মুক্তমঞ্চ ডেস্ক:
অস্কারপ্রাপ্ত ৩ মিনিটের এনিমেটেড ফিল্মটি দেখে আমার জীবনের অতি দুঃখের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ল। ১৯৯৬ সাল। আমি তখন যুক্তরাজ্যে। রয়েল আলেক্সান্দ্রা হাসপাতাল স্কটল্যান্ডে চক্ষু রোগের উপর ফেলোশিপ করছি।
ঢাকায় শ্যামলীর বাসায় আমার স্ত্রী সন্তানদের সাথে আমার বৃদ্ধ বাবা-মাকে রেখে যাই। বাবার বয়স তখন প্রায় ৯০ বছর। বয়স বেশি হলেও বেশ সুস্থই ছিলেন তিনি। একা একাই ঢাকায় আমার বাসায় আসা যাওয়া করতেন। ফেব্রুয়ারি/৯৬ মাসের শেষের কোন একদিন বাবা কিশোরগঞ্জ জেলায় আমার গ্রামের বাড়ি পাকুন্দিয়া উপজেলায় যেতে চান। আমার মা ও স্ত্রীর বারণ সত্ত্বেও গ্রামের বাড়ি খালি পড়ে আছে এই উছিলায় তিনি বাসা থেকে বেরিয়ে যান। সেদিনের আবহাওয়া ছিল প্রচন্ড গরম। গুলিস্তান থেকে তিনি বাসে উঠলেন কিশোরগঞ্জ হয়ে পাকুন্দিয়া যাবেন বলে।
বিআরটিসির বাস। যাত্রীর ভীড় অনেক বেশি। অনিশ্চয়তায় না থেকে বাবা ভীড় ঠেলেই বাসে উঠে পড়েন। বসার একটি সিট তিনি অন্তত পাবেন সেরকম একটি আশা ও বিশ্বাস তাঁর মনে ছিল। আমার বৃদ্ধ বাবা বাসে উঠার আগেই বাসের সবকটি সিট দখল হয়ে যায়। ইতিমধ্যে বাস ছেড়ে দিয়েছে। কী আর করা, বাসের মাঝখানে হাতের ব্যাগ রেখে বাসের হ্যান্ডেল ধরে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন।
সিটে বসা অধিকাংশ যাত্রী ছিল অল্প বয়সী। আমার বাবা ৪০ বৎসরের অধিক সময় ধরে হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেছেন। তাঁর হাতে তৈরি বহু ছাত্র দেশ বিদেশে সুনামের সাথে প্রতিষ্ঠিত। আমি নিজেও আমার বাবার একজন গর্বিত ছাত্র।
আমার শিক্ষক পিতার মনে হয়তো এমন একটি বিশ্বাস ছিল, যে কেউ হয়তো স্যার বলে বা আঙ্কেল বলে ডাক দিয়ে বলবে- আপনি আসুন, আপনি দাঁড়িয়ে কেন আপনি বসুন, আমার বয়স তো কম, আমি দাঁড়িয়ে যেতে পারব। বাবার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। অবস্থা দেখে তিনি আশাহত হলেন এবং নিশ্চিত হলেন যে, তাঁকে বাসে দাঁড়িয়ে ঝুলতে ঝুলতেই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে।
একজন সৎ, নিষ্ঠাবান ও কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষকের কাছে মনুষ্যত্ব ও মানবতাবোধের পরাজয় হলো। ৯০ বছরের একজন বৃদ্ধ শিক্ষক প্রচন্ড গরমে বুকফাটা তৃষ্ণা নিয়ে প্রায় ৬ ঘন্টার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে যখন কিশোরগঞ্জ পৌঁছান, তখন বাস থেকে কোন রকমে নেমে হাঁটতে পারছিলেন না, কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিলো। একজন রিক্সাওয়ালার সাহায্যে সেদিন বাবা কিশোরগঞ্জে আমার বড় ভাইয়ের বাসায় পৌঁছান। ভাবীকে দ্রুত ঠান্ডা শরবত ও তরমুজ দিতে বলে অবশ হয়ে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েন।
শরীরের এই ধকল বাবা সইতে পারেননি। কয়েকদিন পর তিনি হঠাৎ ঘুমের মধ্যে ব্রেন স্ট্রোক করে অজ্ঞান হয়ে যান। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমি দেশের বাইরে। এমতাবস্থায় আমার ভাইয়েরা বাবাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয়নি। মার্চ/৯৬ ১০ তারিখ আমার বাবা অচেতন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
অসুস্থ হওয়ার আগে ভাবীর কাছে বাবা নাকি বলেছিলেন, “ওরা আমাকে বাসের মধ্যেই মে’রে ফেলেছে। এত কষ্ট আমি জীবনে পাইনি।” যে সত্য ঘটনার আমি বর্ণনা করলাম তা আমার জন্মদাতা বাবার বেলায় হয়েছে বলেই হয়তো আমি কষ্ট পাই। আজো ভুলতে পারছি না। সৌজন্যবোধ, দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধাবোধ বা মানবতাবোধের বিপ’র্যয়ের আরো অধিকতর দুঃখের স্মৃতি সমাজের বহুমানুষ হয়তো নীরবে প্রত্যক্ষ করেছে।
মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার মনুষ্যত্ববোধ সেদিন কোথায় ছিল? ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত বাবার বিবর্ণ দৃষ্টি সেদিন হয়তো তাঁর পুত্রতুল্য অনেক যাত্রীর সাথে চোখাচোখি হয়েছে। অব্যক্ত ভাষায় তাঁর চোখ হয়তো বলেছে, বাবা আমাকে একটু বসতে দাও আমার কষ্ট হচ্ছে, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।
সারা জীবন চলার পথের বিপদের কথা বা কষ্টের কথা বাবা কাউকে কখনো মুখ ফুটে বলতেন না। আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা নিয়ে তিনি চলতেন। মনে পড়ে পবিত্র হজ্ব পালন করতে যাওয়ার সময় তপ্ত দুপুরে অস্থায়ী হজ্ব ক্যাম্প থেকে বাসে ওঠার লাইনে দাঁড়িয়ে বাবা আমার কাছে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি চেয়েছিলেন। আমি উপায়ন্তর না দেখে পাশে দাঁড়ানো পুলিশ কনস্টেবলকে ভাই বলে সম্বোধন করে আমার বাবাকে এক গ্লাস পানি এনে দিতে বলি।
সেই পুলিশ কনস্টেবল ছুটে গিয়ে বাবা বাসে উঠার আগ মুহূর্তে কোথা থেকে জানি এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে বাবার হাতে দিলেন। বাবা প্রশান্তি ও তৃপ্তি নিয়ে পানি পান করে তাকে প্রাণ ভরে দোয়া করলেন।
আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগের পুলিশ সদস্য ছোট্ট একটি কাজের মাধ্যমে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা আজো আমাকে ঐ পুলিশ কনস্টেবলের কাছে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করে রেখেছে। অথচ আমার অশীতিপর বৃদ্ধ বাবাকে বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝুলতে দেখে কী করে পারল মানুষ নামধারী অ-মানুষগুলো সিটে বসে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে!
আমার সুস্থ বাবার মৃ’ত্যু যারা ত্বরান্বিত করেছে, সে দিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি আমি আজো ভুলতে পারি না।
লেখক: অধ্যাপক ডাঃ দীন মোহাম্মদ নূরুল হক
পরিচিতি: চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও সাবেক মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।