মাফিয়াদের রাজ্য ধ্বংস হলো ১০ বাংলাদেশির বীরত্বে!

0

প্রবাস ডেস্ক:

দশ বীর বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এক অনন্য সাহসিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন ইতালির সিসিলি দ্বীপের রাজধানী পালেরমোতে। তাদের সংঘবদ্ধ প্রতিবাদের মুখে সেখানকার পুলিশ স্থানীয় এক মাফিয়া সর্দারকে জেলে নিয়েছিল ২ বছর আগে। পুলিশের অভিযানের ধারাবাহিকতায় গত মাসে ধরা পড়ল মাফিয়া বসদের বস হিসেবে পরিচিত ৮০ বছরের সেত্তিমো মিনেও। তার ৪৫ সহযোগীকেও আটক করেছে পুলিশ।

মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্যে দুর্ধর্ষ অপরাধীদের কোণঠাসা করার কৃতিত্ব বাংলাদেশি দোকানিদের— এমন দাবি গণমাধ্যমের। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশি দোকানিদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে মাফিয়াদের বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের কথা।

পালেরমোর বাল্লারো বাজারে সবজি ও মসলার দোকান আছে আনোয়ার হুসাইন আহমেদের। তার দোকানের কাছেই গাম্বিয়ার এক অভিবাসীকে গুলি করেছিল স্থানীয় এক মাফিয়া সর্দার। ঘটনাটা দুই বছর আগের। এর প্রতিবাদে জোট বেধেছিলেন বাংলাদেশি ১০ দোকানি। আফ্রিকার কিছু অভিবাসীও তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এত দিন মুখ বুঁজে মাফিয়াদের সব অত্যাচার সয়েছেন তারা, নিয়মিত চাঁদা দিয়ে গেছেন। চাঁদাকে স্থানীয়রা বলে নিরাপত্তার মাসুল। চাঁদা না দেওয়া মানে দোকান লুট।

তবে এ ঘটনার পর বেঁকে বসলেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। তারা চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। মাফিয়াদের সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে আদালতে।’ এ জন্য হুমকিও এসেছিল, জীবনের ঝুঁকিও ছিল। তাদের দোকানের তালায় সুপারপ্লু দিয়ে আটকে দেওয়া হলো। তবু তারা অনড়। এর আগে নানা ঘটনায় পুলিশের কাছে গিয়ে প্রতিকার পাননি তারা। তাই এবার নিজেদের পাশে নিজেরাই দাঁড়ালেন। সিসিলির কর্তৃপক্ষ মাফিয়াদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করে। তবে তীব্র প্রতিবাদের মুখে তারা তৎপর হলো। গুলি করেছিল যে মাফিয়া দস্যু, তাকে আটক করতে বাধ্য হলো পুলিশ।

তবে ইতালির দুর্ধর্ষ মাদক-অস্ত্র কারবারি এই মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্যে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বা পুলিশ নয়; তাদের কঠিন প্রতিপক্ষ হলো নিরীহ কিছু অভিবাসী, যাদের নেতৃত্বে ১০ বাংলাদেশি। ঘটনার বিবরণ দেন বাংলাদেশিদের একটি সমিতির প্রধান তফাজ্জল তপু। দুই বছর আগে তারা চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে, হুমকি-অরাজকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরের আগ পর্যন্ত মামলা নিতে চাইল না পালেরমোর পুলিশ। আদালতে সেই মামলা এখনো ঝুলছে। এর মধ্যে অবশ্য গাম্বিয়ার অভিবাসীকে গুলি করার দায়ে অভিযুক্ত মাফিয়া সর্দারের ১২ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে গত নভেম্বরে। তবে পুলিশ দয়া করে মামলার বাদীদের পরিচয় গোপন রেখেছিল। কারণ ইতালিতে তাদের বিরুদ্ধে বাদী পাওয়া প্রায় অসম্ভব। মাফিয়া বসদের বিরুদ্ধে মামলায় শুনানি করায় আইনজীবীদের প্রাণ হারাতে হয়েছে সেখানে।

বাল্লারোয় ২০ বছর ধরে আছেন বাংলাদেশের আহমেদ। তার দুই ছেলে, এক মেয়ে। দোকান দিয়েছেন ৫ বছর আগে। তার দোকানের সামনের রাস্তায় প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হয়। মোটরসাইকেলে করে নিষিদ্ধ মাদকের প্যাকেট সরবরাহ করে মাফিয়ার লোকরা। কারো কিছু বলার নেই। আহমেদ বলেন, ‘এখানে থাকতে হলে মাফিয়া বসদের খুশি রাখতে হবে। নইলে তারা দোকান লুট করবে।’

ভূমধ্য সাগরের সবচেয়ে বড় এই দ্বীপের ৫০ লাখ অধিবাসীর পৌনে দুই লাখই অভিবাসী, যারা মূলত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে এসেছে ইতালির নাগরিকত্বের সোনার হরিণের আশায়। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভারত, চীন থেকেও এসেছে অনেকে, ভাগ্য গড়তে।

মোহাম্মদ মিয়া দিনে বাসায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রাতে পালেরমোর রাস্তায় সস্তা ইলেকট্রনিক পণ্য বিক্রি করেন। তিনি জানান, অনেক ছোটখাটো ঘটনার প্রতিকার পাননি পুলিশের কাছ থেকে। এবার তাঁরা নিজেরাই নিজেদের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন দল বেঁধে।

মাসে ৫/৬শ ইউরো রোজগার করতেও কষ্ট হয়, তবু যদি ইতালির নাগরিকত্ব বা আইনগত সুবিধা কিছু মেলে— এ আশায় মাফিয়ার ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এখানে থেকে গেছেন তার মতো আরো অনেকে।

এর মধ্যে সুমি ডালিয়া আক্তার সিসিলিতে প্রথম বাংলাদেশি, যিনি এখানকার রাজনীতিতে সক্রিয় থেকে ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ‘বিদেশি হিসেবে আমরা ইতিমধ্যে আমাদের সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছি। আমরা মাফিয়া ও পিজোর (চাঁদা) বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছি’— গর্বের সঙ্গে জানালেন সুমি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মাফিয়াবিরোধী সংগঠনের এক সদস্য এডোরাডো জাফুটো বলেন, আগে দু-একজন বিচ্ছিন্নভাবে অভিযোগ করত, পুলিশ গা করত না। এবার দোকানিরা সংঘবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করেছে, আর এ বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছে স্থানীয়দের কেউ না, বাংলাদেশ থেকে আসা কয়েকজন ব্যবসায়ী।

শেয়ার করুন !
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!