একটি মানবিক বিয়ের পেছনের ‘অ-মানবিক’ গল্প!

0

অনলাইন ডেস্ক:

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের একটি রিসোর্টে গত শনিবার হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক একজন বেগানা নারীসহ স্থানীয় লোকজন, ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে আটক হন।

যদিও মামুনুল হক সঙ্গে থাকা নারীকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী বলে দাবি করেন। পরে তার নিজের ফোনালাপেই জানা যায়, উক্ত নারী ফরিদপুরের জনৈক শহীদুল ইসলামের স্ত্রী এবং পরিস্থিতির কারণে তাকে নিজের স্ত্রী এবং ভুয়া নাম বলতে বাধ্য হন।

এরপরদিন মামুনুল হক ফেসবুক লাইভে এসে পুরো ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে নিজের আব্রু রক্ষার্থে একটি গল্প তৈরী করেন। তাতে দাবি করেন, ওই নারীকে ‘মানবিক’ কারণে বিয়ে করেছেন বলে। সেখানে ‘একটি মানবিক বিয়ের গল্প’ শিরোনামে লিখেছেন বিস্তারিত।

মামুনুল বলেন- হাফেজ শহীদুল ইসলাম আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের একজন। সাংগঠনিক কাজে দু-চারজন বিশ্বস্ত সহযোগীর অন্যতম। বেশ পুরনো সম্পর্ক। যার গভীরতা পারিবারিক পরিধি পর্যন্ত। পরিবারসহ একে অপরের বাসায় যাতায়াত দীর্ঘদিনের। সেই সূত্রে শহিদুলের পারিবারিক অভিভাবকত্ব করতাম আমি। পারিবারিক সকল বিষয়ে পরামর্শ দিতাম। দুই সন্তানের ছোট সংসার নিয়ে চলছিল তাদের জীবন। এক পর্যায়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে শুরু হয় মনোমালিন্য।

সেই থেকে বাদা’নুবাদ এবং সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু। আজ থেকে ৩ বছর আগের কথা। তখন তাদের সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি আমি। তাদের উভয়ের সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু কোনোভাবেই আর সেটি সম্ভব হয়নি। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাদের। ছাড়াছাড়ির পর দ্বিতীয় সংসার শুরু করেন হাফেজ শহীদুল ইসলাম।

সেই বিবাহ আমি পড়াই। তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে সুখে-শান্তিতে দিনাতিপাত করছেন। সেই ঘরে জন্ম নিয়েছে ফুটফুটে আরেকটি সন্তান। অপরদিকে হাফেজ শহীদ ভাইয়ের স্ত্রী হয়ে যায় অনেকটা অ’সহায়।

এক রকমের কুলকিনারাহীন। রাগের মাথায় সংসার ভেঙে গভীর সংকটে পড়ে যান তিনি। ওই পরিস্থিতিতে তার জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি আমার শরণাপন্ন হন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ নেন। আর সেই দুঃসময়ে সহযোগিতা করার মতো আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না তার।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ এবং অভিভাবকত্বের জায়গা থেকে আমি তার অর্থনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করি। জীবনের করণীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনার জন্য নিয়মিতই আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে হয় তাকে। এমতাবস্থায় একজন বেগানা নারীর সঙ্গে এভাবে সম্পর্ক রাখাকে শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার কাছে ঝুঁ’কিপূর্ণ মনে হয়।

তখন আমি সিদ্ধান্ত নিই, যত দিন তার অভিভাবকত্বের প্রয়োজন হবে আমার, তাকে বেগানা হিসেবে রেখে অভিভাবকত্ব করব না, বরং ইসলামী শরিয়তের আলোকে বৈধ একটা সম্পর্ক তৈরি করে নেব। বিষয়টি নিয়ে ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে কথা বলি। এ বিষয়ে তাদেরকে জানিয়ে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী বিবাহের কালেমা পড়ে বিবাহ করে নিই।

২ বছর যাবত এভাবেই মানবিক ও ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে আমি তার অভিভাবকত্ব করছি এবং একজন অ’সহায় নারীর দায়িত্ব গ্রহণ করে একটি পুণ্যের কাজ করেছি বলে বিশ্বাস করি। আমি যা বললাম, এটা আল্লাহর নামে হাজারবার শপথ করে বলতে পারব। বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য কুল্লামার শপথও করতে পারি।

তবে ঘটনার পর প্রায় এক ডজন অডিও-ভিডিওর প্রকাশ হওয়ার কারণে প্রকাশ্যে এসেছে হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হকের অ’নেতিক কর্ম। তার ‘মানবিক বিয়ে’ গল্পের অসারতাও প্রমাণিত হয়েছে।

রবিবার মামুনুল হকের নকল স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা ও তার আসল ছেলের কথোপকথনের একটি অডিও ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে মামুনুল হক সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শোনা যায় ছেলে আব্দুর রহমানকে। আব্দুর রহমান তার ছোট ভাই তামীমকে নিয়ে বাবার সঙ্গে খুলনায় বাস করে বলে জানা গেছে।

আব্দুর রহমান ভিডিওতে বলেন- আমি তো অলরেডি বড় হয়ে গেছি। অনেক কিছু শিখছি, অনেক কিছু জানছি। একটু ম্যাচিওরড একটা ভাব আইছে। আমি কিছুটা সহ্য করে নিতে পারি। কিন্তু আমার তো একটা ছোটভাই আছে। ১৩-১৪ বছর বয়স। কেবলই উঠতি বয়স। এ সময় মানুষের কত কথা শোনা লাগতিছে। সমাজের সামনে সে মুখ দেখাইতে পারতেছে না।

আমার ছোট ভাইটা (তামীম) কালকে রাতে, কাল (৩ এপ্রিল) যখন এ ঘটনাটা ঘটলো, আমি কোনোদিন দেখি নাই সে রাত ৩টা-৪টা পর্যন্ত জাইগা রইছে। কাইলকে তার চোখে কোনো ঘুমই নাই। টোটালি ওইটা নিয়ে ও মনে হচ্ছে মেন্টালি শকড। শক খাইছে। ও বাসা থেকে বেরোয় গেছে- যে আমি বাসায় থাকলে কী উল্টাপাল্টা করব, আমি নিজেও জানি না। এ কারণেই বেরোয় গেছে।

আরও বলতে হয়, এটা আমি বলব যে আমার বাবার কর্মফল। আমার বাবা মানুষকে অন্ধের মত বিশ্বাস করে, ভালোবাসে। ওই লোকটা (মামুনুল হক) কিছুদিন আগে মোংলার একটা মাহফিল ছিল। সেখানে পুলিশ তারে মাহফিল করতে দেবে না, সে একটা জায়গায় লুকাইছে। আমার বাবা সেটা দেখে এসে কীভাবে যে কানছে!

তার আগে আমি বিষয়টা জানছি যে, আমার মায়ের সাথে তার একটা সম্পর্ক আছে। আমি তখন- আমি তখন হাসতেছিলাম যে, এই লোকটা (বাবা) তার (মামুনুল) জন্য পা’গলের মত কানতেছে, এভাবে অঝোর ধারায় কানতেছে, আর ওই লোকটা (মামুনুল) এই লোকটার (বাবা) সাথে বেইমানি করতেছে!

তারপরে ওনাকে (মামুনুল) যখন জেলে (থানায়) নিলো, তখন আমার বাবা বলেছিল পুলিশের থানার ওসি কামরুজ্জামানরে, যে- তুমি আমাকে রাইখে ওই লোকরে (মামুনুল) ছাইড়ে দাও। কতটা ভালোবাসলে মানুষ এই কথাটা বলতে পারে! আর সেই লোকটা এভাবে গাদ্দারি করল!

আরও আগের ঘটনা, যখন ডিভোর্স হয়নি, আমি সে সময় অনেকটা ছোট, আমার ছোটভাই তখন আরও অনেকটা ছোট, ও দুগ্ধপোষ্য শিশু ছিল। তখন আমার বাবা একবার বাসায় ছিলেন না, তখন শুধু আমি ছিলাম। আমি ঘুমায় ছিলাম। তখন আমার মা আমার ছোটভাইকে দুগ্ধপান করাচ্ছিলেন। তখন উনি (মামুনুল) আমার মায়ের রুমে হুট করে ঢুকে যায় একটা কু-প্রস্তাব দিয়েছিল।

কিন্তু আমার মা সেটা প্র’ত্যাখ্যান করেছিল- না, এটা তো সম্ভব না, আপনি তো তাকে ঠকাচ্ছেন, আপনার কাছের বন্ধুকে (আব্দুর রহমানের বাবা)। সে (মামুনুল) তখন ফিরে এসেছিল। কিন্তু তখন থেকেই তার মনের ভেতর একটা কা’মুকভাব ঢুকে গেছিল। সে লোভ সামলাইতে পারতেছিল না। সে সব কিছুর জন্য সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে, সে এটা বুঝতে পারেনি।

যখনই সে সুযোগ পাইছে, এনাদের (বাবা-মা) মধ্যে ডিস্ট্যান্স বাড়িয়ে দিছে। অ’বিশ্বাস- স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝ’গড়া তো হবেই। সে (মামুনুল) তখনই নক করছে। তখনই দুইজনের মধ্যে আরও ডিস্ট্যান্স বাড়িয়ে দিছে।

এইভাবে করে সে একটা পরিবারের খুশি, ভালোবাসা, একটা পরিবারের মধ্যে যে মিলমিশ, একটা সম্পর্ক- পুরোপুরি সে (মামুনুল) ধ্বং’স করে দিছে। আরও যে এভাবে কত মানুষের পরিবারের কত ভালোবাসা যে সে ধ্বং’স করছে, এর কোনো ঠিক নাই।

এখানে আমি আশা করব, আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে আশা করব, এর যেন সঠিক বিচার হয়। আপনারা কারো অন্ধভক্ত হইয়েন না। কাউকে অন্ধভাবে বিশ্বাস কইরেন না। কারণ, সবারই মুখোশের আড়ালে একটা চেহারা থাকে।

এই লোকটা (মামুনুল) একেবারে আলেম নামধারী এক মুখোশধারী একটা জা’নোয়ার। এর মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ব নাই। এ সুযোগের অপেক্ষায় থাকে সব সময়। কাকে কীভাবে দুর্বল করা যায়। আমার আর কিছু বলার মত ভাষা আর নাই।

এছাড়াও মামুনুল যে ওই নারীকে যে স্ত্রী হিসেবে দাবি করেছিলেন, সেই দাবিও মিথ্যা প্রমাণ হয়ে যায় মামুনুল হকের বোন ও তার প্রথম স্ত্রীর মধ্যকার কথোপকথনের আরেকটি অডিও প্রকাশের মাধ্যমে।

ওই অডিওতে মামুনুল হকের বড় বোন মামুনুল হকের স্ত্রীকে বিষয়টি নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে শিখিয়ে দেন, কেউ ফোন করলে কী বলতে হবে। মামুনুল হকের বোনকে বলতে শোনা যায়, ‘তুমি বলবা আমার শাশুড়ি বেঁচে থাকতেই এই বিয়ে হয়েছে। আমার এতে সম্মতি ছিল। আমরা পরিবারের লোকজন সবাই তোমার সঙ্গে আছি। ঝামেলা একটু শেষ হোক।’

মামুনুলকাণ্ডে চাপের মুখে থাকা হেফাজতের দুই নেতার কথোপকথনের আরও এককটি অডিও প্রকাশ হয়েছে সোমবার। ওই অডিওতে মাওলানা ফজলুল করিম কাসেমী ও ফয়সাল আহমেদ নামে হেফাজতের দুই নেতা মামুনুল হকের কর্মকাণ্ডকে ভুল আখ্যায়িত করে যে কোনও মূল্যে তাদের অবস্থান শক্ত করে ধরে রাখার আলাপ করেন।

নারীসঙ্গী নিয়ে রিসোর্টে যাওয়া মামুনুল হকের অদূরদর্শিতা আখ্যায়িত করে ওই নেতা মামুনুল হককে কিছু নসিহত করতে বলে আলোচনা করেন। মামুনুল হক এবং ওই নারীকে বছিলার একটি ফ্ল্যাটে রাখা হয়েছে জানিয়ে তারা আগে হেফাজতের ‘মান’ বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নেন।

মামুনুল হকের কর্মকাণ্ডে দুই হেফাজত নেতা ক্ষোভ প্রকাশও করেন।

শেয়ার করুন !
  • 288
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!