বিশ্ব বিচিত্রা ডেস্ক:
ইউরোপ মহাদেশের অর্ধেকের সমান গ্রিনল্যান্ডের প্রায় পুরোটাই বরফাচ্ছাদিত। যেসব জায়গায় বরফ নেই সেই জায়গাগুলোর মাটিও বেশ শুষ্ক। ফসল ফলানোর উপায় নেই তাতে। নেই গাছপালাও। তাই এখানে জীবন বেশ কঠিন। আয়তনের অনুপাতে দেশটিতে মানুষের সংখ্যাও অনেক কম, মাত্র ৫৮ হাজার।
কিন্তু ধীরে ধীরে অন্যকিছুর জন্যও গ্রিনল্যান্ড পরিচিত হয়ে উঠছে। আর তা হলো- দেশটির খনিজ সম্পদ। শুধু খনিজ সম্পদ বললেও ভুল হবে, বলতে হবে দুষ্প্রাপ্য খনিজ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে দেশটির বরফ যত গলছে, দুষ্প্রাপ্য সেই খনিজ ততই বেরিয়ে আসছে। বহুমূল্যবান সেই খনিজের মধ্যে অন্যতম হলো- নিওডিমিয়াম ও ডিস্প্রোজিয়াম।
দুষ্প্রাপ্য এই খনিজগুলো বাতাস চালিত ঘূর্ণনযন্ত্র, বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং বৈদ্যুতিক অন্যান্য ডিভাইস নির্মাণে অতি প্রয়োজনীয় কাঁচামাল। সারা বিশ্ব এখন জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে বিদ্যুৎশক্তির ওপর আস্থা রাখতে চাইছে। তাই গ্রিনল্যান্ডের ওই দুষ্প্রাপ্য খনিজের প্রতি এখন সব দেশেরই নজর।
এতদিন এই দুটি খনিজের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল চীনের। সারা বিশ্বেই এগুলো এককভাবে চীন রপ্তানি করে। এ অবস্থায় গ্রিনল্যান্ডে ওই খনিজ দুটোর আধিক্য থাকায় সেখানে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে অন্যান্য দেশ আর খনি উত্তোলনকারী কোম্পানিগুলো।
বিশেষ করে পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলো এখনই গ্রিনল্যান্ডের দরজায় টোকা মারছে। বিলিয়নিয়ার বিনিয়োগকারীরা সেখানে বড় বিনিয়োগ করতে চাইছেন। আর খনি কোম্পানিগুলো মত দিয়েছে- শুধু নিওডিমিয়াম ও ডিস্প্রোজিয়ামই নয়, গ্রিনল্যান্ডের মাটিতে নিকেল, কোবাল্ট আর টাইটেনিয়ামেরও অস্তিত্ব রয়েছে। আর হ্যাঁ, আছে স্বর্ণও!
সম্প্রতি দেশটিতে কূটনৈতিক তৎপরতার ওপর জোর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। গত মে মাসে গ্রিনল্যান্ডে এক আকস্মিক সফরে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্থনি জে ব্লিংকেন।
দ্বীপরাষ্ট্রটির ক্ষমতায় আসা নতুন সরকারের সঙ্গে এক আলোচনায় অংশ নেন তিনি। এর আগে গত বছর প্রথমবারের মত গ্রিনল্যান্ডের রাজধানী নুনুকে কনস্যুলেট স্থাপন করে আমেরিকা। এই তৎপরতা যে দেশটির খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
একটি ব্রিটিশ খনি উত্তোলনকারী কোম্পানিও গ্রিনল্যান্ডে নিকেল উত্তোলন করার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। আর বিল গেটস ও জেফ বেজোস কলকাঠি নাড়েন- ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক এমন একটি কোম্পানিও সম্প্রতি সেখানে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে।
তবে খনিজ আহরণের জন্য এইসব দেশ এবং কোম্পানিকে লড়াই করতে হবে গ্রিনল্যান্ডের নারসাক নামে একটি গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ম্যারিয়ান পাভিয়াসিন নামে এক নারী। তিনি ওই গ্রামেরই বাসিন্দা। সম্প্রতি নির্বাচিত হয়ে তিনি গ্রিনল্যান্ডের পার্লামেন্টে সদস্য হয়েছেন। এর আগে একটি হেলিপোর্টে ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করতেন।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে নারসাক অঞ্চলটিতেও। একসময় এই অঞ্চলের খাড়িগুলোতে জমা থাকত বরফের বড় বড় চাই। এখন এসবের দেখা পাওয়াই ভার।
এখানকার বাসিন্দা প্রায় ১ হাজার ৭০০। মূলত মাছ শিকার আর ভেড়া পালনই তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। তবে তারা ইতিমধ্যেই জেনে গেছে, তাদের ভূমিতেই রয়েছে পৃথিবীর বহু মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য দুটি ধাতু।
মিজ পাভিয়াসিন নির্বাচিত হওয়ার আগে এই অঞ্চলে খনি উত্তোলনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল চীনা বিনিয়োগে একটি অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি।
খনি উত্তোলন শুরু হলে নিঃসন্দেহে নারসাকে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে এবং অঞ্চলটির দৃশ্যমান আয়ও বেড়ে যাবে। কিন্তু খনিজ সম্পদ উত্তোলন করলে সেখান থেকে তেজষ্ক্রিয় ইউরেনিয়ামও উৎপন্ন হবে, যা ওই জনবসতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে।
এই ইস্যুতেই নারসাকের বাসিন্দারা পাভিয়াসিনের নেতৃত্বে এক হয়েছে। ২০১৩ সাল থেকেই মিজ পাভিয়াসিন খনি উত্তোলনের বিরোধিতা করে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন।
তিনি বলেন, খনি উত্তোলন করা হলে আমাদের ভাগ্যে কী আছে তা আমি বেশ ভালো করেই জানি। তাই এ ব্যাপারে আমার কিছু করার আছে।
খনি বিরোধিতার জন্যই পাভিয়াসিনকে বর্তমানে সুরক্ষিত বলয়ের মধ্যে থাকতে হয়। কারণ, যে কোনো সময় তার ওপর আঘাত হানতে পারে স্বার্থান্বেষী মহল। গত এপ্রিলে তার বিজয়ে ওই এলাকায় খনি উত্তোলনের প্রচেষ্টা আপাতত থেমে গেছে।