প্রবাস ডেস্ক:
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্ব জনসংখ্যার (২৫৭ মিলিয়ন) ৩.৪% জনগণ জীবিকার তাগিদে নিজ দেশে ছেড়ে অন্য দেশে বাস করছে। আর এই প্রবাসীরাই প্রতিনিয়ত নীরবে নিজ নিজ দেশের জাতীয় আয়ে রেমিট্যান্স যুক্ত করে আসছে। আর এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের একটি বড় অংশ জুড়ে আছে নারী শ্রমিকরা। যাদের একটি বৃহত্তর অংশ পরিবারের অভাব মোচনের স্বপ্ন বুকে নিয়ে পারি জমাচ্ছে মধ্যপ্রাচেরের দেশগুলোতে। শুধু যে পরিবারের স্বপ্ন পূরণ করতে হচ্ছে তা নয়। পুরুষ প্রবাসী শ্রমিকদের পাশাপাশি অবদান রাখছেন দেশের রেমিট্যান্স।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ এ শুধু মাত্র বাংলাদেশ থেকে ৭ লাখ ৩৪ হাজার কর্মী কাজের উদ্দেশ্য বিদেশ গিয়েছেন। আর এদের মধ্যে ১ লাখ ১ হাজার ৬০৯ জন নারী কর্মী।
বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাওয়া শতাধিক শ্রমিক কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন; যাদের ৮১ জনই নারী। শুধু ২০১৮ সালেই সৌদি আরব থেকে ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক বাংলাদেশে ফেরত এসেছেন। দালালদের প্রতারণার শিকার হয়েছেন, এক ধরণের কাজের আশা দেখিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য কাজে বাধ্য হয়েছেন বা কর্মক্ষেত্রে নির্যাতন, প্রতারণার শিকার হয়েছেন; ফেরত আসা শ্রমিকদের অধিকাংশের গল্পটাই এরকম।
এ সপ্তাহে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের কয়েকজন বিবিসি’র সাথে আলাপকালে তুলে ধরেন তাদের গল্প। মৌলভীবাজারের বাসিন্দা আমেনা বেগম (ছদ্মনাম) সৌদি আরবের রিয়াদে প্রায় দেড় বছর ছিলেন, যার মধ্যে ৫ মাসই তাকে কাটাতে হয় পুলিশের হেফাজতে।
আমেনা বেগম জানান, যে বাসায় কাজ করতে গিয়েছিলেন, সেখানে যৌন প্রস্তাবে সম্মত না হওয়ায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। যৌন প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় টানা ৩ দিন আমাকে খেতে দেয়া হয়নি। একপর্যায়ে মেরে হাত ভেঙে দেয়া হয় এবং বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়। তারপর বাসার সামনে গভীর রাতে পুলিশ আমাকে পায় এবং থানায় নিয়ে যায়। পরবর্তীতে চিকিৎসা দেয়ার পর সেখানকার এজেন্টের মাধ্যমে তাকে আবারো ওই বাড়িতেই ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়।
সেখানে ফিরে যাওয়ার পর আবারো বেশ কিছুদিন তার উপর শারীরিক অত্যাচার এবং যৌন নির্যাতন চলে বলে জানান তিনি। শারীরিক অত্যাচারের পর একপর্যায়ে তাকে আবারো একদিন রাতে বাসা থেকে বের করে দেয়া হলে পুলিশ তাকে বাসার সামনে খুঁজে পায় এবং পরবর্তীতে পুলিশের হেফাজতে নেয়া হয় তাকে। পরে পুলিশের হেফাজত থেকেই দেশে ফেরার ব্যবস্থা হয় তার।
২৫ বছর বয়সী এই নারী দালালের মাধ্যমে সৌদি আরব যাওয়ার পর গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন। যদিও যাওয়ার আগে তার কাছে গোপন করা হয়েছিল যে গৃহকর্মীর কাজের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে।
আমেনা বলেন, ‘আমাকে শারীরিক নির্যাতন করা তো হতোই, নিয়মিত খাবারও দেয়া হতো না। আর আমি যে ১ বছর কাজ করেছি তার মধ্যে আমাকে কেবল ২ মাসের বেতন দেয়া হয়েছে; তাও আংশিক।’
আমেনা বেগম জানান, সৌদি আরব যাওয়ার জন্য দালালকে ১ লক্ষ টাকা দিতে হয় তাকে। কিন্তু সেখান থেকে ফেরার সময় তাকে ফিরতে হয় খালি হাতে। বাবা-মা সুদে টাকা ধার নিয়ে আমাকে সৌদি পাঠিয়েছিল। সেখানে সব নির্যাতন, অত্যাচার সহ্য করেও কাজ করতাম টাকার জন্য। কিন্তু টাকা চাইলেই আমার ওপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হতো। ১ বছর কাজ করলেও শেষপর্যন্ত ২ মাসের আংশিক বেতন দেয়া হয় আমাকে।
আমেনা বেগমের সাথে ফেরত আসা নারীদের একজন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার ফাতেমা বানু (ছদ্মনাম)। সৌদি আরবে তার গল্পটাও অনেকটা একই রকম।
গৃহকর্মীর কাজ করতে গিয়ে একপর্যায়ে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেও তার চিকিৎসা করাতে অস্বীকৃতি জানায় গৃহকর্তা। এরপর তাকে জোর করে মাদক সেবন করিয়ে ঘরে আটকে রাখা হয়। মাদক সেবনের কারণে একপর্যায়ে তার মানসিক সমস্যাও তৈরি হয় বলে জানান এই নারী।
বিবিসি বাংলা