বেছে বেছে মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনা ভেঙেছে হেফাজত-জামায়াত মিলে

0

সময় এখন ডেস্ক:

ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের তিন দিনের বিক্ষোভ আর হরতালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মুক্তিযুদ্ধের স্মারক সব স্থাপনায় হাম’লা চালানো হয়েছে। ভা’ঙচুর করা হয়েছে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলকও। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কার্যালয়েও দেয়া হয়েছে আগুন।

হাম’লাকারীরা মাদ্রাসা থেকে মিছিল বের করার সময় পাত্রে করে পেট্রল নিয়ে গেছে। সঙ্গে ছিল হাতুড়িসহ দেশীয় নানা অ’স্ত্রশস্ত্র। যেখানেই তারা গেছে, চালানো হয়েছে ভা’ঙচুর, সেই পেট্রল ঢেলে দেয়া হয়েছে আগুন। আর এ কাজে তাদের উপযুক্ত সহযোগিতা দিয়েছে যু’দ্ধাপরাধী সংগঠন জামায়াত ও শিবিরের ক্যাডাররা।

এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সামাজিক আন্দোলনের কর্মীরা ভীষণ ক্ষুব্ধ। তারা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্থানি বাহিনীকে সহযোগিতা করে আসা এই শক্তি এখনও তাদের অবস্থান পাল্টায়নি। এই ঘটনাই তার প্রমাণ।

১৯৭১ সালে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলের মধ্যে সবচেয়ে বড় নেজামে ইসলামসহ অন্যরাও পাকিস্থানের দালালি করেছে। ইদানীং এসব সংগঠনের নেতারা সেসব ভূমিকা অস্বীকার করে দাবি করে আসছে, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ছিল।

তবে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বাবা শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের ৯০ দশকে দেয়া একটি সাক্ষাৎকার সম্প্রতি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘৭১-এ আমগো অবস্থান ছিলো নিরপেক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে।’

শুক্রবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কান্দিপাড়া এলাকার জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া মাদ্রাসা থেকে কয়েক হাজার ছাত্রের মিছিল বের হয়। সাথে জুটে যায় যথারীতি জামায়াত শিবিরের ক্যাডাররা।

তারা শহরের কেন্দ্রস্থল বঙ্গবন্ধু স্কয়ারে গিয়ে হামলে পড়ে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালে। সেখানে ভা’ঙচুর করে পেট্রল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এতে ম্যুরালটির বেশ ক্ষ’তি হয়েছে।

রোববারও হাম’লা হয় একই ম্যুরালে। এবারও হাতুড়ি পেটা করে সেখানে পেট্রল ঢেলে আগুন দেয়া হয়। এখানেও্র দেখা গেছে শিবিরকর্মীদের।

শনিবার বিকেল পর্যন্ত পরিস্থিতি ছিল শান্ত। বিকেলে ওই মাদ্রাসারা সামনে দিয়ে আওয়ামী লীগের একটি মিছিল যাওয়াকে কেন্দ্র করে তারা বের হয়ে জড়ায় সংঘ’র্ষে। পরে পুলিশের সঙ্গে সংঘ’র্ষ বাধে নন্দনপুর এলাকায়।

রোববার হরতালের দিন সকালে একই মাদ্রাসা থেকে মিছিল বের হয়। পরে আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকেও হেফাজত ও জামায়াত শিবিরের সমর্থকরা এসে যোগ দেয় তাদের সঙ্গে।

বিকেল পর্যন্ত শুক্রবারের মতোই বিভিন্ন সরকারি স্থাপনার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন এবং মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যালয়ে তারা বিনা উসকানিতে হাম’লে পড়ে। কেবল এবার নয়, এর আগেও নানা সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একই চিত্র দেখা গেছে।

মুক্তিযুদ্ধের একটি স্থাপনাও বাদ যায়নি

বিভিন্ন যানবাহনে হাম’লা শেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর আধুনিক সুপার মার্কেটের সামনে যায় মৌলবাদী গোষ্ঠী। সেখানে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরও একটি ম্যুরালে লা’ঠি ও হাতুড়ি দিয়ে ভা’ঙচুর চালায় হেফাজাত এবং জামায়াত শিবির।

এরপর হেফাজত সমর্থকরা যায় পাশের ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে। সেখানে গত দুই দিন ধরে চলছিল উন্নয়ন মেলা। তবে হরতালের কারণে স্টলগুলো বন্ধ ছিল।

তারা সেখানে স্টলগুলো ভা’ঙচুরের পাশাপাশি ধরিয়ে দেয় আগুন। চত্বর মঞ্চে যেখানে নানা সময় জাতীয় ‍দিবসের অনুষ্ঠানমালা ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করা হয়, সেখানে পেট্রল ঢেলে দেয়া হয় আগুন।

বাঙালির মুক্তি সংগ্রামে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম বরাবর শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। পাকিস্থান আমলে এই নেতাই প্রথম বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে পাকিস্থান গণপরিষদে দাবি তোলেন।

১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ওই দাবি তোলা এই রাজনীতিক বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনেও রাখেন ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তাকে ধরে নিয়ে হ’ত্যা করে পাকিস্থানি বাহিনী। যুদ্ধ শেষে এই সংগ্রামীর স্মরণে জেলার বিভিন্ন সড়কসহ এই ভাষা চত্বরটি তৈরি করা হয়।

এটি ভা’ঙচুর শেষে হাম’লাকারীরা যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আল মামুন সরকারের কার্যালয়ে। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। ওই কার্যালয়েও ব্যাপক ভা’ঙচুর করে পেট্রল ঢেলে আগুন দেয়া হয়। হেফাজত ও জামায়াত শিবিরের কর্মীদের বাধা দেয়ার মতো কোনো পরিস্থিতিই ছিল না।

এখানে ভা’ঙচুর শেষে তারা যায় একই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনে। সেটি ছিল তালাবদ্ধ। সেখানে ইটপাটকেল দিয়ে ঢিল ছোড়া হয় ফাঁকা সেই ভবনে। এতে ভবনের জানলার কাচগুলো ভেঙে যায়।

সেখান থেকে এই মৌলবাদী গোষ্ঠী যায় শহরের কাউতলী এলাকায়। সেখানে আছে শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামফলক। হাতুড়ি দিয়ে সেই ফলকও ভা’ঙচুর করা হয়।

এরপর তারা যায় শহরের কুমারশীল মোড়ে। সেখানে হাম’লা চালানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি গণ গ্রন্থাগারে। ভবনের জানলার কাচ ভা’ঙচুরের পাশাপাশি গ্রন্থাগারের ভেতরে পেট্রলের বোতল ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এতে পুড়ে যায় বইয়ের বেশির ভাগ।

এই জ’ঙ্গিরা সেসব ভা’ঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিশ্ব বিখ্যাত ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতিবিজড়িত দুটি স্থাপনা।

শহরের কুমারশীল এলাকায় সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনে গিয়ে তারা ভা’ঙচুরের পাশাপাশি ধরিয়ে দেয় আগুন। পুড়ে যায় আলাউদ্দিন খাঁর ব্যবহৃত গামছা, নামাজের বিছানা, তবলাসহ নানা ঐতিহাসিক জিনিসপত্র।

এই সঙ্গীতাঙ্গনে বছর কয়েক আগেও ব্যাপক হাম’লা চালিয়েছিল মৌলবাদীরা। তখনও বাংলাদেশের অন্যতম সেরা এই সঙ্গীতজ্ঞের নানা স্মৃতি নষ্ট হয়ে যায়।

প্রতিষ্ঠানটিতে দ্বিতীয় দফা হাম’লা চালানোর পাশাপাশি এই জ’ঙ্গিগোষ্ঠী ভা’ঙচুর করে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মিলনায়তনেও। পৌরসভার পাশে এই মিলনায়তনে নানা সাংস্কৃতির অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। সেখানে গিয়ে পাঁচ থেকে ছয় শ চেয়ার ছাড়াও মঞ্চে ভা’ঙচুর করে আগুন দেয়া হয়।

বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত তা’ণ্ডব চালানোর পর মাইকে ‘কর্মসূচি’ শেষ ঘোষণা করে স্ব স্ব অবস্থানে ফিরে যায় মৌলবাদীরা।

বিরূপ প্রতিক্রিয়া

হেফাজত ও জামায়াত শিবিরের কর্মীদের এই ধ্বং’সযজ্ঞে ভীষণ ক্ষুব্ধ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের জন্য অ’স্ত্র তুলে নেয়া বীর রতন কান্তি দত্ত।

তিনি বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তিযুদ্ধের একটি অন্যতম স্থান। এখানে মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিবিজড়িত অনেক কিছুই আছে। বারবার তারা এগুলোতে হাম’লা চালায়। আমি তাদের তা’ণ্ডবের তীব্র নি’ন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।

শহীদ ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ভাষা চত্বরে হাম’লার সমালোচনা করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক স্বপন মিয়া বলেন, বাংলা ভাষা রক্ষায় শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রয়েছে অতুলনীয় ভূমিকা। যারা আজ এ কাজ করেছে তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নয়। এটা তারা অতীতেও বারবার প্রমাণ দিয়েছে, আজও দিয়েছে।

জেলা মুক্তিযোদ্ধ সংসদের সাবেক কমান্ডার হারুন অর রশিদ বলেন, যদি তারা মনে-প্রাণে মুক্তিযুদ্ধকে লালন করত, তাহলে এভাবে ধ্বং’সযজ্ঞ চালাত না।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আল মামুন সরকার বলেন, হাম’লার ধরণ দেখে বোঝা যায়, তারা ইচ্ছা করেই এই স্থাপনাগুলোতে হাম’লা করেছে। তারা মূলত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আগুন দিয়েছে।

তিনি বলেন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলার গৌরব। তাঁর নামেই শহরের মূল ফটকে ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ভাষা চত্বর তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সকল সভা ও অনুষ্ঠান করা হয়।

কাউতলীর শহীদদের নামফলক, বঙ্গবন্ধ ম্যুরাল ভা’ঙচুর করা হয়েছে, গণগ্রন্থাগার যেখানে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অনেক বই রয়েছে, পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বইগুলো অভাবে মুক্তিযুদ্ধের অনেক ইতিহাস থেকে ব’ঞ্চিত হবে নতুন প্রজন্ম।

শেয়ার করুন !
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!