খুলনা সংবাদদাতা:
নানাজনে নানাভাবে শখ পূরণ করেন। তবে সুন্দর ভাবনা লালনকারী এক নরসুন্দর তার শখ পূরণ করেছেন সেলুনে পাঠাগার গড়ে। কষ্টার্জিত টাকা জমিয়ে থরে থরে সাজিয়েছেন বিখ্যাত মনীষীদের লেখা বই। যা এলাকাবাসীর মন কেড়েছে।
ব্যক্তিগতে এই পাঠাগারটি গড়ে আলোচনায় এসেছেন খুলনার বটিয়াঘাটা বাজারের সেলুনের মালিক মিলন শীল। মিলন শীলের বাড়ি ওই উপজেলার হেতালবুনিয়া গ্রামে। তিনি যে সেলুনে কাজ করেন, ১৯ বছর আগে সেটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার বাবা। আর ১৩ বছর আগে বাবার হাত ধরে ওই সেলুনের দায়িত্ব নেন মিলন।
মিলন বলেন, নিত্যনতুন বইয়ের জন্য পড়ুয়ারা তার সেলুনে আসেন। ইন্টারনেটের এ যুগেও তার পাঠাগারটিতে বই পড়ার প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে। এলাকার অনেকেই বই কিনে পড়তে পারেন না। তাদেরও চাহিদা মেটাচ্ছে এই পাঠাগার।
নরসুন্দর মিলন বলেন, তার পাঠাগারটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে অনেক লেখকের ৩শটিরও বেশি বই শোভা পাচ্ছে। কিছু বই মিলন নিজ উদ্যোগে কিনেছেন। আর কিছু বই বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন। সেলুনে কেউ চুল কাটাতে বা অন্য কোনো কাজে আসলে সময় কাটানোর জন্য তাকে ধরিয়ে দেয়া হয় বই। সেখানে বসেই বই পড়া যায়। আবার চাইলে একটি খাতায় নাম, ঠিকানা লিখে বই বাড়িতেও নিতে পারেন পাঠক।
পাঠাগার গড়ার স্বপ্ন বলতে গিয়ে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন মিলন। জানালেন, আর্থিক সংকটের কারণে ৪র্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে কাজে ঢুকে পড়তে হয়। সেলুনে প্রতিদিন রাখা হতো সংবাদপত্র। প্রতিদিন অবসর সময়ে ওই সংবাদপত্র পড়তাম। ধীরে ধীরে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় তার। এক বন্ধুর কাছ থেকে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মেজদিদি’ বইটি নিয়ে পড়ে খুব ভালো লাগে। এরপর নিজে কিনে বা বন্ধুদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করে পড়া শুরু করি। বই পড়ার আগ্রহ দেখে সবাই আমাকে বই দিতে থাকে। এভাবে অনেক বই হয়ে যায়। তখন ভাবি এ বইগুলো সবাইকে পড়তে দিলে ভালো হয়।
সেলুন চালানো আর বই পড়ার মাঝে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশও করেছেন মিলন। জানালেন, উপজেলায় কোনো গ্রন্থাগার নেই। যার কারণে সেলুনে সব সময় বইপ্রেমীদের ভিড় থাকে। অনেকেই এখানে বসে বই পড়েন আবার অনেকে খাতায় নাম লিখে বাড়িতে নিয়ে যান।
তিনি আরো বলেন, পুরোনো লেখকদের বই পড়তে আমার খুব ভালো লাগে। তাই এই বইগুলো বেশি সংগ্রহ করেছি।
সেলুনের মধ্যে ছোট পাঠাগার গড়ায় ২০১৬ সালে ঘুম ভাঙানিয়া নামের স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন মিলন শীলকে শুভেচ্ছা স্মারক উপহার দেয়। বাংলাদেশ বেতার ঢাকা কেন্দ্রের কণ্ঠযোদ্ধা মাজহারুল ইসলাম প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে তার হাতে ওই স্মারক তুলে দেন।
সেলুনে বই পড়তে আসা সজিব বলেন, নবীন-প্রবীণেরা চায়ের দোকানের আড্ডায় অবসর সময় না কাটিয়ে অনেকে এখন মিলনের পাঠাগারটিতে আসেন। বই পড়ে বিভিন্ন বিষয় সস্পর্কে জানা যেন নেশা হয়ে গেছে।
অন্য পাঠক কামরুল বলেন, এ উপজেলায় কোনো গ্রন্থাগার না থাকায় বই পড়া থেকে বঞ্চিত ছিলাম। বই পড়ে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানতে খুব ভালো লাগে। এ কারণে সেলুনে এসে বই পড়ি। মাঝে মধ্যে বাসায় নিয়েও পড়ি। আমরা বাসায় বই নিয়ে গেলে পরিবারের যারা সেলুনে আসতে পারে না তারাও বই পড়ার সুযোগ পায়। মিলনের এ সেলুনের মাধ্যমে এলাকার সবার বই পড়ার অভ্যাস তৈরি হচ্ছে।
ওই গ্রামের এম রহমান বলেন, স্থানীয় ব্যক্তিদের অনেকের অঢেল অর্থবিত্ত আছে, তবে বটিয়াঘাটার বিত্তবানেরা কেউ বই পড়ার উদ্যোগ নেননি। অথচ মিলনের মতো গরিব মানুষ পাঠাগার গড়ে জ্ঞান বিতরণের সুযোগ তৈরি করেছেন। সেলুনে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মিলন মহৎ উদ্যোক্তার পরিচয় দিয়েছেন। আমরা সবাই তার সাফল্য কামনা করি।
প্রতিবেদনটি তৈরী করেছেন- শরীফা খাতুন শিউলী