সময় এখন ডেস্ক:
গত ১১ এপ্রিল থেকে একে-একে গ্রেপ্তার হচ্ছেন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতারা। কার পর কে গ্রেপ্তার হবেন— এ আলোচনা এখন নেতাদের মুখে। তারা চলছেন সতর্ক হয়ে; নিয়মিত ফোন ও ঠিকানা বদলে। অনেকটা সকাল-দুপুর দৌড়ে বেড়াচ্ছেন হেফাজতের নেতারা।
সর্বশেষ রবিবার (১৮ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে সংগঠনটির আলোচিত-সমালোচিত যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে গ্রেপ্তারের পর কেন্দ্রীয় কোন নেতাকেই আর পাওয়া যাচ্ছে না। কারও-কারও ফোন খোলা থাকলেও রিসিভ করছেন অন্য কেউ।
তবে হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের একাধিক সিনিয়র নেতা জানিয়েছেন, গ্রেপ্তার হলেও এই লকডাউনের মধ্যে রমজান মাসে কোনও কর্মসূচি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে সংগঠনটির। এ ক্ষেত্রে আপাতত আইনি পথ ও বিবৃতি দিয়েই পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়া জানানোর চিন্তা রয়েছে হেফাজতের।
হেফাজতের সদর দফতর হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলামের একাধিক দায়িত্বশীল জানিয়েছেন, সংগঠনের আমির মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী মাদ্রাসাতেই আছেন। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
তবে তাৎক্ষণিক পরামর্শ-পর্যালোচনা করতে যাদের সঙ্গে কথা বলতেন তিনি, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই গ্রেপ্তার হওয়ায় সেটিও সম্ভব হচ্ছে না। এ কারণে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে হেফাজতের আমিরও হিমশিম খাচ্ছেন বলে নির্ভরযোগ্য দায়িত্বশীলের দাবি।
জানতে চাইলে হেফাজতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বলেন, সরকার হেফাজতের বিরু’দ্ধে ক্র্যাকডাউনে নেমেছে স্পষ্ট। হেফাজত নিয়মতান্ত্রিক, সংঘবদ্ধ কোনও সংগঠন নয়, একটি ফোরামের মতো আছে।
আমি যতদূর জানি, এখনই এই পরিস্থিতিতে কোনও কর্মসূচি দেবে না হেফাজত। করোনার কারণে চলমান লকডাউন এবং পাশাপাশি রমজান মাস চলছে। ফলে এখনই কর্মসূচি দেওয়ার সুযোগ নেই।
রবিবার দুপুরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসা থেকে গ্রেপ্তার হন হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর কমিটির সেক্রেটারি মাওলানা মামুনুল হক। তাকে প্রতিষ্ঠানটি দ্বিতীয় তলা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গত ৩ এপ্রিল সোনারগাঁওয়ের রয়েল রিসোর্টে বেগানা নারীসহ আপত্তিকর অবস্থায় জনতার হাতে আটকের পর থেকেই মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় অবস্থান করছিলেন মামুনুল হক। এর আগে ১১ এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত হেফাজতের কেন্দ্রীয় অন্তত ৮ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করলো পুলিশ।
তারা হলেন, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, আজিজুল হক ইসলামাবাদী, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমাদ, মাওলানা মুঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, মুফতি শরীফ উল্লাহ, মাওলানা সাখাওয়াত হোসেন রাজি ও মুফতি ইলিয়াস।
এছাড়া সারাদেশ থেকে অন্তত দেড় শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিভিন্ন মামলায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুফতি আমিনীর মেয়ের জামাই মাওলানা জুবায়ের।
মামুনুলের গ্রেপ্তারের পর তার দল বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি নিয়ে দলীয়ভাবে আলোচনা চলছে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে কর্মসূচি দেওয়া না হলে দলীয়ভাবেও প্রতিবাদ সীমিত রাখা হতে পারে।
রবিবার দুপুরে খেলাফত মজলিসের কেন্দ্রীয় শীর্ষ এক নেতা বলেন, নেতারা গ্রেপ্তার হলে কর্মসূচির বিষয়ে আগে কোনও আলোচনা ছিল না। এখন আবার লকডাউন চলছে। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি বিশ্লেষণের পর সিদ্ধান্ত আসবে।
হেফাজতের কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলরা বলছেন, মামুনুলের গ্রেপ্তারের পর থেকে ঢাকার নেতারা অনেকটা গা ঢাকা দিয়েছেন। নিজেদের ফোন বন্ধ রেখে যে যার মতো নিরাপদে অবস্থান নিতে শুরু করেছেন।
রবিবার দুপুর থেকে হেফাজতের মহাসচিব মাওলানা নুরুল ইসলাম, নায়েবে আমির, যুগ্ম ও সহকারী মহাসচিবসহ অন্তত একডজন নেতাকে ফোন করা হলেও তারা ফোন রিসিভ করেননি।
ঢাকা মহানগরের এক নেতা বলেন, ১৯৯৯ সালে ফতোয়া ব্যান করা বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের পর আন্দোলনের সময় ধর্মভিত্তিক দলের নেতারা গণ গ্রেপ্তার হন। এর ২০ বছর পর আবারও সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা। তবে ধর্মভিত্তিক দল ও আলেমদের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় সম্মিলিত প্রতিবাদ করতে পারছে না হেফাজত।
ঢাকার কয়েকটি কওমি মাদ্রাসা ও নারী কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকেও খবর পাওয়া গেছে, ওই সব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় তথ্য চাওয়া হচ্ছে নিকটস্থ থানা থেকে।
সরকারের ক্ষমতাধর একটি সংস্থার সূত্র জানায়, হেফাজতের নেতাদের ধরপাকড় প্রক্রিয়া আরও চলবে। বিশেষ করে করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ আগমনের সময় গত ২৫, ২৬, ২৭ মার্চ ৩ দিন ধরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যে না’শকতা চালানো হয়েছে, এর পেছনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ যাদের ভূমিকা পাওয়া যাচ্ছে, তাদেরই আইনের আওতায় আনবে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
হেফাজতের নায়েবে আমির অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের বলেন, আমরা আইনগতভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার করার চিন্তা করছি। ইতোমধ্যে পারিবারিকভাবে আইনি পথে সহযোগিতা নেওয়া শুরু হয়েছে। এটা আমরা সাংগঠনিকভাবেও অ’ব্যাহত রাখার চেষ্টা করবো।
হেফাজতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, পুরো হেফাজতে ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। কখন কাকে ধরবে পুলিশ, এ নিয়ে বিস্তর টেনশন শুরু হয়েছে সেখানে অবস্থানরত নেতাদের। স্থানীয় নেতারা ইতোমধ্যে নিজেদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে গোপনে অবস্থান করছেন।
ইতোমধ্যে হেফাজত নেতাদের গ্রেপ্তারের কারণে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে পড়েছে সংগঠন। ফলে, কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মসূচির বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তেই যেতে পারছেন না বাবুনগরী ও হেফাজতের শীর্ষনেতারা। তবে আজ বিবৃতির মাধ্যমে মামুনুল হকসহ অন্যদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ জানাতে পারেন হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী।
জানতে চাইলে হেফাজতের আমির প্রেস সেক্রেটারি মাওলানা ইনামুল হাসান ফারুকী বলেন, কর্মসূচি বা বিবৃতির বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্তের কথা আমি জানি না। আমিরে হেফাজত পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। কোনও সিদ্ধান্ত হলে আমরা জানিয়ে দেবো।
২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের তা’ণ্ডবের পর মামলা হলেও উল্লেখযোগ্য কোনো অ্যাকশন দেখা যায়নি সরকারের পক্ষ থেকে। বরং হেফাজতে ইসলামকে হাতে রাখতে বেশ কিছু বিষয়ে নমনীয় আচরণ করেছিল সরকার। আর এতেই হেফাজতের নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে ‘বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত’ বলে ধরে নেন। ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন ইস্যুতে গলা উঁচু করতে করতে এক পর্যায়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে থাকেন তারা।
যাকে তাকে কাফের, নাস্তিক ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলে হেফাজতে ইসলাম। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চক্রের সাথে মিলে দেশকে অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার সম্পৃক্ত হয় এই উগ্রবাদী গোষ্ঠী। যার ফলে এবার সরকারের অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও কার্যকর কৌশলে পরাস্ত হলো হেফাজত। একে অনেকেই সংগঠনটির ইতি দেখছেন।
267