বিশেষ প্রতিবেদন:
জেলে অসুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে মা’রা যাওয়া আসামী মুশতাক আহমেদের কর্মকাণ্ড ও অতীত নিয়ে একে একে উঠে আসছে নানান বিষয়। বিশেষতঃ মুশতাকের আলোচিত কুমিরের খামার “রেপ্টাইলস ফার্ম লিমিটেড” এর মালিকানায় পলাতক পিকে হালদারের নাম আসায় অনেক বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ খামারটির উদ্যোক্তাদের একজন অ’বৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ী হিসেবে অভিযুক্ত ও মোবাইল কোম্পানি সিটিসেল এর বিত’র্কিত মালিক মিসবাহুল হক। মিসবাহর ভাগ্নে মুশতাকও ভিওআইপি ব্যবসায় জড়িত ছিলেন।
মুশতাকের প্রস্তাবনায় ২০০২ সালে কুমির খামার প্রতিষ্ঠার কর্মকাণ্ড শুরু হয়। ২০০৪-০৫ সালের মধ্যে সরকারি সকল কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। মাত্র ৮০ হাজার টাকায় কেনা জমিতে শুরু হয় এই খামার।
২০১০ সালে জার্মানিতে ৬৭টি কুমির রপ্তানি করার পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের ইইএফ ফান্ডের জন্য আবেদন করে রেপ্টাইলস ফার্ম লিমিটেড। যার মালিকানায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ, মিসবাহুল হকের ৩৬ শতাংশ এবং মুশতাক আহমেদের ১৫ শতাংশ শেয়ার ছিল। চেয়ারম্যান হন মিসবাহুল হক এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুশতাক।
বাংলাদেশ ব্যাংক এই ব্যবসায় ২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে। মুশতাকের পরিকল্পনার ভিত্তিতে হলেও মিসবাহ অল্প টাকা বিনিয়োগ করে সিংহভাগ শেয়ারের মালিক হন। ভবিষ্যতে শত কোটি টাকার প্রকল্পে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা- মূলত এ নিয়েই সমস্যার শুরু।
মুশতাকের অভিযোগ, কোম্পানির জমি মিসবাহর স্ত্রী মাহফুজা লুলুর নামে কেনা হয়েছে। অন্যদিকে মিসবাহ অভিযোগ তোলেন মুশতাক মা’দকাসক্ত এবং কোম্পানির বহু টাকা হাতিয়ে নিয়ে হিসাব দিচ্ছেন না। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভাউচার হারানোর একটি জিডিও করা হয়। বোর্ড মিটিং ডেকে মুশতাক ও তার অনুগত মফিজকে বহিষ্কা করেন মিসবাহ।
অন্যদিকে মুশতাকও বাংলাদেশ ব্যাংককে মিসবাহর বিরু’দ্ধে অভিযোগ জানান। এরপর নতুন বিনিয়োগকারীর সন্ধান করতে থাকেন।
বিভিন্ন মিডিয়ায় এই খামার নিয়ে ব্যাপকভাবে ইতিবাচক প্রচার পায়। মুশতাক ফার্মের অচলাবস্থার কথা বলে মিসবাহর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। এক পর্যায়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সমাধানের লক্ষ্যে বৈঠক আহ্বান করে।
পিকে হালদারের অন্তর্ভুক্তি:
নতুন বিনিয়োগে অনীহাসহ মামা-ভাগ্নের বিভিন্ন দ্বন্দ্ব ২০১২ সালে যুক্ত হন পিকে হালদার। মুশতাকের সর্বশেষ ভাষ্য অনুসারে, পিকে হালদারের অন্তর্ভুক্তিতে মিসবাহ জড়িত ছিলেন। মুশতাক তার ফেসবুকে লিখেছেন: (ফেব্রুয়ারি, ১৭, ২০২০)
“কুমিরের খামার এখন হায় হায় কোম্পানি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি আমি শেয়ার হস্তান্তর করবো, কিন্তু আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রেপ্টাইলস ফার্মের একটা রেজিস্ট্রেশন আছে, যেটা শুধু মাত্র আমার মাধ্যমেই বদলানো সম্ভব, সেটা আমি বদলাবো না। সেখানে আমার নাম ঠিকানা থাকায়, বিদেশ থেকে যারাই কুমিরের চামড়া বা মাংস কিনতে চায়- আমার সাথেই যোগাযোগ করে”।
আবার তিনিই লিখেছেন:
“রেজিস্ট্রেশনের কারণে কুমিরের চামড়ার ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ হয় না। আমি বন বিভাগে গিয়ে বলেছি, কোম্পানি আমরা বিক্রি করে দিয়েছি ২০১৩ সালে, এখনো আমার নাম ঠিকানা সেই আন্তর্জাতিক রেজিস্টারে, এটা কীভাবে সম্ভব? আমি নিজে সিএসজিকে জানানোর পর গতবছর অগাস্টে আমার নাম ঠিকানা সেখান থেকে বদলে বর্তমান এমডি রাজীব সোমের নাম দিয়েছে। ততদিনে প্রশান্তের শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে।
খামারটা যখন ছেড়ে এসেছিলাম, আট বছরের বেতন আমার বকেয়া ছিল।”
আসলেই কি মুশতাক ৮ বছর আগে ফার্ম ছেড়েছেন?
মুশতাক আরও লিখেছেন– ২০১৩ সালে ফার্ম বিক্রি করে দিলেও, সাইটিস রেজিস্ট্রিতে আমার নাম ঠিকানা তখনো আছে। কোম্পানির কোনো ওয়েবসাইটও নাই, একটা লুকোচুরি লুকোচুরি ভাব। বন বিভাগের সাথে দেখা করে জানালাম, কোম্পানি বিক্রি করে দিয়েছি ২০১৩ সালে, এখন এদের অফিস কোথায় আমি জানি না অথচ সাইটিস রেজিস্ট্রিতে আমার নাম ঠিকানা বলবত।
তখন জানলাম বাংলাদেশে কুমির চাষের নীতিমালা তৈরি হয়েছে। গত কয়েকদিন পত্রিকার হেডলাইন হয়েছে “প্রশান্ত কুমার হালদার ৩৫০০ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট”। তার করা দুর্নীতি একেবারে সিনেমার মতো। মাত্র ২ কোটি ৪২ লক্ষ টাকা ঋ’ণ নিয়ে কোম্পানি শুরু করে আমরা প্রথমবার রপ্তানি পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলাম, আর খবরে প্রকাশ পিকে হালদার এই কোম্পানির নামে ৬০ কোটি টাকা ঋ’ণ নিয়ে দৈনিক ১২০০ মুরগির ডিম বিক্রি করে। কিয়েক্টা অবস্থা।
মুশতাকের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য:
মুশতাক বলেছেন আন্তর্জাতিক সংগঠনে তার নাম থাকায় তা পরিবর্তন করা যাবে না। বিষয়টি মোটেও সঠিক নয়। আবার তিনিই বলেছেন লুকোচুরি ভাব, কোম্পানি বিক্রি করেছি ২০১৩ সালে, নাম পরিবর্তন হয়নি। মুশতাক আসলেই এত বছর ২০১৩ সালের পর বিচ্ছিন্ন ছিলেন কি না তার অগণিত তথ্য প্রমাণ মিডিয়ায় রয়েছে। কুমিরের ডিম বিক্রির সাফল্যের কথা মুশতাকই সাক্ষাতকারে বলেছিলেন।
১) ২০১১ সালে মিসবাহ ও মুশতাকের বক্তব্য সহ ভিডিও প্রতিবেদনটি এখানে রয়েছে।
২) ২০১৬ সালে দীপ্ত টেলিভিশনের দ্বীপ্ত কৃষিতে সফলভাবে কুমির চাষ ও সম্ভাবনার কথা বলছেন খামার সংশ্লিষ্টরা।
৩) ২০১৮ সালে ময়মনসিংহের কুমিরের খামার নিয়ে প্রতিবেদনে মুশতাক ডিম বিক্রিসহ রপ্তানি নিয়ে আশাবাদী হয়ে সাক্ষাতকার দিয়েছেন।
৪) ২০২০ সালে জাগোনিউজের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ভ্রমণপিপাসু মুশতাক ও মিসবাহুল হকের শুরু করা কুমির খামারের সম্ভাবনার কথা।
আসলে কী ঘটেছিল:
আর্থিক ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং নেতৃত্ব নিয়ে মুশতাক ও তার মামা মিসবাহর মধ্যে কিছু বিষয়ে বিরোধ ছিল তা অ’স্বীকার করা যাবে না। মিডিয়া যখনই এ বিষয়ে প্রতিবেদন করেছে তখনই মিসবাহ প্রতিবেদককে জানিয়েছে, মুশতাক তার বোনের ছেলে। তাই বিষয়টি সমাধান হয়ে যাবে।
কিন্তু মনোমালিন্য হলেও তারা কখনোই বিচ্ছিন্ন হননি। অনুসন্ধানে দেখা যায়, পিকে হালদার বাংলাদেশ ব্যাংকের ৪৯ শতাংশ শেয়ার ক্রয় করেছিল এবং তার মনোনীত রাজীব সোম ও যিশু রায়, মুশতাক ও মিসবাহর শেয়ারের অংশ ক্রয় করেছিল। তা সত্তেও মুশতাক দায়িত্ব পালন করেছে কোম্পানির হয়েই।
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন মুশতাক। গ্রেপ্তার হয়ে “সরকারের নির্দেশে গ্রেপ্তার” করা হয়েছিল বলে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছিলেন তিনি। জানা যায়, পিকে হালদারের সহযোগিতায় ৪ ঘন্টা পর মুক্তি পান তিনি।
এ ঘটনার পর মুশতাকের এক ভক্ত তার ফেসবুক পোস্টে কমেন্ট হিসেবে একটি ছড়া লিখেছিল যা তিনি তার ব্লগে শেয়ার করেছেন এবং সেটি এখনো রয়েছে। তিনি ৮০টি ইয়াবা নিয়ে ধরা পড়েছিলেন বলে গুঞ্জন উঠেছিল তখন।
মুশতাক-পিকে সমঝোতা:
এ ঘটনার পর মুশতাক, মিসবাহ ও পিকে হালদারের যাবতীয় মনোমালিন্য দূর হয়, তারা এক সাথে কাজ করতে শুরু করেন। খামার পরিচালনায় পরামর্শকের সম্পূর্ণ দায়িত্ব পান মুশতাক। ময়মনসিংহের রেপ্টাইলস ফার্মটি ব্যাংকবহির্ভূত আলোচিত আর্থিক প্রতিষ্ঠান এফএএস ফাইন্যান্সের অন্যতম মালিক হয়। এই এফএএস ফাইন্যান্স থেকেও নামে- বেনামে বিপুল অর্থ বের করে নিয়েছিলেন পিকে হালদার।
খামারটির সঙ্গে যুক্ত হন পিকের পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, কেএইচবি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাজীব সোম ও তীর স্ত্রী শিমু রায়। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে বিপুল পরিমাণ ঋ’ণ গ্রহণেও মুশতাকের সংশ্লিষ্টতা ছিল। এ কারণেই রেপ্টাইলস ফার্ম কেন্দ্রিক বিষয় নিয়ে মুশতাকই বিভিন্ন মিডিয়ায় কথা বলেছেন, বিদেশে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
মুশতাকের কাছে পিকে হালদারের কোনো বিষয়ই অজানা ছিল না, অজানা থাকা সম্ভবও নয়, কারণ পিকে হালদার যত ঋ’ণ নিয়েছেন তা মুশতাক- মিসবাহর সহযোগিতা ছাড়া অসম্ভব ছিল। এছাড়া খামারকেন্দ্রিক ট্যুরিজম ব্যবসা শুরু করেছিলেন মুশতাক। যেখানে তার একক মালিকানা ছিল। খামার পরিদর্শনের জন্য টিকেট বিক্রি করে ভালো অংকের টাকা পেতেন মুশতাক।
কুমির খামারই কি তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল?
অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রেপ্টাইলস ব্যাবসা নিষি’দ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে অর্থ পাচা’রকে কেন্দ্র করে।
বিষয়টি এভাবে হয়: কুমির আমদানিতে যত টাকা প্রকৃতপক্ষে ব্যয় হয়, তারচেয়ে বেশি মূল্য ধরা হয়। যেমন, আমদানি মূল্য ৩০ লাখ টাকা হলে সরকারকে ১ কোটি টাকা দেখানো হয়। ফলে ৩০ লাখের পাশাপাশি অ’বৈধ ৭০ লাখ টাকা বৈধ চ্যানেলে পাচা’র করা হয়।
অন্যদিকে রপ্তানির ক্ষেত্রে যে মূল্যে বাণিজ্য বিনিময় নির্ধারিত হয়, তা সরকারকে কম দেখানো হয়। যেমন, ১ কোটি টাকার কুমির রপ্তানি হলে মূল্য দেখানো হয় ৩০ লক্ষ টাকা। অবশিষ্ট ৭০ লক্ষ টাকা বিদেশের নির্দিষ্ট ব্যাংকে পেমেন্ট করতে বলা হয়।
পিকে হালদারের অর্থ পাচা’র ও খেলাপী ঋ’ণের জন্য দুদক যে ৬২ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তার একজন মুশতাক। মুশতাকের মামা মিসবাহুল হক আগে থেকেই ভিওআইপি ব্যবসার কারণে বিত’র্কিত ছিল। এছাড়া সিটিসেলে গ্রাহকদের বড় অংকের টাকা ও সরকারের ৫৩০ কোটি টাকার কর ফাঁকি দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমায়।
পিকে হালদারের গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়টি বোধহয় মুশতাকের চিন্তায় ছিল না। তাই রেপ্টাইলস ফার্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হননি মুশতাক। পিকে হালদারের অপকর্মের কথা জেনেই মুশতাক নিজেকে দায়মুক্ত রাখতে কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে দেন। তাই নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত চাষী পরিচয় দিতেন, আবার খামার সংশ্লিষ্ট ট্যুরিজম ব্যবসার কথাও তিনি আড়াল করেননি।
অন্যদিকে মিডিয়া বা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রে নিজেকে কোম্পানির সিইও হিসেবে পরিচয় দিয়ে গেছেন। মুশতাকের সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার অন্যতম কারণ পিকে হালদারের অপকর্ম প্রকাশ পেয়ে যাওয়া।
উল্লেখ্য, সরকারের বিরোধীতা করতে গিয়ে দেশবিরোধী একটি চক্রের সাথে হাত মেলান মুশতাক। আইএম বাংলাদেশি নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে যু’দ্ধাপরাধীদের বিচারের আগে থেকেই বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনাকে নোং’রামিপূর্ণ পোস্ট দেয়া হতো, একাত্তরের রাজাকারদের পক্ষে লেখালেখি করা হতো।
সেই পেজের এডমিন হিসেবে কিশোর এবং মুশতাক যোগ দেন যু’দ্ধাপরাধীদের লবিস্ট ডেভিড বার্গম্যান, সিআইএ’র ফান্ডে পত্রিকা চালানো তাসনিম খলিল, আল-জাজিরায় দেখানো প্র’তারক সামি, গুজব ছড়ানো ফটোগ্রাফার শহিদুলসহ আরও কয়েকজন কালপ্রিটের সাথে। যথাযথভাবে তদন্ত করলেই এসব বেরিয়ে আসবে।