সময় এখন ডেস্ক:
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর ও সাম্প্রতিক তা’ণ্ডবের ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের একের পর এক শীর্ষ নেতা যখন গ্রেপ্তার হচ্ছেন, তখন রিসোর্টকাণ্ডে সমালোচিত নেতা মামুনুল হক আটকাবস্থার প্রশংসা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। জেলের বাইরের জীবনকে তিনি জু’লুমের মুক্ত বাতাস হিসেবে দেখছেন।
মামুনুল হক নিজেও সহিং’সতার মামলার আসামি এবং তাকে যে কোনো সময় গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ভারতের সরকারপ্রধান নরেন্দ্র মোদিকে আমন্ত্রণ জানানোর পর হেফাজতের নেতা-কর্মীরা হুম’কি-ধমকির পর ব্যাপক সহিং’সতা চালান। এরপর আবার একজন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলে সারা দেশে মাঠে নামার হুঁশিয়ারি দেন মামুনুল হকসহ অন্য নেতারা।
তবে শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর হেফাজতের নেতৃত্ব নমনীয় হয়েছে। আমির জুনায়েদ বাবুনগরী শুক্রবারের খুতবায় নেতা-কর্মীদের দোয়া ও ইসতিগফার পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
পরদিন মামুনুল হক ফেসবুকে এসে এমন প্রতিক্রিয়া দিলেন, যা ২৬ মার্চের আগে-পরে নানা বক্তব্যের ঢংয়ের পুরোপুরি বিপরীত।
তিনি লিখেন, ‘নিজ দেশে যারা পরবাসীর মতো থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাদের কথা ভিন্ন। অন্যথায় আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ইমানদারগণ এটা নীরবে মেনে নিতে পারে না। এই পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে জু’লুমের মুক্ত বাতাস থেকে প্রতিবাদের ব’ন্দিত্বই হাজার গুণে শ্রেষ্ঠ!’
৩ এপ্রিল রিসোর্টে বেগানা নারীসহ আপত্তিক অবস্থায় আটকের পর থেকে মামুনুল অবশ্য ফেসবুক পেজে ৮ এপ্রিলের পর এক সপ্তাহ সক্রিয় ছিলেন না। ৮ এপ্রিল ফেসবুক লাইভে এসে তিনি রিসোর্টের ঘটনায় স্ত্রীর কাছে অসত্য দাবি করার ঘটনাটির যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ইসলামে সীমিত পরিসরে সত্য গোপনের সুযোগ আছে।
ওই লাইভে তিনি তার, স্বজন ও সংগঠনের নেতাদের প্রকাশিত ফোনালাপগুলোর সত্যতা কার্যত স্বীকার করে নিয়ে বলেন, এগুলো ফাঁ’স করে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার ল’ঙ্ঘন করা হয়েছে। মাঝখানের সময়টুকুতে এসব ফোনালাপ ও তথ্যগুলোকে মিথ্যা দাবি করে হেফাজতের যেসব নেতাকর্মীরা প্রপাগান্ডা চালিয়েছিল, তারা এতে ক্ষুব্ধ হয়।
তাদের সেই প্রতিক্রিয়া দেখে মামুনুল হক তার লাইভ ভিডিওটি ফেসবুক পেজ থেকে ডিলিট করে দেন। আর এক সপ্তাহ কার্যত নীরব হয়ে যান। মাঝে আরবিতে দুটি স্ট্যাটাস দেয়া ছাড়া আর কোনো আপডেট হয়নি পেজটির। শুক্রবার রাতে মামুনুল তাদের সংগঠনের মহাসচিব নুরুল ইসলামের একটি বিবৃতি পোস্ট করেন।
এরপর শনিবার তিনি গ্রেপ্তার অভিযান নিয়ে স্ট্যাটাস দেন।
গত ২৬ মার্চ থেকে ঢাকায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে সরকার সমর্থকদের সঙ্গে সংঘ’র্ষের পর চট্টগ্রামের হাটহাজারী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তা’ণ্ডব চালায় হেফাজত কর্মীরা। এ সময় রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষা এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশি অ্যাকশনে প্রাণ হারান ৪ জন।
দুই দিন পর হরতালের দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে ব্যাপক তা’ণ্ডব চালানো ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান, হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ, কিশোরগঞ্জে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এবং পুলিশের ওপরও হাম’লা করে হেফাজত কর্মীরা।
৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টে বেগানা নারী নিয়ে আপত্তিকর অবস্থায় আটক মামুনুল হকের অনুসারীরা ওই এলাকা ছাড়াও মুন্সিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে তা’ণ্ডব চালায়। সেই ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা হেফাজতকে সতর্ক করে বক্তব্য রাখতে থাকেন।
এরপর থেকে গ্রেপ্তার হতে থাকেন হেফাজতের শীর্ষ নেতারা।
১১ এপ্রিল ধরা পড়েন হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী। পরদিন তাকে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়।
১২ এপ্রিল না’শকতা পরিকল্পনা, ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়ানো, রাষ্ট্রবিরোধী ষড়’যন্ত্র ও ধর্মীয় অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে কেরানীগঞ্জের ঘাটারচরে মামুনুল হকের তারবিয়াতুল উম্মাহ মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার হন কেন্দ্রীয় নেতা মুফতি ইলিয়াস হামিদী। পরদিন তাকে ৭ দিনের রিমান্ডে পাঠানো হয়।
১৩ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন নারায়ণগঞ্জ হেফাজতের সাধারণ সম্পাদক মুফতি বশির উল্লাহ। তিনি গ্রেপ্তার হন ২৮ মার্চ নারায়ণগঞ্জে সহিং’সতার মামলায়। একই দিন ধরা পড়েন হেফাজতের সহপ্রচার সম্পাদক মুফতি শরিফউল্লাহ। তাকে ২০১৩ সালের ৫ মের তা’ণ্ডবের মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
১৪ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন হেফাজতের সহকারী মহাসচিব মুফতি শাখাওয়াত হোসাইন রাজী। হেফাজতের সাম্প্রতিক তা’ণ্ডবে তার ইন্ধনের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ। একই দিন রাতে গ্রেপ্তার হন সহকারী মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী। তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে ২০১৩ সালের ৫ মে তা’ণ্ডবের মামলায়।
১৬ এপ্রিল গ্রেপ্তার হন হেফাজতের ঢাকা মহানগরের সহসভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ জুবায়ের। তিনি ২০১৩ সালের ৫ মের ঘটনাপ্রবাহের পর মতিঝিল থানায় করা না’শকতার মামলার আসামি। জুবায়ের ইসলামী ঐক্যজোটের প্রয়াত আমির মুফতি ফজলুল হক আমিনীর জামাতা।
২৬ মার্চ বায়তুল মোকাররমে সংঘ’র্ষের মামলায় আসামি করা হয়েছে হেফাজত নেতা মামুনুল হককেও। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পটিয়া, হাটহাজারীতে শতাধিক হেফাজতকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত সেপ্টেম্বরে হাটহাজারী মাদ্রাসায় তা’ণ্ডবের পর মা’রা যাওয়া হেফাজত আমির শাহ আহমদ শফীকে হ’ত্যাকরার অভিযোগ এনে করা মামলায় গত রোববার যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে সেখানেও বাবুনগরীকে আসামি করা হয়েছে।
মামুনুলের দাবি, একটি ঢিলও ছোড়েননি তারা
সহিং’সতার দায় হেফাজতের ওপর চাপানো ‘উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোর নামান্তর’ দাবি করে দেয়া স্ট্যাটাসে ২৬ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত ঘটনা নিয়ে কথা বললেও ৩ এপ্রিল তার রিসোর্টকাণ্ড নিয়ে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।
মামুনুল লেখেন, ‘২৭ মার্চ থেকে ২রা এপ্রিল বিক্ষোভ, হরতাল, দোয়া ও প্রতিবাদ সমাবেশ হেফাজতে ইসলাম আহূত প্রতিটি কর্মসূচি পালিত হয়েছে প্রশাসনের অনুমোদন সাপেক্ষে এবং শান্তিপূর্ণভাবে।’
২৬ মার্চের গ’ন্ডগোলের দায় কোনভাবেই হেফাজতের ওপর বর্তায় না দাবি করে মামুনুল লেখেন, ‘এ দায় হেফাজতের ওপর চাপানো সুস্পষ্ট অ’ন্যায়।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সহিং’সতা হেফাজতের নেতা-কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা কতটুকু, সেটাও মামুনুলের বিবেচনায় ‘প্রশ্নসাপেক্ষ’।
তিনি লেখেন, ‘সেখানে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কো’ন্দল ও তাদের কর্তৃক হাম’লার কথা খোদ প্রশাসনও অস্বীকার করে না। সুতরাং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সহিং’সতা ও জ্বালাও-পোড়াওয়ের দায় হেফাজতের ওপর চাপিয়ে দেয়াও উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানো বৈ কিছুই নয়।’
মামুনুল লেখেন, ‘হেফাজতের কর্মসূচি চলাকালীন ৪ দিনে ঢাকায় তো একটা ইটপাটকেলও ছোড়া হয়নি। পুলিশের নিরাপত্তা ও বেষ্টনীর মধ্যেই সবগুলো কর্মসূচি পালিত হয়েছে।’
রোজায় ঢাকায় কেন ধরপাকড় চলছে- এমন প্রশ্ন তুলে মামুনুল লেখেন:
‘আজিজুল হক ইসলামাবাদী কাকে আঘা’ত করেছে? মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী কোথায় হাম’লা করেছে? মুফতি সাখাওয়াত হোসাইন রাজী কার মাথায় বাড়ি মে’রেছে? মাওলানা যুবায়ের আহমদ কার বাড়াভাতে ছাই দিয়েছে? মাওলানা ইলিয়াস হামিদী, মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানী, মুফতি বশিরুল্লাহ, মাওলানা শরিফুল্লাহরা কোথায় কার ওপর হাত তুলেছে?’
হেফাজত নেতা লেখেন, ‘করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের সময় এভাবে আলেম-ওলামাদের নি’র্বিচারে গ্রেপ্তার অত্যন্ত গ’র্হিত ও নি’ন্দনীয়।’