মুক্তমঞ্চ ডেস্ক:
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এ বছর ব্যাপক আড়ম্বরের প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও করোনার কারণে সীমিত অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে উদযাপন করা হয়। অনুষ্ঠানমালাকে কেন্দ্র করে গোটা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের মূল আকর্ষণের কেন্দ্র ছিল বাংলাদেশ।
এই অনুষ্ঠানে সার্কভুক্ত (পাকিস্থান বাদে) দেশের সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানরা স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশের অর্জনের ভূয়সী প্রশংসা করে বক্তব্য রেখেছেন। আর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সরকারপ্রধানরা, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি যারা স্বশরীরে উপস্থিত হতে পারেননি তারা ভিডিও-বার্তার মাধ্যমে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন।
১৭ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত ১০ দিনব্যাপী আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে শুধু দেশি-বিদেশি আমন্ত্রিত অতিথিরা অংশগ্রহণ করলেও গনমাধ্যমের সাহায্যে উৎসবের ঢেউ দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
‘মুজিব চিরন্তন’ অনুষ্ঠানে ১৭ মার্চ প্রথম যোগ দিয়ে মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মোহম্মদ সলিহ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপসহীন নেতা। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় নেতা। কার্যত ৭ মার্চের ভাষণেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলে।’
তিনি করোনাকালে বাংলাদেশ যে ওষুধ ও খাদ্য সহায়তা দিয়েছে তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তারপর ধারাবাহিকভাবে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ও ভারতের রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান অংশগ্রহণ করেন।
শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে অনুসরণ করেই বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছেন’।
নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও উন্নতি ঘটেছে এবং বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন দেখে মিত্ররাষ্ট্র হিসেবে নেপাল অত্যন্ত আনন্দিত।’
ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বলেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, অন্যকে বলার মতো একটি গল্প প্রত্যেক মানুষ ও জাতির অবশ্যই থাকা উচিত। বিশ্বের সব মানুষকে বলার মতো একটি চমৎকার গল্প বাংলাদেশকে দিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশ আমার কাছে দ্বিতীয় জন্মভূমি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমার মাতৃতুল্য।’
অনুষ্ঠানমালার শেষদিনে সম্মানিত অতিথি ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর সেদিন বিশ্বের পরাশক্তি রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের ভিডিও বার্তার বক্তব্যের মাধ্যমে প্যারেড গ্রাউন্ড বিশ্বমঞ্চে পরিণত হয়েছিল।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে দেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন,
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ও পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ভিডিও বার্তা দেখানো হয়।
অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে যৌথ অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের কাছেই গণতন্ত্রের শক্তি আছে, এগিয়ে যাওয়ার দূরদর্শিতা রয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ অগ্রযাত্রা এই পুরো অঞ্চলের জন্য সমান জরুরি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি আনন্দিত যে, শেখ হাসিনাজির নেতৃত্ব বিশ্বে বাংলাদেশ তার সক্ষমতা প্রদর্শন করছে। যারা বাংলাদেশ গঠনে আপত্তি করেছিলেন, যারা এখানকার মানুষকে নীচু চোখে দেখতেন, যারা বাংলাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, বাংলাদেশ তাদের ভুল প্রমাণ করেছে’।
ভিডিও বার্তায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস বলেন, ‘গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ সামাজিক উন্নয়ন ও দুর্যোগ মোকাবেলা ও প্রস্তুতির বিষয়ে অসাধ্য সাধন করেছে। নিম্ন আয়ের দেশের তালিকা থেকেও বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন ধরে রেখে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও অবদান রেখে চলেছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক অগ্রগতির এক দৃষ্টান্ত; উচ্চাশা ও সুযোগের এক দেশ।’ ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়াকে বিশ্বের সামনে ‘বাংলাদেশের মানবিকতা ও উদারতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত’ হিসেবে তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, ‘বাংলাদেশ তুখোড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীও উদযাপন করছে। বাংলাদেশে ও রাশিয়ার সম্পর্ক সব সময় বন্ধুত্বপূর্ণ। আমি বিশ্বাস করি আমাদের যৌথ উদ্যোগে ভবিষ্যতের গঠনমূলক দ্বি-পক্ষীয় সহযোগিতা দুই দেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষা, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় ভূমিকা রাখবে।’
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছেন, ‘এ সময়ে দুই দেশই উন্নয়নের মাধ্যমে একটি নতুন পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। চীনের নবতর পর্যায়ে উত্তরণের যে স্বপ্ন, তার সঙ্গে মেলবন্ধন হতে পারে সোনার বাংলার স্বপ্নের। সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে যে স্বপ্নের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ, তার বাস্তব রূপায়ণে সারথি হবে চীন।’
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা বলেন, আমি শুনেছি যে বাংলাদেশের পতাকার নকশায় জাপানের পতাকার সঙ্গে মিল থাকার ব্যাপারটি বঙ্গবন্ধুর আইডিয়া ছিল। আর আমরা যে ভ্রাতৃপ্রতিম, এটা তারই বহিঃপ্রকাশ।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, ‘আমি যখন প্রথমবার বাবার সঙ্গে বাংলাদেশ সফর করি সে সময় বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। গত ৫০ বছরে এ দেশ ব্যাপক উন্নতি করেছে। অর্থনৈতিক উন্নতি, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উন্নতির মতো বিষয়গুলো এ দেশের মানুষের সামনে নতুন সম্ভাবনা এনে দিয়েছে।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী, মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আপনাকে এবং বাংলাদেশের ভ্রাতৃপ্রতীম নাগরিকদেরকে আমার পক্ষ থেকে এবং তুরস্কের জনগণের পক্ষ থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। বাঙালি জাতির জন্য সারা জীবনের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়কদের কাতারে নিয়ে গেছে।’
ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি গভীর বন্ধুত্বের ও সৌহার্দ্যের। এই সম্পর্কের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ৫০ বছর আগের মতোই অটুট আছে।’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, ‘৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। জন্মের সময়ের অবস্থা থেকে আপনাদের জাতির অর্জন, তা অভিভূত হওয়ার মতো।’
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ের কথা স্মরণ করেছেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী বলেন, ‘ইন্দিরা গান্ধীর পাশে থেকে ১৯৭১ সালে রূপান্তরের সেসব ঘণ্টা, দিন, সপ্তাহ ও মাসের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে শেখ হাসিনা ও তার দেশের মানুষের গর্বের অংশীদার হতে পেরে আমি আনন্দিত।’
আর্চবিশপ পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, ‘এমন বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রজ্ঞার ফসল। অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আধুনিক দেশ বাংলাদেশ, সোনার বাংলা, যেখানে ভিন্ন ঐতিহ্য ও সম্প্রদায়ের মানুষ ভাষা ও সংস্কৃতির ঐকতানে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা বাংলাদেশিদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকারের একটি।’
জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থার (ইউনেস্কো) মহাপরিচালক অড্রে অ্যাজুলাই বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণের পথ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাষণে বৈশ্বিক মানবাধিকার ও মর্যাদার মূল্যবোধও প্রতিফলিত হয়েছে।’
এছাড়া আরও যারা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন- কম্বোডিয়ার প্রেসিডেন্ট নরাদম সিহামনি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী চুং সেয় কিউন,
ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, জার্মানির প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টেইনমের, ইতালির প্রেসিডেন্ট সার্জিও মেটারেলা, সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট খালিফা বিন জাইয়িদ আল নাহিয়ান, স্পেনের রাজা ষষ্ঠ ফেলিপে, ওআইসির মহাসচিব ড. ইউসেফ আল ওথাইমীনিসহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
এছাড়াও ফিলিস্তিন, ইউক্রেন, মঙ্গোলিয়া, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, কিউবা, মিশর, জর্জিয়া, ইথিওপিয়া, পোল্যান্ড, এস্থোনিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, সুইস ফেডারেশন, চেক রিপাবলিক, অস্ট্রিয়া, জাম্বিয়ার রাষ্ট্রপতিরাও শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন।
জাপানের সম্রাট, মরোক্কো, সুইডেন, বেলজিয়াম, স্পেন ও মালয়েশিয়ায় রাজা, ব্রুনাইয়ের সুলতান, কাতারের আমির লিখিত অভিনন্দন পাঠিয়েছেন।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী একই সময়ে হওয়ায় উৎসবে এসেছে ভিন্ন মাত্রা। অনুষ্ঠানের মাত্র কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ জাতিসংঘ কর্তৃক চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্ত হলো স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। এর চেয়ে গৌরবের আর কী হতে পারে?
বিশ্ব নেতারা বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বকে যেমন স্মরণ করেছেন, তেমনি জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব, দারিদ্র্য জয় ও সন্ত্রা’সবাদের বিরু’দ্ধে ল’ড়াইয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেরও প্রশংসা করেছেন।
সর্বোপরি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ভূয়সী প্রশংসায় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে অবিরাম সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছে প্রিয় বাংলাদেশ।
লেখক: তাপস হালদার
সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।