মুক্তমঞ্চ ডেস্ক:
আমরা এখন আফগানিস্তানের তালেবান শাসন পূর্ববর্তী অবস্থায় আছি। হেফাজতে ইসলামী নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও রাজনৈতিক খেলাফত মজলিসের কার্যক্রম চলে হেফাজতের নামেই। মূলত মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে আফগানিস্তানের মতো একটি আন্দোলন গড়ে তোলার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে হেফাজত।
এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে ২০১৮ সালে “ইত্তেফাকুল ওয়ায়েজীন বাংলাদেশ” নামের ওয়ায়েজদের একটি সংগঠনকে হেফাজত কেন্দ্রিক “রাবেতাতুল ওয়ায়েজীন বাংলাদেশ” নামে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ সংগঠনে যুক্ত করা হয়েছে সারাদেশের বক্তাদের। এ সংগঠনের গৃহীত কোনো সিদ্ধান্ত বা বার্তা সারাদেশের ওয়ায়েজদের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়াই এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য।
তালেবানি শাসন প্রতিষ্ঠার শক্তি ছিল কওমী মাদ্রাসা; ঠিক সেই আদলেই বাংলাদেশের কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের প্যারা মিলিশিয়া হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশে সম্ভবত ১৪ থেকে ১৮ হাজার কওমী মাদ্রাসা রয়েছে। এর মধ্যে খেলাফত মজলিস ও হেফাজতে ইসলামের মতো ইসলামী দলগুলোর নেতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসাগুলো একেকটি রাজনৈতিক কার্যালয় এবং প্রত্যেকটি ছাত্র রাজনৈতিক কর্মী ভিন্ন আর কিছুই নয়। দরিদ্র পরিবারের এই সন্তানদের আর কোনো উপায়ও নেই।
এ উপমহাদেশে ইসলামিক মিলিশিয়া তৈরির সূচনা করে জামায়াতে ইসলামী। মওদুদী ও জামায়াত নেতাদের দ্বারা ইসলামের অপ-ব্যাখ্যা করে লেখা বইগুলো পড়িয়ে জামায়াতের নেতাকর্মীদের মগজ ধোলাই করা হয়। ফলে জামায়াতের শিক্ষা থেকে মূল ইসলামের শিক্ষার যে তফাৎ, তা বোঝার মতো জ্ঞানও তাদের নেতাকর্মীদের মাথায় নেই। কেন সকল ইসলামী দল/মত নির্বিশেষে খারেজি মতাদর্শের প্রতিরূপ মওদুদীবাদকে বাতিল বলে- তা অনুধাবন করার বোধশক্তিও তারা হারিয়েছে। “তাহলে রাষ্ট্রে ইসলাম কায়েম হবে কীভাবে”- এই উদ্ভট চিন্তার আবর্তে নিজেদের অজান্তেই তারা দলের নেতাদের মাবুদের আসনে স্থান দেয়।
অন্যদিকে শত বছরের পুরনো সিলেবাস অনুসরণ করে চলা কওমী মাদ্রাসায় সরাসরি রাজনৈতিক কোনো শিক্ষা না দেয়া হলেও তাদের সিলেবাস এমনভাবে তৈরি, যেখানে আল্লাহ ও রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশনার বিপরীত শিক্ষা রয়েছে। ফলে আলেম বা শায়েখরাই তাদের কাছে চূড়ান্ত অথরিটি হিসেবে গণ্য হয়।
উদাহরণস্বরূপ- কোরআনে শিশুর দুগ্ধপানের বয়সসীমা ২ বছর। কিন্তু তারা যখন শিখছে, ‘আমাদের আলেমদের মতে এই সীমা আড়াই বছর পর্যন্ত’, তখন তাদের অবচেতন মন শায়েখদের সুপ্রিমেসির বার্তা পায়। এমন অগণিত দৃষ্টান্ত রয়েছে। এছাড়া কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা স্কুল, কলেজ বা সাধারণ শিক্ষার ছাত্রছাত্রীদের প্রতি, এমনকি আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের প্রতিও বিরূপ ধারণা পোষণ করে বড় হয়। তাদের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা এমন হয় যে, তাদের শায়েখ/আলেমরাই এ পৃথিবী এবং তারা সকল ভুলের ঊর্ধ্বে!
জামায়াতে ইসলামী দল হিসেবে বা সাংগঠনিকভাবে যা করে, সেই কাজটি খেলাফত মজলিসসহ অন্যান্য দলগুলো করে ওয়াজ মাহফিলের নামে। এসব ওয়াজ মাহফিল রাজনৈতিক সভা ভিন্ন আর কিছুই নয়। এর মাধ্যমে এক দল অন্ধ অনুসারীকে রাজনৈতিক কর্মীতে পরিণত করতে অনুপ্রাণিত করা হয়। ফলে নেতাদের চাওয়া-পাওয়া ও উচ্চাভিলাষের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয় এই শিশু কিশোররা।
আমরা স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দেখেছি। সেখানে উ’চ্ছৃঙ্খল ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল গুটিকয়েক, তাও সেটি ছিল গুজব প্রভাবিত। কিন্তু সার্বিকভাবে কোনো ধরণের ধ্বং’সাত্মক কর্মকাণ্ডে তারা জড়িত হয়নি, বরং শৃঙ্খলার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে প্রশংসিত হয়েছিল। ঠিক এই ভূমিকায় যখন কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা নেমেছে, তখন তছনছ হয়ে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক এলাকা। অর্ধশিক্ষিত ও প্রায় অশিক্ষিত এবং উগ্রবাদী দীক্ষা পাওয়া গোষ্ঠীর কাছে কল্যাণকর কিছু প্রত্যাশা করা যায় না।
আমরা যে একটি গুরুতর পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছি, তা কয়েকদিনের কর্মকাণ্ডেই সুস্পষ্ট। দান-অনুদানের টাকায় পরিচালিত মাদ্রাসার ছাত্রদের কেন রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হবে- তা নিয়ে ভাবতে হবে এখনই। ওয়াজ মাহফিলে যদি ধর্ম প্রচার না হয় তাহলে তার প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে হলে রাজনৈতিক দলের ব্যানারে করা হোক এবং সেখানে মাদ্রাসার ছাত্রদের অংশগ্রহণ থাকা যাবে না। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের রাজনৈতিক সমাবেশে আসতে বাধ্য করা হলে যা হবে, তার সঙ্গে মাদ্রাসায় বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে কোনো পার্থক্য নেই। একজন আলেম অবশ্যই রাজনীতি করতে পারবেন। তবে সেই রাজনীতি হতে হবে জনগণকে নিয়ে, মাদ্রাসার ছাত্রদের নিয়ে নয়।
এসব পদক্ষেপ যদি আমরা এখনও গ্রহণ করতে না পারি, তাহলে চরম দুঃসময় অপেক্ষা করছে যা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকেও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দিতে পারে।
লেখক: আব্দুল্লাহ হারুণ জুয়েল
পরিচিতি: কলামিস্ট, ইসলামি গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক ছাত্রনেতা।
267