কক্সবাজার সংবাদদাতা:
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের শারীরিক গড়ন, ভাষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-আচরণ স্থানীয়দের সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে। আর এ সুযোগে রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুরা সহজেই স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক হিসাবে জানা গেছে প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। এদিকে ক্যাম্প থেকে পালাতে গিয়ে ধরেও পড়েছে বেশ কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থী।
রোহিঙ্গাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ (আইএসসিজি) সূত্রে জানা গেছে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে বায়োমেট্রিক পদ্ধতির আওতায় আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা রয়েছে ১১ লাখ ১৮ হাজার। অথচ বর্তমানে শিবিরে রোহিঙ্গার হদিস মিলছে ৯ লাখ ১৫ হাজার। আরও ২ লাখ রোহিঙ্গার কোনও হদিসই নেই!
বেশ কিছু রোহিঙ্গা পালাতে গিয়ে ধরা পড়ার পর বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে শিবির পালানোর প্রবণতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো উদ্যোগ নিলেও বাস্তবে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে মিশে গিয়ে তারা পালিয়ে গেলে সবাইকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না।
কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শিবিরের তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাসহ দেশি-বিদেশি এনজিওকর্মীরাও।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনসহ রোহিঙ্গা শিবির তদারকির দায়িত্বে থাকা সরকারের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম জানিয়েছেন, শিবিরে আশ্রয় নেয়া বেশ কিছু রোহিঙ্গার খোঁজ মিলছে না।
মাছের ড্রামে রোহিঙ্গা পাচার: ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে
উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের অনেকেই উন্নত জীবনের আশায় দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রিক্সা চালানো, গার্মেন্টস বা বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করে স্থায়ী বসবাসের লোভে গোপনে ক্যাম্প ত্যাগ করছে।
গত মাসে ট্রাকে মাছ সরবরাহে ব্যবহৃত ড্রামের ভিতরে অবস্থান নিয়ে সড়ক পথে পালানোর সময় সেনা বাহিনী ও পুলিশের পৃথক অভিযানে ২৫ জন রোহিঙ্গা আটক হয়েছে। ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে এই রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্প কেন্দ্রিক এদেশিয় এবং পুরনো রোহিঙ্গা দালালরা মালয়েশিয়া পাড়ি জমানোর জন্য রোহিঙ্গাদের উদ্বুদ্ধ করছে। গত মাসের প্রথম সাপ্তাহে বিজিবি সদস্যরা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ চরাঞ্চল থেকে ১৯ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে হস্তান্তর করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তারা দালালের সহায়তায় ক্যাম্প ত্যাগ করেছিল।
ছবি: মাছের ড্রামে করে রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে ক্যাম্প ছেড়ে
কুতুপালং ক্যাম্পের ১২নং ব্লকে কর্মরত এনজিও সংস্থা ইপসার এক কর্মকর্তা গত ১৩ জানুয়ারি সকালে উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জকে অবহিত করে বলেছেন, বেশ কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা যে কোনও সময়ে ক্যাম্প ত্যাগ করতে পারে। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তিনি পুলিশ প্রশাসনের সহযোগিতা কামনা করেছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইপসার ওই কর্মকর্তা প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।
এদিকে কুতুপালং রেজিষ্ট্রার্ড ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা রশিদ আহমদ রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প পালানোর বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, নিবন্ধনের পরে এসে বাংলাদেশে প্রবেশকারী কিছু রোহিঙ্গা আছে যারা এখনও তালিকাভুক্ত হয়নি। তাই তারা সরকারিভাবে প্রদত্ত ত্রাণ সামগ্রীও পায়না। এই রোহিঙ্গারা জীবন-জীবিকার তাগিদে ও উন্নত জীবন যাপনের আশায় ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে।
তিনি বলেন, সীমিত একটি জায়গায় প্রায় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। এই রোহিঙ্গাদের কে, কখন, কোথায় যাচ্ছে তার কোন নজরদারি নেই। কিছু রোহিঙ্গা শহরের গার্মেন্টসে অথবা বিভিন্ন কাজের সন্ধানে গোপনে ক্যাম্প ছাড়ছে। অনেকেই বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী বসবাসরত (পুরনো রোহিঙ্গা) আত্মীয় স্বজনের আহ্বানে ক্যাম্প ছেড়ে পালাচ্ছে।
কুতুপালং ক্যাম্প ইনচার্জ রেজাউল করিম জানান, রেজিষ্ট্রার্ড ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প পালানোর কোন সুযোগ নেই। যে রোহিঙ্গারা নতুন করে এসে বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে, তারাই মূলতঃ সু-কৌশলে ক্যাম্প ছেড়ে অন্যত্রে চলে যাচ্ছে। টাকার বিনিময়ে এদেরকে সহায়তা দিচ্ছে কিছু এদেশিয় দালাল।
উখিয়া থানা অফিসার ইনচার্জ মোঃ আবুল খায়ের জানান, সড়ক পথে ৪টি পুলিশ চেকপোষ্ট দিয়ে বিশাল রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণ করা পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও যেসব রোহিঙ্গা পালাতে গিয়ে ধরা পড়ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী জানান, বর্তমান সরকারের দক্ষতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হলে ক্যাম্প পালানো রোহিঙ্গাদের খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনকে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প পালানো প্রবণতা প্রতিরোধে আরো সোচ্চার হওয়ারও আহ্বান জানান।