সময় এখন ডেস্ক:
বাংলা সংগীত জগতের কিংবদন্তি গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও মুক্তিযোদ্ধা ইমতিয়াজ বুলবুল চলে গেলেন। ভোর ৪টা ১৫ মিনিটে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। তার ছেলে সামির আহমেদ বাবার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।
মৃত্যুর আগে কয়েকটা বছর ছিলেন গৃহবন্দি। কেন এমন একজন মানুষের গৃহবন্দি থাকতে হবে? বুলবুলকে নিয়ে অনেকের মনে এখন এই প্রশ্ন।
যুদ্ধাপরাধী কুখ্যাত রাজাকার গোলাম আযমের মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী ছিলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। অনেকেই যেখানে টাকা আর জীবনের হুমকিতে স্বাধীনতা বিরোধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে সাক্ষী দিতে চাননি, সেখানে বুলবুল চুপ থাকতে পারেননি। বীরত্বই দেখিয়েছেন তিনি। তিনি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বলেছেন সত্যের কথা বলতে, ন্যায়ের পক্ষে রাষ্ট্রের হয়ে। মৃত্যু তাকে ভয় দেখাতে পারেনি।
কিন্তু এই সাক্ষ্য দেয়ার বিনিময়ে অনেক চড়া মূল্যই দিতে হয়েছে তাকে। ছোট ভাইকে হারিয়েছেন। রাস্তার পাশ থেকে গলাকাটা লাশ উদ্বার হয়েছে তার। ভাইয়ের শোক নিয়ে ঘর থেকেই বের হতেন না গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। নিরবে নিভৃতে কাটিয়েছেন জীবনের শেষ দিনগুলো। এর মধ্যে নানা সময়ে আসে তার মৃত্যুর হুমকি। সরকারি নিরাপত্তার বলয়ে বাঁধা পড়েন তিনি। বাসায় থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার হৃদযন্ত্রে ৮টি ব্লক ধরা পড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
প্রায় ৬ বছরের গৃহবন্দি জীবন নিয়ে হাঁপিয়ে উঠছিলেন এই কিংবদন্তি। তার সঙ্গী বলতে ছিল একমাত্র পুত্র সামির ও একান্ত সহকারী রোজেন। গানটাও নিয়মিত করতে পারতেন না বন্দি থাকা অবস্থায়। গানের মানুষদের সাথেও আড্ডা বা মেলামেশা কমে গিয়েছিল।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং গুণী সঙ্গীতজ্ঞের জন্ম ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায়। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বুলবুল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাইফেল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন রণাঙ্গনে। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ স্মৃতি বিস্মৃতি নিয়ে বহু জনপ্রিয় গান লিখেছেন এবং সুর করেছেন।
‘সেই রেল লাইনের ধারে’, ‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘এই দেশ আমার সুন্দরী রাজকন্যা’, ‘আয় রে মা আয় রে’, ‘উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম’, ‘মাঝি নাও ছাইড়া দে’, ‘ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেবনা’- এমন বহু কালজয়ী গানের স্রষ্টা এই শিল্পী। সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদি, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনক চাঁপা-সহ বাংলাদেশী প্রায় সকল জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পীদের নিয়ে কাজ করেছেন তিনি।
তিনি প্রেমের জন্য লিখেছেন- আমার সারা দেহ খেও গো মাটি, ভাড়া কইরা আনবি মানুষ, প্রেমের তাজমহলসহ আরও বহু জনপ্রিয় গান।
তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে সমাদৃত। সত্তর দশকের শেষ থেকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, সংগীতশিল্পে তার ভূমিকা ছিল অনবদ্য। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, দুইবার করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। তিনি স্বাধীনভাবে গানের অ্যালবাম তৈরি করেছেন এবং অসংখ্য চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। তিনি তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করে দুই বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, এগারো বার বাচসাস পুরস্কার সহ বিভিন্ন পুরস্কার পান। এর মধ্যে উল্লেখ্য নয়নের আলো, মরনের পরে, সহযাত্রী, তেজি, আম্মাজান ইত্যাদি।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় গণমাধ্যমে বুলবুল হতাশ হয়ে বলেছিলেন, ‘আমার গৃহবন্দি জীবন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বন্দিত্ব এখন আর বাধা দেয় না। আমি জানি হার্টের চিকিৎসার পর আবার কিন্তু এই চার দেয়ালের মধ্যেই আসতে হবে। এটা কিন্তু সমাধান না। তাই না? আপনারা হার্টটা ঠিক করে আবার এই জায়গাটায় পাঠিয়ে দেবেন, হার্টটা আবার নষ্ট হবে। আপনারা মুক্ত করে দেন। আমি তাহলে বেঁচে যাই।’
বুলবুল আর মুক্তির আকুতি করবেন না। মৃত্যু তাকে চিরমুক্তি দিয়েছে।