সময় এখন ডেস্ক:
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে রয়্যাল রিসোর্টের ঘটনাপ্রবাহের পর হেফাজত নেতা মামুনুল হক তার মোহাম্মদপুরের বাসায় ফেরেননি বলে জানিয়েছেন বাসার সিকিউরিটি গার্ড।
নারায়ণগঞ্জের রিসোর্ট কাণ্ড ফেসবুকে লাইভ শুরু হওয়ার পর সন্তানসহ সেই বাসা থেকে বের হয়ে যান তার ৪ সন্তানের জননী- আসল স্ত্রী আমেনা তৈয়্যবা, তারাও বাসায় ফেরেননি এখনও।
এদিকে মামুনুলের রিসোর্ট সঙ্গীনির খোঁজও মিলছে না। তিনি মোহাম্মদপুরের একটি বিউটি পার্লারে কাজ করেন বলে বিষয়টির খোঁজ খবর রাখা নারায়ণগঞ্জ পুলিশের একজন কর্মকর্তার কাছ থেকে তথ্য মিলেছে। তবে সেই নারীর অবস্থান এখন কোথায়, সেটি জানতে পারেননি তিনিও।
মোহাম্মদপুরে যে মাদ্রাসায় মামুনুল হক শিক্ষকতা করেন, সেখানে তিনি গেছেন বলে দাবি করেছেন তার দল খেলাফত মজলিসের এক নেতা। যদিও সেই মাদ্রাসার দারোয়ান বলেছেন উল্টো কথা।
মামুনুল ঢাকায় থাকেন মোহাম্মদপুরের কাদেরাবাদ হাউজিংয়ের ১ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে। সেটির নিরাপত্তা কর্মী ইকবাল হোসেন বলেন, মামুনুল হক ওই দিনের ঘটনার পর আর বাসায় আসেননি। উনি বাসায় নেই।
তিনি এখন কোথায় আছেন- এমন প্রশ্নে ইকবাল বলেন, আমি জানি না। আমি গার্ড, আমি এত কিছু বলতে পারব না।
শনিবার রিসোর্টে যাওয়ার দিন সকালে মামুনুল এই বাসা থেকে বের হন একা। রিসোর্টকাণ্ড লাইভ শুরু হওয়ার পর তার ছেলেদেরকে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান তার আসল স্ত্রী আমেনা তৈয়্যবা। রিসোর্টকাণ্ডের পর স্ত্রী ও ছেলেরাও বাসায় ফেরেননি বলে জানান নিরাপত্তা রক্ষী ইকবাল হোসেন।
তিনি বলেন, ৩ দিন হলো তারাও কেউ বাসায় নেই। কোথায় গিয়েছেন বলে যাননি।
গত শনিবার সোনারগাঁওয়ের একটি বিলাসবহুল রিসোর্টে নারী নিয়ে আটক হয়ে হেফাজত নেতা দাবি করেন ওই নারী তার দ্বিতীয় স্ত্রী। যদিও তার সেই দাবি যে ভুয়া, সেটি ফোনালাপ প্রকাশ পাওয়ায় জানা গেছে।
সেই নারীর নাম, শ্বশুরবাড়ি, শ্বশুরের নাম সম্পর্কে যে তথ্য দিয়েছেন, তার সঙ্গে সেই নারীর দেয়া তথ্যের কোনো মিল নেই।
মামুনুল বলেছেন, তার স্ত্রীর (নকল) নাম আমেনা তৈয়্যবা (যেটি তার আসল স্ত্রীর নাম)। বাড়ি খুলনায়, শ্বশুরের নাম জাহিদুল ইসলাম।
তবে সেই নারী জানিয়েছেন তার নাম জান্নাত আরা ঝর্ণা, বাবার নাম অলিউর, গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়। তার স্বামীর নাম হাজেফ জাফর শহীদুল ইসলাম।
কয়েক ঘণ্টা আটক রাখার পর সেই রাতে রিসোর্টে হাম’লা করে মামুনুলকে উদ্ধার করে হেফাজতের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। রাতেই তিনি ঢাকায় ফেরেন।
সারা দেশে তোলপাড়ের মধ্যে মামুনুল তার ৪ ভাইকে নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে দাবি করেন, সেই নারী তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর স্ত্রী। পারিবারিকভাবে তারা বিয়ে করেছেন।
২ দিন পর মামুনুলের ভাই মাহফুজুলের নিয়ন্ত্রণাধীন জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসায় হেফাজত নেতারা জরুরি বৈঠকের পর দাবি করেন, মামুনুল তার দ্বিতীয় বিয়ের যে কথা বলেছেন, সেটি ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী বৈধ।
তবে এরই মধ্যে মামুনুলের একটি ভিডিও ছড়িয়েছে, যেখানে তিনি এক প্রশ্নের জবাবে মহানবী (সা.) এর হাদিস উল্লেখ করে বলেছেন, অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া কোনো মেয়ে বিয়ে করলে তার সেই বিয়ে বাতিলুন বাতিলুন বাতিলুন (বাতিল)। এ বিষয়ে অবশ্য হেফাজত নেতারা কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
মামুনুলের সেই মাদ্রাসায় গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। ফটকে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত আল আমিন বলেন, উনি গত কয়েক দিন মাদ্রাসায় আসেননি। এখন কোথায় আছেন আমি জানি না।
ভেতরে দায়িত্বশীল কেউ আছেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভেতরে দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষা চলছে। প্রবেশ করা যাবে না।
মাওলানা মামুনুল হক সবশেষ কবে এসেছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবশেষ কবে এসেছিলেন আমি তাও বলতে পারব না।
দল যা বলছে
হেফাজত নেতার রাজনৈতিক দল খেলাফত মজলিসের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি বলতে পারছি না উনি কোথায় আছেন। আপনি আমাদের দলের আজিজুর রহমান হেলালের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
এরপর আজিজুর রহমান যা বলেছেন সেটি জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসার নিরাপত্তারক্ষীর বক্তব্যের বিপরীত।
খেলাফত মজলিস নেতা বলেন. উনি আজকে মিটিংয়ে ছিলেন। মিটিং মোহাম্মদপুরে রহমানিয়া মাদ্রাসায় হয়েছিল।
নারায়ণগঞ্জ থেকে মামুনুল ফেরেন আলাদা
মামুনুল যে নারীকে নিয়ে সোরাগাঁওয়ের রিসোর্টে গিয়েছিলেন, আপত্তিকর অবস্থায় আটকের পর তাকে রেখে একাই ঢাকায় ফিরেছেন বলে জানিয়েছেন হেফাজতের নারায়ণগঞ্জ শাখার নেতা ফেরদাউসুর রহমান।
মামুনুলের ঘনিষ্ঠ মহানগর হেফাজতের এই সভাপতি বলেন, রয়্যাল রিসোর্টে থেকে মামুনুল হক ঢাকার পল্টনে তার বোনের বাড়িতে গেছেন। আমি নিজে তার সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ থেকে একই গাড়িতে গিয়েছিলাম। এর পর তিনি সেখান থেকে মোহাম্মদপুর জামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসায় যান।
মামুনুলের নকল স্ত্রী ওই গাড়িতে ছিলেন কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, না তিনি আরেক গাড়িতে গেছেন।
মামুনুলের বাসার দারোয়ান মিথ্যা তথ্য দিলেও নারায়ণগঞ্জ হেফাজতের এই নেতার দাবি, মামুনুল ওই রাতে তার মোহাম্মদপুরের বাসায় গিয়েছিলেন।
হেফাজত নেতা ও তার নকল স্ত্রী এখন কোথায় আছেন জানতে চাইলে ফেরদাউস বলেন, তাদের পারিবারিক ব্যাপার তো আমি জানি না। তবে তারা দুজনই ঢাকায় আছেন। এক সঙ্গে আছেন কি না তা জানি না। আর জানলেও আপনাকে বলব না।
‘পুলিশের হেফাজতে নেই’
গত ২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররমে সংঘ’র্ষের ১০ দিনের মাথায় সোমবার রাতে মামুনুল ও তার বেশ কয়েকজন সঙ্গীর বিরু’দ্ধে মামলা হয় পল্টন থানায়।
মামুনুলের খোঁজ না পাওয়ার বিষয়ে মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কথা বলেন সাংবাদিকদের সঙ্গে। তিনি নিশ্চিত করেন, হেফাজত নেতা তাদের হেফাজতে নেই।
হেফাজত নেতাকে সরকার ধরেছে কি না জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, পুলিশি হেফাজতে নিলে, তাকে কীভাবে বাইরে দেখছেন? তিনি তো বাইরে দিব্যি ঘুরছেন তার আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাইকে নিয়ে। সবার সাথে যোগাযোগও রাখছেন।
মামুনুলের বিয়ের দাবির সত্যতা প্রশ্নের মুখে যেসব কারণে
রিসোর্টে ওঠা সেই নারীর নাম, তার বাবার নাম ও বাড়ির ঠিকানা নিয়ে দুই ধরনের তথ্যের পর বিভিন্ন গণমাধ্যম ও ফেসবুকে প্রকাশিত বেশ কিছু ফোনালাপ হেফাজত নেতার বিয়ের দাবির সত্যতাকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করে দিয়েছে।
এর একটিতে বোঝা যায়, মামুনুল তার ৪ সন্তানের জননী আসল স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, সেই নারী (নকল স্ত্রী) তার পরিচিত শহীদুল ইসলামের স্ত্রী। পরিস্থিতিতে পড়ে তাকে স্ত্রী পরিচয় দিতে বাধ্য হয়েছেন।
পরে আরেকটি কথোপকথনে জানা যায়, যা মামুনুল এবং তার রিসোর্ট সঙ্গীনির মধ্যকার বলে প্রতীয়মান হয়। সেখানে সেই নারী জানান, তিনি পুলিশের জেরায় তার মায়ের একটি বন্ধ মোবাইল নম্বর দিয়েছেন। আর অন্য একজন যখন তাকে কোথায় বিয়ে হয়েছে জিজ্ঞেস করেছে, তখন তিনি বলেছেন, এটা জানেন না। মামুনুলের সঙ্গে কথা বলে জানাবেন।
আরও একটি কথোপকথনে বোঝা যায়, মামুনুলের বোন কথা বলেছেন তার আসল স্ত্রী আমেনার সঙ্গে। তিনি আমাকে বুঝিয়েছেন, কেউ যদি তাকে ফোন করে, তাহলে তিনি যেন বলেন, তিনি বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন এবং তার শাশুড়ি এই বিয়ের আয়োজন করেছেন।
এরই মধ্যে মামুনুলের রিসোর্ট সঙ্গীনির বড় ছেলে ফেসবুক লাইভে এসে মামুনুলের বিরু’দ্ধে কথা বলেন। তিনি তার মায়ের সঙ্গে বাবার সংসার ভাঙার জন্য মামুনুলকে দায়ী করেন।
এই কিশোর মামুনুলের বিচার চেয়ে বলেন, আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে আশা করব এর যেন সঠিক বিচার হয়, আপনারা কারও অন্ধ ভক্ত হয়েন না।… এই লোকটা আলেম নামধারী মুখোশধারী এক জানোয়ার। এর মধ্যে কোনো মনুষ্যত্ব নাই। সুযোগের সব সময় অপেক্ষায় থাকে, কাকে কীভাবে দুর্বল করা যায়। আমার আর কিছু বলার মতো ভাষা নাই। নিউজবাংলা।