মুক্তমঞ্চ ডেস্ক:
রাজশাহী মেডিকেলের ডিউটি শেষ করে চাঁপাই যাব, বাসের জন্য দাড়িয়ে আছি। হঠাৎ একটা লোকাল বাস দারুণ অফার নিয়ে আমার সামনে হাজির! ‘এই চাঁপাই, চাঁপাই, চাঁপাই, মাত্র ৬০ টাকা ভাড়া…!’ অন্য বাসের ভাড়া ৭০ টাকা, এদের ভাড়া ৬০ টাকা, ১০ টাকা ছাড়, বিশাল ব্যাপার তো! লোকজন দেখছি হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, আমিও তাদের দেখাদেখি উঠে গেলাম। হাজার হোক হুজুগে বাঙ্গালী বলে কথা।
বাসে উঠে ৩ সিটের একটা সিটে কোনো রকমে পশ্চাৎদেশকে যতটা পারা যায় সংকুচিত করে বসে পড়লাম। ডিউটি করে খুব ক্লান্ত, একটু ঝিমুনি আসছে। এদিকে বাসের ড্রাইভার ১ মিনিট চালাতে না চালাতেই হেল্পারের থাবা- “ওস্তাদ ব্রেক”। গাড়ি ১ মিনিট চলে তো ৫ মিনিট থামে, পাবলিকও যেভাবে উঠছে, তাতে মনে হচ্ছে এ-তো বাংলালিংকের বিশাল ছাড়ের থেকে কোন অংশে কম না।
যাই হোক, যথারীতি বাসের চাকায় একটু গতি এসেছে। আসবে না কেন, অলরেডি পুরো বাস লোকে ভরপুর। এতো লোক তুলেছে যে, বেচারা কন্ডাক্টর, হেল্পারেরও বাসে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। আমার পাশের দুই ভদ্রলোক একে অন্যের সাথে পরিচিত হচ্ছেন। বোঝা যাচ্ছে, একটু পরেই শুরু হবে জম্পেশ আড্ডা। অবশেষে দুই যাত্রীর মধ্যে কথোপকথন শুরু:
→ ভাই কোথা থেকে আসলেন?
→ রাজশাহী; পপুলার থেকে ডাক্তার দেখিয়ে।
→ কী দেখলো ঠিকমতো? কী সমস্যা?
→ আর বইলেন না, ২ দিন ধরে এতো কষ্ট করে সিরিয়াল দিয়ে আজকে দেখলাম, ঠিকমতো দেখলোই না, মাত্র ৫ মিনিট দেখেই ৮০০ টাকা ভিজিট নিয়ে নিল!
→ ঠিক বলেছেন ভাই, ডাক্তাররা তো টাকা ছাড়া কিছু বুঝেই না। আমার এক আত্মীয়কে কিছুদিন আগে ঢাকায় দেখিয়ে আসলাম। কথা না শুনেই একগাদা টেস্ট ধরিয়ে দিল! বুঝলেন ভাই, সবই ব্যবসা।
তাদের সাথে আশেপাশের আরো কিছু যাত্রী তাল মেলাচ্ছেন। আমি তো বেকায়দায় পড়ে গেলাম। তাদের কথা শুনেও না শোনার ভান করছি। হঠাৎ করে আমার পাশের যাত্রী আমাকে বলে বসলো- কি ব্যাপার ভাই, আপনি এতো চুপচাপ কেন? কিছু বলছেন না যে?
→ না ভাই, কী বলবো?
→ কী বলবেন মানে? (আশেপাশের লোকজনের সাপোর্ট পেয়ে লোকটি এখন চরম উত্তেজিত) এই যে ডাক্তাররা এতো টাকা ভিজিট নিচ্ছে, এটা কি ঠিক?
হঠাৎ মাথায় একটা দুষ্টু চিন্তা এলো। দেখি তাদের সাথে একটা মনস্তাত্ত্বিক খেলা খেলি, তাদের মাইন্ডটাকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করা যায় কিনা…
→ না না, মোটেও ঠিক না, কেন এতো টাকা নিবে? আর বইলেন না ভাই ঠিক এই কারণেই আমি ডাক্তারি চান্স পেয়েও পড়ি নাই।
→ কী বলেন আপনি? ডাক্তারিতে চান্স পেয়ে, মানুষ বাদ দিয়ে দেয়, এইটা তো আমি জীবনে শুনি নাই (লোকটার ভাবখানা এমন যেন আকাশ থেকে পড়ল)
→ না, এই যে মানুষ ডাক্তারদের এতো গালাগালি করে, এজন্য আমার ডাক্তারি পেশা ভালো লাগে না।
→ কী বলেন, মানুষ কতো কষ্ট করে ডাক্তারি পরীক্ষায় চান্স পায় না, আর আপনি চান্স পেয়ে ছেড়ে দিলেন!
তখন রীতিমত তাদের কাছে আমি ভিন্ন গ্ৰহের কোন এক এলিয়েন হয়ে গেলাম, আশেপাশের লোকজনও আমাকে উঁকি মেরে দেখছে।
জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনার ছেলেমেয়ে কয়টা? কিসে পড়ছে?
→ ২টা মেয়ে। বড়ো মেয়েটা এবার এসএসসি দিচ্ছে।
→ ওকে কী নিয়ে পড়াবেন?
→ চিন্তা করছি ডাক্তারি পড়াবো, ওর ব্রেন অনেক ভালো।
→ আপনি না একটু আগে ডাক্তারদের বদনাম করলেন?
→ আরে ভাই, ঐটা তো কথার কথা। ডাক্তারদের ইনকাম দেখছেন আপনি?
উনার কথা শুনে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। বলতে চাচ্ছিলাম যে, তার মানে আপনি ডাক্তারদের ইনকাম দেখে আপনার মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবেন? কিন্তু আর বলা হলো না। তার আগেই বাস গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেল। আর শুরু হয়ে গেল কন্ডাক্টরের চিল্লাচিল্লি- ‘এই মামা নামেন, নামেন, ওস্তাদ ব্রেক…।’
এভাবেই ওস্তাদ ব্রেক করে যাবে, যাত্রীরা সব নেমে যাবে। ওই ভদ্রলোকটির বড় মেয়ে হয়তোবা একদিন আমার মতো ডাক্তার হয়ে এরকম কোন এক লোকাল বাসে যাবে। তার পাশে বসা অন্য কোন এক ভদ্রলোক হয়তো এভাবেই ডাক্তারদের গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়বে। এটাই হয়তো আমাদের জীবন, এক অদ্ভুত ভিসিয়াস সাইকেল!
লেখক: ডা. আহমেদ শাহরিয়ার হাসান তানভীর
পরিচিতি: ইএমও, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এসএসএমসি, সেশন:২০০৫-০৬