সময় এখন ডেস্ক:
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমনকে কেন্দ্র করে এখন পর্যন্ত হেফাজতের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের ১৯ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটককৃতরা পুলিশি জেরায় সংগঠনের অর্থের যোগান, ওয়াজে বাধ্য করিয়ে বক্তা হিসেবে নেওয়া এবং চাহিদা অনুযায়ী অর্থ আদায়, অনেক নেতার নারী প্রীতিসহ নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব।
নিজেদের নেতা কর্মীদের নিয়ে সারা দেশে ‘রাবেতাতুল ওয়ায়েজীন’ নামক একটি সংগঠন তৈরি করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সংগঠনটি সারা দেশে ওয়াজ মাহফিল নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানায় পুলিশ।
গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম তার কার্যালয়ে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের গ্রেপ্তার ও জেরা সম্পর্কে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় এ কথা জানান।
যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেন, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আয়োজকদের বাধ্য করা হচ্ছে হেফাজত নেতাদের বিভিন্ন ওয়াজে নেওয়ার জন্য। এর মাধ্যমে তারা উগ্রবাদী বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করতে পারছে।
তাছাড়া মাদ্রাসার গরিব ছাত্রদের ব্যবহার করে হেফাজত অনেক নেতা বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। মাদ্রাসা দখলের মতো অপকর্ম ও অনেকের নারী প্রীতির মতো ঘটনায় জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও রয়েছে বলে জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।
সম্পত্তি না’শকতার ঘটনায় হেফাজত নেতাদের বিরু’দ্ধে হওয়া ১২টি মামলা এবং ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের ঘটনায় ৫৩টিসহ মোট ৬৫টি মামলার তদন্ত করছে ডিবি।
তিনি বলেন, তাদের জেরার জন্য কোরআন হাদিস বোঝেন, জানেন এমন তদন্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে ৩টি দল গঠন করে দেওয়া হয়েছে। তদন্তে মূলত না’শকতার মূল উদ্দেশ্য কী, কারা করছে, কেন করছে, তা জনার চেষ্টা করছেন তারা।
২০১৩ সালে সরকার পতনের অনেক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে হেফাজতের চক্রান্ত হয় উল্লেখ করে মাহবুব আলম বলেন, হেফাজতকে কাজে লাগিয়ে সরকার পতনের একটি অপচেষ্টা হয়েছিল। এ বছর আবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে যে না’শকতা হলো, সেখানে একই ধরনের আরেকটি চক্রান্ত হয়েছে।
এটা তদন্তে অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, হেফাজত নিজেদের অরাজনৈতিক দল বলছে। কিন্তু তাদের সংখ্যাগরিষ্ট নেতারই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
তিনি বলেন, অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতাই মনে করেন- হেফাজত একমাত্র প্ল্যাটফর্ম যাকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে কাজে লাগানো যায়। মাদ্রাসার ছাত্রদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এমন অপচেষ্টা করছে বা না’শকতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছেন।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার বলেন, অনেকেই তাদের অরাজনৈতিক চরিত্রটি বলছেন। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে হেফাজত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এগুলো তাদের জেরা থেকে পেয়েছি। ২০১৩ সালে বাবুনগরী ১৬৪ ধারায় স্টেটমেন্ট দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগে মুফতি ফখরুল স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। সেখানে পুলিশ এসব ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরেছে।
মাহবুব আলম বলেন, প্রত্যেক রাজনৈতিক দলেরই আলাদা আলাদা এজেন্ডা রয়েছে। সেই এজেন্ডাগুলো তারা বাস্তবায়ন করতে চায় হেফাজতকে দিয়ে। হেফাজত এমনই এক সংগঠন যার ডাকে মাদ্রাসার ছাত্রদের আনা ও ব্যাপক লোক সমাগম সম্ভব হয়।
হেফাজত নেতারা কী চান, এমন প্রশ্নের জবাবে মাহবুব আলম বলেন, তারা আসলে চান সরকার পতনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশকে পাকিস্থান বা আফগানিস্তান মডেল বানানোর পরিকল্পনা আছে।
তাছাড়া হেফাজতের মধ্যে বেশ কয়েকটি ভাগ আছে বলেও জানান মাহবুব। একটি পক্ষে উগ্রবাদের পক্ষে, তাদের নাম জানার চেষ্টা চলছে। এ নিয়ে গ্রেপ্তারও অ’ব্যাহত আছে। উগ্রবাদের সঙ্গে জড়িতরা সম্প্রতি যে না’শকতা করেছে সেগুলোর ভিডিও ফুটেজ, অডিও কথোপকথন এবং জেরায় যে তথ্যগুলো এসেছে সেগুলোর মাধ্যমে সাক্ষ্য-প্রমাণের চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
হেফাজত নেতা মামুনুল হকের গোপন বিয়ের বিষয়েও জেরা হয়েছে বলে জানান মাহবুব আলম। তিনি বলেন, প্রথম বিয়ে শরিয়ত বা আইনসম্মতভাবে হয়েছে। পরবর্তী যে দুটি বিয়ের কথা তিনি স্বীকার করেছেন, এ দুটি চুক্তিভিত্তিক বিয়ে। সেখানে কোনো কাবিননামা নেই। পরের বিয়ের চুক্তিগুলো হচ্ছে- স্ত্রী থাকবে কিন্তু স্ত্রীর কোনো মর্যাদা পাবে না।
স্ত্রী মেলামেশা করতে পারবে কিন্তু সম্পর্কের কোনো অধিকার পাবে না। একইসঙ্গে কোনো দাবিদাওয়া বা সন্তান ধারণ করতেও পারবে না। এ ধরনের চুক্তি প্রচলিত আইনের পরিপন্থী বলে জানান মাহবুবুল আলম।
কোনো রাজনৈতিক দল ষড়যন্ত্র জড়িত এ বিষয়ে ডিবির যুগ্ম কমিশনার বলেন, ইসলামপন্থীর বাইরেও মূলধারার রাজনৈতিক দল আছে। তাদের সঙ্গে জামায়াতে ইসলাম, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিরও বেশ কিছু নেতার যোগসাজশ রয়েছে। ২০১৩ সালেও ছিল, চলতি বছরেও আছে।
মাহবুব আলম বলেন, লন্ডন থেকে ওলামা দলের এক নেতা হেফাজত নেতাদের পক্ষে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা তৈরি করছেন। হেফাজতের নেতাদের এখানে নাকি হিন্দু লোকজন জেরা করছেন। কোরআন নাকি ফেলে দেওয়া হয়েছে টয়লেটে। মামুনুল হককে নাকি প্র’হার করা হচ্ছে- ইত্যাদি বিভিন্ন অপপ্রচার হচ্ছে।
এই মিথ্যা অপপ্রচার তাদের কৌশলেরই অংশ। দেশেও জামায়াত শিবিরের সঙ্গে জড়িত অনেকেই এটা করছেন যারা ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
সরকার পতনের বিষয়ে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে কী চুক্তি হয়েছে- এ প্রশ্নের উত্তরে ডিবি যুগ্ম কমিশনার বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত এখনও সম্পন্ন হয়নি। তাদের সঙ্গে সর্বশেষ কোনো গোপন মিটিং হয়েছে, নাকি ২০১৩ সালের মিটিংয়ের ধারাবাহিকতায় তারা কাজ করছেন, সেগুলোর বিষয়ে এখনো তদন্ত চলছে।
জেরায় তারা স্বীকার করেছেন, সবারই স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় এখানে রয়েছে। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সারা দেশে যে না’শকতা হয়েছে এ বিষয়ে তার বলছেন, হেফাজত ছাড়াও আরও বহুলোক এখানে রয়েছে।
হেফাজতের অর্থের জোগানদাতা কারা, এ বিষয়ে মাহবুব আলম বলেন, তারা (হেফাজত নেতারা) বলেছেন বাইরে থেকেই বেশির ভাগ অর্থ আসে। রাজনৈতিক দল থেকে এ সময় কোনো ফান্ড নেওয়া হয়েছে কি না, এ ধরনের কোনো বিষয় এখনো পাওয়া যায়নি।
এবার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাইরে থেকে অর্থ এসেছে কি না, সে বিষয়ে তিনি বলেন, এটা নিয়েও তদন্ত চলছে, বিস্তারিত জানা যাবে কিছুদিনের মধ্যেই। তাছাড়া অভিযান চলমান আছে, যতক্ষণ পর্যন্ত না’শকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং ইন্ধনদাতারা গ্রেপ্তার না হচ্ছে।