বাংলাদেশি ইউজারদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছে ফেসবুক!

0

মুক্তমঞ্চ:

নোটিফিকেশনটা পেয়েই চমকে গেলাম! আমাকে ফেসবুক মেসেঞ্জারেও ব্যান করা হয়েছে। ৩ দিনের এ নিষেধাজ্ঞার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে- আমি অনেক মেসেজ চালাচালি করি এবং আমার মেসেজ ফেসবুকের সামাজিক বিধিমালা লঙ্ঘন করেছে!

এটা একটা চমকানোর মতো খবর এবং আতঙ্কিত হওয়ার মতোও। ইনবক্সে অনেক ধরনের মেসেজ চালাচালি হয়। দেশ থেকে বই আনাবো, আমি কোথায় থাকি সে বাসার ঠিকানা ইনবক্সে দিই। আমার টাকা দরকার, ল্যাপটপ দরকার, আমি আমার ব্যাংকের ইনফরমেশন দিই। এক অসুস্থ বন্ধুর চিকিৎসার জন্য সরকারি অনুদান পেতে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করি। কোথাও বেড়াতে যাবো, সেটার পুরো আইটেনারি বা সফরসূচি লিখে দিই।

এ তথ্যগুলা স্পর্শকাতর, গোপনীয়। আর তা যদি ভুল মানুষের হাতে চলে যায় আমি নানাভাবে বিপদগ্রস্ত হতে পারি। আমার জীবন নিয়ে সংশয়ও হতে পারে। আমার যাবতীয় গোপন তথ্য, নথিপত্র ক্লোন হতে পারে এবং এ সংশয় নেহাতই অমূলক না। কেনো সেটা বুঝতে পেছনের কিছু ঘটনা জানানো আবশ্যক।

বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এবং স্বাধীনতাপক্ষের শক্তি হিসেবে পরিচিত অ্যাক্টিভিস্টরা ফেসবুকে অনেকদিন ধরেই বিপন্ন। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে গেছে যে মনে হতে পারে এদের তালিকা করে চিহ্নিত করা হয়েছে তারপর তাদেরকে হেনস্তা করা হচ্ছে। এই হেনস্তার ধরনটা কী? ফেসবুকে নিষিদ্ধ করা। আপনি সাম্প্রদায়িক শক্তি কিংবা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লেখেন, আপনার পোস্ট ডিলেট করে আপনাকে ব্যান করা হবে। আপনি বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের ছবি দেন, সে ছবি মুছে দেওয়া হবে। আপনি সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি দেন, সেটা ভায়োলেন্স হিসেবে চিহ্নিত করে মুছে দেওয়া হবে।

প্রবাসী শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম গল্প বুড়োর আসর নামে একটা অ্যানিমেশন সিরিজ শুরু করেছিলেন। ছবি এঁকে বাচ্চাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতেন। সেই সিরিজের জন্য ফেসবুকে তাকে ব্যান করা হয়েছিল। পোস্টগুলা মুছে দেয়া হয়েছিল। কবি আখতারুজ্জামান আজাদ ব্যান হয়েছেন মৌলবাদের বিরুদ্ধে লেখার কারণে! তারপর রয়েছে পোস্টের ‘রিচ’ কমিয়ে দেওয়া।

ধরুন আমার ফলোয়ার প্রায় ৯০ হাজার। পাশাপাশি ৪ হাজারের বেশি বন্ধু। আমার যে কোনো পোস্ট এই ৯৩ হাজারের নিউজফিডে যাওয়ার কথা। কিন্তু যাবে না। খুব বেশি হলে ৫০০ মানুষ একেকটা পোস্ট পড়তে পারবেন। বাকিরা ইনবক্সে প্রশ্ন করবেন- ভাই আপনার পোস্ট পাচ্ছি না। গড়ে দেড় হাজার লাইকের পোস্ট আপনি ৫০ কিংবা ১০০ লাইক পাবেন। এই হেনস্তার মূল অস্ত্র ফেসবুকের কমিউনিটি গাইডলাইন কিংবা সামাজিক নীতিমালা।

কমিউনিটি গাইডলাইন ভালো জিনিস। অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস। এই নীতিমালার অধীনে আপনি ফেসবুকে ঘৃণা ছড়াতে পারবেন না, কাউকে হেনস্তার করতে পারবেন না, বাকস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে যা খুশি লিখতে পারবেন না… ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু আদৌ কি সেগুলা মানা হচ্ছে?

যখনই এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় ফেসবুক রিভিউ করার সুযোগ দেয়। তখন আবার বলে দেওয়া হয় বিভিন্ন দেশের জন্য সে দেশের ভাষাভাষী লোকজনকে ফেসবুক দায়িত্ব দিয়েছে ফেসবুকের নীতিমালা অক্ষুণ্ণ রাখতে। সেটা বাংলাদেশেও। এই লোকজন কিংবা মডারেটররা আদৌ কি তাদের দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে পালন করছেন?

হাজার হাজার উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাবে যে, সেটা তারা করছেন না। যে কোনো নিউজ চ্যানেলের কমেন্ট সেকশনে যান। সাম্প্রদায়িক শক্তির উগ্রতা টের পাবেন। সাম্প্রতিক উদাহরণ। একজন কমেন্টদাতা এটিএন নিউজের প্রেজেন্টারকে ‘জবাই’ করার হুমকি দিয়ে কমেন্ট করেছেন। তার বিরুদ্ধে ফেসবুকে রিপোর্ট করা হলো। ফেসবুক বললো- এখানে নীতিমালা ভাঙা হয়নি। কে দিচ্ছেন এই সিদ্ধান্ত? ফেসবুকের বাংলাদেশের মডারেটররা।

এই তো কিছুদিন আগে আমার এক চিকিৎসক বন্ধুর ফেসবুক আইডি ‘ক্লোন’ করা হলো। তার প্রোফাইলের সব ছবি হুবহু আপলোড করে তার বন্ধু তালিকায় নতুন করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানো হলো। তারপর তাদের কাছে বিপদের কথা বলে টাকা চাওয়া হলো। অনেকে দিলেন। বন্ধু সবাইকে সতর্ক করলেন। পাশাপাশি ফেসবুকে অভিযোগ করলেন- নিদান পেতে। ফেসবুকে জানালো এখানে কোনো নীতিমালা ভাঙা হয়নি! তাহলে কাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন আপনারা?


ছবি: সবচেয়ে বামের পোস্টটি ফেসবুক কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ন্ড লঙ্ঘন হয়েছে বলে ব্যান করেছে। ডানের পোস্টটিতে জবাই করার কথা সরাসরি বলা হলেও এবং ফেসবুকে অভিযোগ করা হলেও ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কোনও ঝামেলা খুঁজে পাচ্ছে না!

আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। ফেসবুকে ১৫ বছর চলছে আমার। গত ৭ বছর ধরে চেষ্টা চালিয়েও ব্লু ভেরিফিকেশন ব্যাজ পাওয়া হয়নি আমার, যেটা রাম-শাম-যদু-মধু যে কেউই সহজে পেয়ে যায়। আমার মুক্তিযুদ্ধের ওপর প্রচুর অ্যালবাম ফেসবুক ডিলেট করে দিয়েছে। ছবির উপর সেনসিটিভ কনটেন্টের পর্দা বসিয়েছে। এ বছর শুরু থেকেই আমাকে ব্যান করার খেলা চলছিল। পরপর ৪ বার আমাকে নানা অজুহাতে ব্যান করা হয়েছে। প্রতিবার আমি রিভিউ নিয়েছি। এরপর ফেসবুক ভুল স্বীকার করে আমার ব্যান প্রত্যাহার করে পোস্ট ফেরত দিয়েছে।

এরপর আমাকে যে পোস্টের জন্য ব্যান করা হলো তা হলো একটা পেজের পোস্ট শেয়ার। এক সাম্প্রদায়িক জঙ্গির তথ্যপ্রমাণ দিয়েছিল ফেসবুকের একটি পেজ। পোস্টটা আমি শেয়ার করেছিলাম। সেজন্য আমাকে ৩০ দিনের জন্য ব্যান করলো ফেসবুক। অথচ পেজের সেই পোস্ট বহাল তবিয়তে আছে! সেটার বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেওয়া হয়নি। দোষ আমার- আমি পোস্ট শেয়ার করেছি। রিভিউ নেওয়ার পর বলা হলো- আমাদের বাংলাদেশি মডারেটররা নিশ্চিত করেছেন ‘আমিই অপরাধী’। তাই শাস্তি বহাল।

সেই একমাসের নিষেধাজ্ঞা শেষ করার কয়দিনের মাথায় আমি আবারও ৩০ দিনের ব্যান। যা এখনও চলমান। এবার রিভিউ করার কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। স্রেফ বলা হলো আমি এর আগে কয়েকবার কমিউনিটি গাইডলাইন ভেঙেছি। এটা কেমন বিচার! এ বছর ৫ বার কমিউনিটি গাইডলাইন ভাঙার অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে। তার মধ্যে ৪ বার ফেসবুক ভুল স্বীকার করে আমার পোস্ট ফেরত দিয়েছে। আর পরের বার অন্যের অপরাধে (!) আমি এক মাসের নিষেধাজ্ঞার শাস্তি মেনে নিয়েছি। তাহলে এটার মানে কী?

তাহলে ফেসবুকের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে কারা নিয়োগ পেয়েছেন? কোভিড পরিস্থিতিতে ফেসবুক অনেক প্রফেশনালকে অব্যাহতি দিয়ে ফ্রিল্যান্সার নিয়োগ দিয়েছে। বাংলাদেশে এরা কারা? জামাত-শিবির কিংবা সাম্প্রদায়িক কিংবা জঙ্গিগোষ্ঠীর কেউ ফেসবুকে অনুপ্রবেশ করেছে কি? তাদের কেউ যদি সুযোগ পায় তাহলে তো বিনে পয়সায় ফেসবুকে সেবা দিবে। কারণ তার কয়েকগুণ পারিশ্রমিক সে পাবে তার আদি সংগঠন থেকে।

মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, প্রগতিশীল অ্যাক্টিভিস্টদের নির্মূল করে সাম্প্রদায়িক শক্তির অধিষ্ঠান এবং পৃষ্ঠপোষকতাই কি তার লক্ষ্য হবে না? এটার ভবিষ্যত ফলাফল কী হবে? সোশাল মিডিয়া বাংলাদেশ চ্যাপ্টার কারা নিয়ন্ত্রণ করবে? কারা আধিপত্য চালাবে? আর এর দায় নেবে কে?

মাননীয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রীর সঙ্গে গত কয়েকমাসে কয়েকবার জুম মিটিংয়ে বসেছি আমরা বিপন্ন অ্যাক্টিভিস্টরা। উনি আমাদের সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ফেসবুকের বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সঙ্গে কথা বলবেন বলেছেন। এরপর তার পোস্ট দেখলাম কিছুই করার নাই টাইপের আত্মসমর্পণমূলক! উনি বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের দায়িত্বপ্রাপ্তের সঙ্গে কথা বলেছেন। উনি ইমপ্রেসড- সে হাওরের মেয়ে, বাংলাদেশকে ভালোবাসে। কিন্তু ফেসবুকের কমিউনিটি গাইডলাইনের কাছে সে অসহায়। তাই তিনিও অসহায়।

আমি অভিযোগ করছি না বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ‘কমপ্রোমাইজড’। তিনি টাকার বিনিময়ে কিংবা প্রভাবিত হয়ে কিংবা তার নিজের, পরিবারের, বন্ধুদের, ঘনিষ্ঠদের ব্যক্তিগত এজেন্ডা বাস্তবায়নে এসব করছেন। কিন্তু যা ঘটছে তার দায় কি তিনি কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের দোহাই দিয়ে পার পেতে পারেন?

বাংলাদেশের মডারেটররা যেভাবে নিজের খেয়াল-খুশিমতো যাকে খুশি ব্যান করে দিচ্ছেন, পোস্টের রিচ কমিয়ে দিচ্ছেন, প্রগতিশীল অ্যাক্টিভিজমের গলা টিপে ধরছেন, অন্যদিক সাম্প্রদায়িকতাকে প্রমোট করছেন, তাদের সুরক্ষা দিচ্ছেন- এসবের দায় কার? এদের অ্যাক্টিভিটি লগবুক চেক করলেই তো বোঝা যাবে এরা কী করছেন। কীরকম ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। এই দায় কি নেবেন বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের দায়িত্বশীল পদাধিকারী?

ফিরে আসি মূল প্রশ্নে। এতদিন ফেসবুকে লেখালেখির কারণে আমাকে হেনস্তা করেছেন। কমিউনিটি গাইডলাইনকে হাইকোর্ট হিসেবে দেখিয়েছেন। কিন্তু আমার ইনবক্সও এখন দেখি আপনাদের থেকে নিরাপদ না। মেসেঞ্জারে কমিউনিটি গাইডলাইন ভাঙা হচ্ছে এমন অভিযোগ করে আমাকে সেখানেও নিষিদ্ধ করছেন। তার মানে আপনাদের নিয়োগপ্রাপ্ত মডারেটরদের কাছে আমার গোপন তথ্যের অ্যাক্সেস আছে।

আমি কীভাবে নিশ্চিত হবো এইসব তথ্য আমার শত্রুদের কাছে প্রকাশ হবে না? কীভাবে জানবো ফেসবুক অ্যাকাউন্টের পর আমার জীবনও বিপন্ন নয়? আমাকে কি ইউরোপিয়ান আদালতে আইনের আশ্রয় নিতে হবে সুরক্ষার জন্য? আপনাদের ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি এবং হেনস্তার জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে আইনের সাহায্য নিতে হবে?

মাননীয় মন্ত্রী আপনার সুপারিশ কী? বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের প্রতিনিধিই বা কী উপদেশ দেবেন?
[বিডিনিউজে প্রকাশিত]

লেখক পরিচিতি: অমি রহমান পিয়াল
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক, ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট।

শেয়ার করুন !
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!