয়র ও দায়িত্বশীল নেতারা সরাসরি কোনো কথা না বললেও বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার নেতারা এবং অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন।

দলীয় কর্মসূচির ফাঁকে নেতাকর্মীদের আড্ডায়ও প্রাধান্য পাচ্ছে এই ইস্যুটি। অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান, কারণ জানতে চান। কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে জানতে চান, এটা কি নিছক ভুল নাকি পরিকল্পিত কোনো চ’ক্রান্ত? ম্যাডামকে কি রাজনীতি থেকে মাইনাস করার চিন্তা করছে বিএনপি?

খালেদা জিয়ার প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেল এই ঘটনার সমালোচনা করে তার ফেসবুকে লিখেন, ‘ব্যানারে দলের শীর্ষ নেত্রী খালেদা জিয়ার নাম বা ছবি কোনোটাই ছিল না। এ নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে প্রশ্নের সঞ্চার হয়। এটাই স্বাভাবিক। কারণ সেই তথাকথিত এক-এগারোর ট্রমা থেকে বিএনপি এবং এই দলের নেতাকর্মীরা আজও মুক্ত হতে পারেনি।

ওই আঘা’ত বিএনপিকে যেভাবে পঙ্গু করেছে, সেই পঙ্গুত্ব নিয়ে আজও খুঁড়িয়ে চলছে দল। সেই আঘা’ত এসেছিল দলের বড় বড় নেতা এবং সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের কা’পুরুষোচিত ভ’য়ঙ্কর বিশ্বাসঘা’তকতায়। সেটা ছিল বিএনপির নেতৃত্ব থেকে খালেদা জিয়া ও জিয়া পরিবারকে জোর করে সম্পূর্ণ অ-গণতান্ত্রিক পন্থায় উচ্ছেদ করার অপচেষ্টা।

সেই ষড়’যন্ত্রের যারা দোসর হয়েছিলেন, তাদের প্রায় সকলকেই ক্ষমা করে ফিরিয়ে নিয়েছেন ম্যাডাম জিয়া। কিন্তু ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ডরায়, তেমনই বিএনপির নিবেদিত নেতাকর্মীরা সব সময় বাইরের আক্র’মণের পাশাপাশি ভেতরকার ষড়’যন্ত্রের ব্যাপারেও আত’ঙ্কে থাকেন।’

এদিকে ব্যানারে নাম ও ছবি না থাকায় অনুষ্ঠানেই সমালোচনা করেন একাধিক নেতা। সরাসরি না বললেও গণমাধ্যমকর্মী ও নিজেদের মধ্যে ক্ষো’ভ প্রকাশ করেন তারা। স্থায়ী কমিটির এক নেতা অবশ্য অবাক হননি জানিয়ে বলেন, আজকাল স্থায়ী কমিটির সভাতেই বিএনপি চেয়ারপারসনের বিষয়ে কোনো আলোচনা হয় না। তিনি যে এখনো ব’ন্দি আছেন, তাকে যে মুক্ত করতে হবে, সে বিষয়ে কারো কোনো আগ্রহ নেই।

তাই ওই অনুষ্ঠানে যেটি হয়েছে সেটি একদিনে না, দিনে দিনে নানাভাবেই ম্যাডামকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। তবে তিনি বিশ্বাস করেন খালেদা জিয়াকে মাইনাস করার কোনো কিছু চিন্তা করলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তা রুখে দিবে।

দলের একজন যুগ্ম মহাসচিব বলেন, সভা-সমাবেশে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে কঠোর ভাষায় কোনো বক্তব্য দিলে দলের সিনিয়র নেতারা ডেকে সতর্ক করে দেন। টকশোতে এ বিষয়ে কথা তুললে মানা করে দেয়া হয়। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, যার কারণে বিএনপি দেশের জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হয়েছে, আমাদের অনেককেই তিনি এমপি, মন্ত্রী বানিয়েছেন। যারা কোনোদিন ভাবেননি মেম্বার হবেন তাদেরকে তিনি কত বড় মর্যাদা দিয়েছেন। এখন তারাই কি-না ম্যাডামকে ভুলে যাচ্ছে।

আরেক যুগ্ম মহাসচিব ক্ষো’ভ প্রকাশ করে বলেন, ম্যাডাম গ্রেপ্তার হওয়ার পর দলের পক্ষ থেকে কয়েকদিন লোক দেখানে কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। কিন্তু তাকে মুক্ত করতে হলে কেমন আন্দোলন করা দরকার, সরকারকে চাপে রেখে কীভাবে ম্যাডামকে মুক্ত করা যাবে এ বিষয়ে কারো কোনো ভাবনা নেই। সবাই ভাবে, আমি তো বাইরে আছি, ম্যাডাম জেলে আছে তো কী হয়েছে? আমার ব্যবসা তো ভালো চলছে।

খালেদা জিয়ার ছবি-নাম কিছুই ব্যানারে নেই দেখে তাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ ও শ’ঙ্কিত হয়েছেন। তাদের সেই শ’ঙ্কা ও ক্ষো’ভ তারা প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ প্রশ্ন করেছেন, ম্যাডামকে নেতৃত্ব, দল ও রাজনীতি থেকে মাইনাস করার ব্যাপারে ক্ষমতাসীন মহল ও সীমান্তের বাইরের শক্তির পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ভেতর থেকে কেউ ফের চ’ক্রান্তের দোসর হয়েছে কি না!

স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় নেতা ইফতেখার সেলিম অগ্নি লিখেছেন, নেত্রী আপনার অশ্রু আমাদের যেমন কাঁদায়, তেমনি আপনাকে বাদ দিয়ে সার্বজনীনতার চেষ্টাও আমাদের কাঁদায়। কারণ আপনি দেশ, গণতন্ত্র এবং দলের জন্য নিবেদিত আপোসহীন। আপনি আমাদের প্রাণশক্তি। আপনার তর্জনির নির্দেশনা আমাদের আন্দোলিত করে। আমরা হয়ে উঠি আপনার মতো আপোসহীন বিদ্রোহী। নেত্রী আপনাকে বাদ দিয়ে কোনো সার্বজনীনতা আমরা মানি না।

ড. ওয়ালিদ হাসান পিকুল লিখেছেন, শহীদ জিয়াউর রহমান এবং খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তার জোরে আজও তৃণমূলে বিএনপি টিকে আছে, এই কথা জাতীয় নেতৃবৃন্দ ভুলে গেলে বিএনপি মওলানা ভাসানীর ন্যাপ বা মুসলিম লীগের অবস্থায় পতিত হবে। দুর্ভাগ্য শহীদ জিয়া আর খালেদা জিয়ার পা’গল ভক্তদের।

চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা দলের প্রচার সম্পাদক দেওয়ান লিটা লিখেছেন, ব্যানারে খালেদা জিয়ার ছবি না রাখাটা ভুল নয় বরং একটা দালালীর অংশ প্রমাণিত হয়েছে। খালেদা জিয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো অজুহাতই গ্রহণযোগ্য নয়।

সউদী আরব পশ্চিমাঞ্চলের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন সমন্বয় কমিটির সদস্য কাজী সুমন লিখেছেন, ১/১১’র সংস্কারবাদীরা এখনো সক্রিয়। এখন তো মনে হচ্ছে খালেদা জিয়াকে জেলে নেওয়ার রাস্তা তারাই তৈরি করেছে।

রফিকুল ইসলাম রফিক লিখেছেন, এটা ভুল নয়, এটা অ’ন্যায়, এটা অ’মার্জনীয় অপরাধ। আর দলের চেয়ারপারসনের প্রতি চরম অ’বজ্ঞার শামিল। আয়োজক বিএনপি আর দোহাই দেয় সার্বজনীনতার। আমরা যাতে ভুলে না যাই, দেশনেত্রী এখনো বেঁচে আছেন। আর আমাদের সমস্ত আবেগ, অনুভূতি, সম্মান আর ভালোবাসা তাকে ঘিরেই।

সালাহউদ্দিন সবুজ লিখেছেন, খালেদা জিয়ার জন্য সারা দেশের লাখ লাখ নিবেদিতকর্মী জেল, জু’লুম, বাড়ি-ব্যবসা নষ্ট করে আন্দোলনে আছে। আর মোনাফেকরা খালেদা জিয়ার নামে জালিয়াতি করছে, আবার ভুল করলে চামড়া থাকবে না।

অবশ্য স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ও বিএনপি চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, জিয়াউর রহমান মানেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বাংলাদেশ মানেই জিয়া। তাই স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে শুধু জিয়াকে ফোকাস করতে চেয়েছি।

এ কারণে দলীয় চেয়ারপারসনের ছবি ব্যবহার করা হয়নি। একই কারণে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ছবিও ব্যবহার করা হয়নি। তা ছাড়া এ কর্মসূচিকে আমরা সার্বজনীন করতে চেয়েছি, দলীয় নয়। এ কারণে জিয়ার ছবি ব্যবহার করেছি।

এ বক্তব্যের পর আব্দুস সালামের অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে তার ১/১১’র সময় ভূমিকার কারণে ষড়’যন্ত্রের সন্দেহের তীর তার এবং ওই সময়ের সংস্কারপন্থীদের দিকেই তাক করছেন নেতাকর্মীরা।

তারা বলছেন, সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন কমিটিতে এমন এক নেতা রয়েছেন ওয়ান-ইলেভেনে নিজে বিএনপির চেয়ারম্যান হতে চেয়েছিলেন। ওই নেতার নেতৃত্বে দল গঠনের লক্ষ্যে ৬০ নেতার নাম সংবলিত তালিকা তৎকালীন সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদের কাছে পাঠিয়ে ছিলেন। যে চিঠি পরবর্তী সময়ে ম্যাডাম (খালেদা জিয়া) হাতে কোনো মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু তিনি তো তাদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। আবার দলীয় কার্যালয়ের তালা ভেঙে ঢোকার অভিযোগ আব্দুস সালামের বিরু’দ্ধে। তাদের শ’ঙ্কা সেই ফর্মুলা নতুন করে শুরু হয়েছে। যেহেতু তারেক রহমান বাইরে, ম্যাডামও চিকিৎসার জন্য বাইরে- এ অবস্থায় ফাঁকা মাঠে বিশেষ কারণ দেখিয়ে সেই প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে বলে ওই নেতার ধারণা।

শেয়ার করুন !
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!