বিশেষ প্রতিবেদন:
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা এবং দেশের কওমি মাদ্রাসা-ভিত্তিক সংগঠন হেফাজত ইসলাম কি জামায়াতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে? মাদ্রাসাটির মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফীর মৃ’ত্যুর পর মাদ্রাসার নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে জামায়াতের নেপথ্য ভূমিকা এমন প্রশ্ন তৈরি করেছে।
জামায়াত-শিবিরের শীর্ষ নেতাদের কাঁধে হেফাজত ইসলামের সর্বোচ্চ নেতা আহমদ শফীর খাটিয়া বহনে সংগঠনটির গন্তব্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
একাধিক সূত্র মতে, হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি নিয়ে ইতোমধ্যে হাটহাজারী ও ঢাকায় একাধিক প্রস্তুতি সভা হয়েছে। এসব সভায় হেফাজতে ইসলামের রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে।
অভিযোগ ওঠেছে, সংগঠনটির নেতৃত্ব ঢাকাকেন্দ্রিক করার মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামকে বাস্তবে গিলে খেতে চায় জামায়াতে ইসলামী। সেই লক্ষ্যে আহমদ শফীর মৃ’ত্যুর আগে মাদ্রাসায় অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্যে জামায়াতে ইসলামীর নেতারা ইন্ধন জুগিয়েছিল।
সূত্র মতে, হেফাজতে ইসলাম ও দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোকে নিজেদের দখলে নিতে জামায়াতের পরিকল্পনা দীর্ঘদিনের। তারই অংশ হিসেবে আল্লামা শফীর মৃ’ত্যুর অনেক আগে থেকে হাটহাজারী মাদ্রাসায় জামায়াত-শিবিরের শীর্ষ নেতাকর্মীদের আনাগোনা শুরু হয়। কিন্তু জীবদ্দশায় আল্লামা আহমদ শফীর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে কওমি মাদ্রাসা-ভিত্তিক শিক্ষাবোর্ডের দখল নিতে জামায়াত-শিবিরের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
জানা গেছে, আহমদ শফীর জানাজা এবং দাফন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন জামায়াত ইসলামের বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, জামায়াতের সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরীসহ বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী।
শুধু তাই নয়, আহমদ শফীর জানাজা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করতেও জামায়াত-শিবির নেতাদের দেখা গেছে। এমনকি আহমদ শফীর খাটিয়াও কাঁধে নিতে দেখা গেছে জামায়াতের সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরী ও জামায়াত নেতা মাওলানা মামুনুল হককে।
আহমদ শফীর জানাজায় সাবেক শিবির নেতা ও বর্তমান এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু, শিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সালাউদ্দিন আইয়ুবি, শিবিরের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আব্দুল আলিমসহ জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
আহমদ শফীর মৃ’ত্যুর কয়েকমাস আগে যুদ্ধাপরাধের দায়ে যাবজ্জী’বনপ্রাপ্ত রাজাকার দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে শামীম সাঈদীরও হাটহাজারী মাদ্রাসায় আনাগোনা হঠাৎ বৃদ্ধি পায়।
এর আগে ফটিকছড়িতে জুনায়েদ বাবুনগরীর মাদ্রাসায় গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে কক্সবাজার-২ আসনের জামায়াত দলীয় সাবেক এমপি ও জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জুনায়েদ বাবুনগরীর মামা হেফাজতের নায়েবে আমীর আল্লামা মহিবুল্লাহ বাবুনগরীকে হেফাজতের আমীর বানানোর প্রস্তাব রাখেন জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আযাদ।
একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, চলতি বছরের শুরুতে সাতকানিয়ায় একটি বাড়িতে সাঈদীপুত্র মাসুদ সাঈদী ও সরকারবিরোধী উগ্রবাদী বক্তা হিসেবে পরিচিত তারেক মনোয়ারের সাথে হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর গোপন বৈঠক হয়। বৈঠকের বিস্তারিত সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে গোপন প্রতিবেদন দেয় গোয়েন্দা সংস্থাটি।
এতে উল্লেখ করা হয়, সাতকানিয়ায় সাঈদীপুত্র মাসুদ সাঈদী ও তারেক মনোয়ার এবং ফটিকছড়িতে জামায়াত নেতা হামিদুর রহমান আযাদের সঙ্গে ষড়’যন্ত্রমূলক গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছেন ও জামায়াতের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা গ্রহণ করেছেন জুনায়েদ বাবুনগরী।
ফলে জুনাইদ বাবুনগরী সরকারবিরোধী উসকানি, মদদ দিতে সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা চালাবেন বলে প্রতীয়মান হয়। শাহ আহমদ শফী অসুস্থ থাকায় জুনায়েদ বাবুনগরী নানা ধরনের কূটকৌশল ও ষড়’যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
জুনায়েদ বাবুনগরীর জামায়াত-কানেকশনের বিষয়টি রাজাকার সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদীর সাথে ছবি ভাইরাল হলে তা স্পষ্ট হয়। যদিও বাবুনগরী জামায়াত-কানেকশনের বিষয়টি অস্বীকার করে ১০ লক্ষ টাকার চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেছেন।
এই বৈঠকই প্রথম নয়, এর আগেও হাটহাজারী ওলামা পরিষদের নেতৃবৃন্দ আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মীর নাছিরের চাচাতো ভাই মীর ইদ্রিস, মাওলানা জাফর, মাওলানা সাইফুল্লাহ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে হেফাজতের বিত’র্কিত নেতা মুফতী হারুন ইজহার ও মাওলানা মামুনুল হকেরও হাটহাজারী মাদ্রাসায় আনাগোনা বেড়ে গেছে।
মূলত আহমদ শফীকে সামনে রেখেই হেফাজতে ইসলামী তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছিল চট্টগ্রামসহ সারাদেশে। তার মৃ’ত্যুর পর আদৌ সংগঠন হিসেবে হেফাজতে ইসলাম কতটুকু টিকে থাকবে সে প্রশ্নটিও সামনে চলে এসেছে। আর এই পরিস্থিতিতে হেফাজতের নিয়ন্ত্রণ নিতে কৌশলে আটঘাট বেঁধে নেমেছে জামায়াত।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটির রূপরেখায় জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমীরের পদে রাখা হলেও শীর্ষ পদগুলোতে যেমন- মহাসচিব মাওলানা নূর হোসেন কাসেমী (জামায়াতপন্থী নেতা), এক নম্বর যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, মুফতী হারুন ইজহারসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে জামায়াত থেকে হেফাজতে ইসলামে অনু-প্রবেশকারী সদস্যদের তালিকা বড় হচ্ছে।
কওমি আলেমরা বলছেন, হাটহাজারী মাদ্রাসাটি চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ ও আলেম-ওলামাদের কাছে অত্যন্ত সম্মান ও আবেগ-অনুভূতির জায়গা। আহমদ শফীর অক্লান্ত পরিশ্রমে হাটহাজারী মাদ্রাসার খ্যাতি ও ভাবমূর্তি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। কিন্তু সেই সুনাম নিজেদের দখলে নিতে ওঁৎ পেতে আছে জামায়াত।
কওমি মাদ্রাসা-ভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশকে জামায়াতে ইসলামের হাতে তুলে দিতে একটি চক্র ষড়’যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এ নিয়ে বেশ বড় এবং অকল্পনীয় অংকের লেনদেনেরও তথ্য রয়েছে বলে জানান তারা।
এদিকে হাটহাজারী মাদ্রাসার পরবর্তী মহাপরিচালক হওয়ার দৌড়ে আছেন শফীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত বর্তমান সহযোগী পরিচালক শাইখুল হাদিস শেখ আহমদও। আহমদ শফীর মৃ’ত্যুর আগে দুপক্ষের দ্ব’ন্দ্বের জেরে হাটহাজারী মাদ্রাসার শূরা কমিটি সহযোগী পরিচালকের পদ থেকে জুনায়েদ বাবুনগরীকে অ’ব্যাহতি দিয়ে শেখ আহমদকে ওই পদে বসানো হয়।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে একাধিকবার কল করা হলেও জামায়াত নেতা সাবেক এমপি শাহজাহান চৌধুরীর মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। হেফাজত ও দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোকে জামায়াতে ইসলামী কব্জায় নেওয়ার চেষ্টা প্রসঙ্গে জানতে মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত একাধিক বার ফোন করেও জুনায়েদ বাবুনগরীকে পাওয়া যায়নি।
তবে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, হেফাজতের সাথে জামায়াতের আদর্শগত পার্থক্য আছে। আহমেদ শফীর জানাজায় লাখ লাখ লোক অংশ নিয়েছিল। সেখানে জামায়াতের কিছু নেতার অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে এত আলোচনা হচ্ছে কেন? হেফাজত একটি অরাজনৈতিক সংগঠন। এটার সাথে জামায়াতের সখ্যতার প্রশ্নই উঠে না।