বিশেষ প্রতিবেদন:
বাংলাদেশ ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল টানা ৫ বছর দুর্নীতিতে ছিল চ্যাম্পিয়ন। বিএনপির ভাষ্যমতে বিষয়টা কাকতালীয়, এ সময় অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশ থেকে বেশি দুর্নীতি করেনি। সে কারণেই বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন! অবশ্য বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকোর বিভিন্ন দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে বহির্বিশ্বে লজ্জাজনক এক পরিচিতি পায় বাংলাদেশ। দেশে ব্যাপকভাবে দুর্নীতির কারণে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স (সিপিআই)-এ বাংলাদেশে পরপর ৫ বার দুর্নীতিতে বিশ্বের মধ্যে প্রথম হয়েছিল।
খালেদা জিয়ার শাসনামল সর্বগ্রাসী দুর্নীতিতে ছিল নিমজ্জিত। দুর্নীতিপরায়ণ এই সরকারের শাসনামলে বিশ্ব গণমাধ্যমে এবং স্থানীয় দুই-একটি পত্রিকায় দুর্নীতির কথা প্রকাশ হলেও অধিকাংশ গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করে রাখা হয়েছিল। এ সময় সাংবাদিক খুন ছিল নিয়মিত ঘটনা।
২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতিকে বিএনপির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া এবং সার্বিক সমর্থন দেয়ার খবর প্রকাশিত হতে থাকলে খালেদা জিয়া, তার দুই ছেলে ও অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হয়। ওই সময়েই দুর্নীতির জন্য তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়, যা এখন বিচারাধীন রয়েছে।
খালেদা জিয়া এবং তার দুই কুলাঙ্গার পুত্রের দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ এবং বিভিন্ন অপকর্মের কিছু খতিয়ান তুলে ধরা হলো।
দুর্নীতির বরপুত্র তারেকের মাফিয়া সাম্রাজ্যের শুরুটা যেভাবে:
তারেক রহমান- দুর্নীতির রাজপুত্র কিংবা বরপুত্র। যার সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাট কল্পকথাকেও হার মানিয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তারেক রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয় হিসেবে বনানীর হাওয়া ভবনে বসে দলীয় কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বিকল্প সরকার ব্যবস্থা এবং মাফিয়া সাম্রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন।
এরশাদ সরকারের পতনের পর বিএনপি ক্ষমতায় বসার পরই আসে জিয়া পরিবারে বড় ধরণের পরিবর্তন। তারেক রহমানের ব্যবসায়িক জীবনের শুরু ১৯৯১ সালে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত নৌ পরিবহনের দুটি ব্যবসা ছাড়াও আরো অন্তত ৬টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলেন, যার বাস্তবে কোনো অস্তিত্বই ছিল না। তবে ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে আয় দেখানো হয়। এই আয়ের উৎস কী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তারেকের ব্যবসার অংশীদার ছিলেন গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ওরফে খাম্বা মামুন। ১৯৯৪ সালে মামুনের ছদ্মনামে শিল্প ঋণ সংস্থার প্রতিষ্ঠিত নামমাত্র ১৬ কোটি টাকা মূল্যে তাজ ডিস্টিলারিজ ক্রয় করেন তারেক। এভাবে শুরু হয় তারেকের ব্যবসায়িক জীবন।
২০০১ সালের নির্বাচনে তার সুপারিশে দলের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী বিএনপির দলীয় টিকেট পান। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে দেয়া হয় মনোনয়ন। এমনকি পরে তার সুপারিশেই মন্ত্রীসভার দপ্তর বরাদ্দ করা হয়। তরুণ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রীর মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করতেন তিনি। বড় অংকের সরকারি সব কেনাকাটা করতে হতো তারেকের মাধ্যমে।
২০০১-এর নির্বাচনের পর বিএনপি সরকারের একক কর্তৃত্বের অধিকারী হয়ে ওঠেন তারেক রহমান। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয় হাওয়া ভবন। তারেক, মামুন, খালেদা জিয়ার ভাই সাঈদ ইস্কান্দার ও শামীম ইস্কান্দারসহ গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের কাছে যেনতেনভাবে টাকা উপার্জনই হয়ে ওঠে মুখ্য।
রহমান শিপার্স থেকে ক্রমে প্রতিষ্ঠা হতে থাকে রহমান গ্রুপ, ওয়ান গ্রুপ, রহমান নেভিগেশন, চ্যানেল ওয়ান, ডান্ডি ডায়িং, ইউনিটেক্স এ্যাপারেলস, ক্রিমেন্টাইন লিমিটেড, ক্রোনোটেক্স লিমিটেড, তুরাগ ফিশারিজ, তাজ ডিস্টিলারিজ, দৈনিক দিনকালসহ নামে বেনামে নানা প্রতিষ্ঠান।
জিয়া পরিবার কতটি খাত থেকে মোট কত টাকা গ্রহণ করেছিল এবং কোথায় সম্পদ গড়েছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়ার উপায় নেই। সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত তাজ ডিস্টিলারিজ ক্রয় করা হয়েছিল আবদুল্লাহ আল মামুন এর নামে। এতে তৎকালীন সময়ের হিসাবে সরকারের ক্ষতি হয় অন্তত ১১ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠা করা প্রতিটি কোম্পানির বিপরীতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে ঋণ নেয়া হয়েছিল বিপুল অঙ্কের টাকার।
তারেক রহমান ব্যবসায়ী বন্ধুদের মাধ্যমে বিনা প্রতিযোগিতায় সরকারের কোটি কোটি টাকা লোপাট করেন। এমনকি সরকারের সকল প্রকল্পে তারেক রহমানকে দিতে হতো মোটা অঙ্কের কমিশন। তার নামই হয়ে গিয়েছিল মি. টেন পার্সেন্ট!
জার্মানীর প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিমেন্স এর সকল প্রকল্পে তারেক রহমানকে ঘুষ দিতে হতো ২% অনুপাতে। চীনের হার্বিন কোম্পানীকে একটি প্রকল্পের কাজ পেতে তারেক রহমানকে ঘুষ দিতে হয়েছিল ৭,৫০,০০০ মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশের আবুল মোনায়েম কন্সষ্ট্রাকশন একটি কাজ পেতে তারেক রহমানকে দিয়েছিল ৪৫ লাখ মার্কিন ডলার। এমনকি কাউকে পৃথিবীছাড়া করার ব্যাপারও টাকার বিনিময়ে দফারফা করতেন তারেক রহমান। খালেদার সম্মতিতে বসুন্ধরা গ্রুপের টেলিযোগাযোগ শাখার পরিচালক সাব্বির হত্যায় বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকের কাছ থেকে নেন ১০০ কোটি টাকা। টাকাটা লেনদেন হয় তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এর হাত দিয়ে।
হাওয়া ভবন- সরকারের সমান্তরালে আরেকটি মাফিয়া সরকার:
২০০১ সালের ১ অক্টোবর। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগেই হাওয়া ভবনে বিজয় উদযাপন শুরু হয়ে যায়। হোটেল পূর্বাণী থেকে শেফ আসে, থরে থরে সাজানো হয় দামি বিদেশি মদ। উপস্থিত হন ব্যরিস্টার নাজমুল হুদা, আমান উল্লাহ আমান, ফজলুর রহমান পটল, লুৎফুজ্জামান বাবর, ব্যরিস্টার আমিনুল হকসহ আরো অনেকেই। বড় বড় সিনিয়র নেতা, যারা তারেক রহমানের বাবার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, তারা তারেককে সালাম দিতে দিতে কুঁজো হয়ে যান।
সে রাতেই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্ব নিলামে ওঠানোর ঘোষণা আসে বলে উইকিলিকসের ফাঁসকৃত নথিতে জানা যায়। তবে আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন সিনিয়র কয়েকজন নেতা এর প্রতিবাদ জানান। বিষয়টি খালেদা জিয়া জানলেও তিনি এ বিষয়ে কোনো সাড়াশব্দ করেননি। পরে ৬ অক্টোবর রাতে হাওয়া ভবনে মন্ত্রীসভার পদ নিলাম হয়। ভাগ-বাটোয়ারা হয় দপ্তর। সেই সাথে তারেক রহমানের সাথে চুক্তি হয় নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দেয়ার।
সেই মন্ত্রিসভার সবচেয়ে বড় চমক লুৎফুজ্জামান বাবর। নেত্রকোনার একটি আসন থেকে নির্বাচিত সাংসদ বাবরের অতীত ইতিহাস বড় নোংরা। তিনি বিমানবন্দরের লাগেজ চোরাকারবারি দলের নেতৃত্ব দিতেন। এজন্য তার নাম ছিল লাগেজ বাবর। ১৯৮৬ এবং ৮৮ সালে দুবার গ্রেপ্তারও হন তিনি। তারেক রহমানের আস্থাভাজন এই বাবর বিপুল অর্থের বিনিময়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
তারেককে নিয়মিত হারে ডোনেশন দিতে সক্ষম- এমন বেশ কয়েকজনকে বেছে বেছে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। তবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব কাউকেই দেয়নি তারেক-মামুন গং। হাওয়া ভবনের আগ্রহেই মাহমুদুর রহমানকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা করা হয়। উপদেষ্টা হয়েই মাহমুদুর রহমান খাম্বা প্রকল্প চালু করেন। এই খাম্বার মাধ্যমেই হাজার কোটি টাকা লোপাট করেন তারেক রহমান ও গিয়াস উদ্দিন আল মামুন।
সে সময় দুটি সমান্তরাল সরকারের ক্ষমতা দৃশ্যমান হয়। একটি হাওয়া ভবন সরকার অন্যটি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সরকার। হাওয়া ভবনের পক্ষে সব মন্ত্রণালয়ে একজন করে প্রতিমন্ত্রী রাখা হয়, যারা তারেক রহমানের একান্ত অনুগত। মন্ত্রণালয়গুলোতে দুজন করে মন্ত্রী দিয়ে হাওয়া ভবন এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ক্ষমতার ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা করেন সাবেক দেহরক্ষী এবং ১৯৯১-৯৬ মেয়াদের একান্ত সচিব মোসাদ্দেক আলী ফালুকে। তবে তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হারিছ চৌধুরীকে পছন্দ করেন। হারিছ দীর্ঘদিন ধরে হাওয়া ভবনে কাজ করছেন এবং তারেক রহমানের একান্ত অনুগত। তবে তারেকের কালেক্টর হিসেবেই তার খ্যাতি এবং প্রভাব ছিলো। হারিছ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হওয়ায় হাওয়া ভবনের কব্জায় আসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
এরপর হারিছ চৌধুরী ও তারেক রহমান মিলে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও লাভজনক পদে নিয়োগ দেন আমলা এবং সচিবদের। তবে এভাবে সচিব-আমলাদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে দাঁড়ান প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব নুরুল ইসলাম।
১৯৯১-৯৬ মেয়াদে ফেনীর ডিসি ছিলেন এই নুরুল ইসলাম। সততা ও নিষ্ঠার কারণে খালেদা জিয়া বেশ পছন্দ করতেন নুরুল ইসলামকে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে তাকে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। নুরুল ইসলাম এ সময় তারেক রহমানের দুর্নীতি-অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়টি খালেদা জিয়ার কাছে উত্থাপন করেন। কিন্তু ছেলের ব্যাপারে নালিশ খালেদা জিয়ার পছন্দ হয়নি, তাই তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
নুরুল ইসলামের চাকরিচ্যুতির পর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে বাণিজ্য এবং ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। এই টাকা লেনদেনের প্রধান ব্যক্তিটি ছিলেন হারিছ চৌধুরী। তার মাধ্যমেই নিয়োগ পেতেন আমলা ও সচিবরা।
বিএনপি-জামায়াত জোট এরপর প্রশাসনের পদোন্নতি, টেন্ডার, নিয়োগ থেকে শুরু করে যে কোনো চুক্তি- সবকিছুর ক্ষেত্রেই কমিশন বাণিজ্য শুরু করে। দুর্নীতি এবং লুটপাটের এক মহোৎসব শুরু হয় দেশজুড়ে। সবাই বুঝতে পারে, টাকা ছাড়া কোনো কিছুই হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সমস্ত কর্মকাণ্ডে ১০% ব্যবস্থা চালু হয়। হাওয়া ভবনে ১০% টাকা না দিয়ে কেউ কিছু করার সুযোগ পায় না।
দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে তারেক-মামুনদের নজর পড়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ওপর। এই কমিশন বাণিজ্যের জন্যই ভারতীয় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টাটার সঙ্গে কথা বলা শুরু করে তারা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মাহমুদুর রহমান টাটার সঙ্গে যোগাযোগ করলে বাংলাদেশে আসে টাটার কর্মকর্তারা। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ঘোষণা করেন, টাটা বাংলাদেশে যে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করবে, তার ফলে বাংলাদেশ পাল্টে যাবে।
তবে বাংলাদেশে ব্যবসার বিনিময়ে টাটার কাছে ৫ হাজার কোটি টাকা দাবি করেন তারেক এবং মামুন। এরপরই বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রস্তাব থেকে সরে যায় টাটা। যদিও এ বিষয়ে কোনো কারণ দেখায়নি প্রতিষ্ঠানটি।
নির্বাচনে জয়লাভের জন্য ভারতকে তারেকের মুচলেকা:
২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিজয়ের পেছনে ভারতের সমর্থন ছিলো বলে জানা যায়। নির্বাচনের আগে তারেক রহমান দিল্লিতে গিয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর সঙ্গে বৈঠক করেন। তাতে বিএনপি নির্বাচনে বিজয়ী হলে ভারতের জন্য কী কী করা হবে, সে ব্যাপারে মুচলেকাও দেন। এর প্রেক্ষিতেই ভারত নির্বাচনে সহযোগীতা করেছিলো।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একাধিকবার তাঁর ভাষণে বলেছেন, ২০০১ এর নির্বাচনে ভারতের ‘র’ এর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত জোট গোপনে আঁতাত করেছিলো।
কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর তারেক রহমান জোটের শরিক- পাকিস্থানপন্থী জামায়াতে ইসলামী এবং পাকিস্থানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র ইন্ধনে ইউ টার্ন দেয়। ভারতের সমর্থনে নির্বাচনে বিজয়ী হলেও তারেক রহমান ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন।
আইএসআই থেকে বড় অংকের অর্থ প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে তারেক ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এতে পাকিস্থানের ইন্ধন ছিলো বলে জানা যায়। সে সময় তারেকের প্রধান লক্ষ্য ছিলো বিপুল অর্থ উপার্জন, সেটা যেখান থেকেই হোক না কেন। আর জঙ্গি নেটওয়ার্ক এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে তারেক রহমান আর্থিকভাবে যেমন লাভবান হয়েছিলেন, তেমনি আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করার পরিকল্পনা হাতে নেন।
দশ ট্রাক অস্ত্র আটক এবং ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র:
ভারতের অভ্যন্তরে নাশকতা সৃষ্টি করার মাধ্যমে পাকিস্থানকে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গিদেরকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র সরবরাহের মিশনে নামে হাওয়া ভবন এবং তারেক রহমান। আর সেই মিশনে বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহৃত হতে থাকে। চট্টগ্রাম বন্দর এবং মোংলা বন্দরকে অস্ত্র চোরা কারবারের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
কিন্তু চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র ধরা পড়ে যায় এক সাহসী পুলিশ কর্মকর্তার কারণে। সে ঘটনায় বিএনপি চাপে পড়ে। আর এর ফলে ভারতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কেও ভাটা পড়ে। ২০০২ সাল থেকেই ভারত জানতে পারে, তারেক রহমানের সঙ্গে ভারতীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। তাদের পেছনে পাকিস্থানি গোয়েন্দা সংস্থার মদদ রয়েছে। এ নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের কূটনৈতিক অঙ্গনে একাধিকবার দেনদরবার হয়েছে। কিন্তু বিএনপি এ বিষয়ে পাত্তা দেয়নি।
১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় হাওয়া ভবন এবং বিএনপি সরকারের ষড়যন্ত্রের মুখোশ খুলে যায়। বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী এ ঘটনায় বিএনপির প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে ভারত। তবে কেউ কেউ দাবি করেন, ১০ ট্রাক অস্ত্র পাচারের ঘটনাটি উন্মোচিত হয় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার কারণে। ভারত অস্ত্র পাচারের বিষয়টি জেনে যায়। চট্টগ্রামে দায়িত্বরত এক সৎ পুলিশ কর্মকর্তা গোপনে সেই তথ্য জেনে ট্রাকগুলোকে আটক করেন।
এই ঘটনার সাথে জড়িত ছিলেন, তারেক রহামন, লুৎফুজ্জামান বাবর, রাজাকার মতিউর রহমান নিজামী, রাজাকার আলী আহসান মুজাহিদসহ বিএনপি-জামায়াত সরকারের উর্ধ্বতন অনেক নেতা।
রাষ্ট্রের সকল স্তরে অল তারেক’স মেন:
হাওয়া ভবন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বিএনপি-জামায়াত জোট যেন চিরদিন ক্ষমতায় থাকে, তার কৌশল নির্ধারণ এবং বাস্তবায়নই ছিলো হাওয়া ভবনের প্রধান কাজ। আর এজন্য বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিচারবিভাগসহ সব ক্ষেত্রে নিজেদের অনুগত এবং একান্ত ব্যক্তিগত ব্যক্তিদের বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। শুরু হয় প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর অত্যাচার এবং গুম-খুনের এক মহোৎসব।
প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বিএনপি এবং জামায়াতপন্থী না হলে, তাদের আস্তে আস্তে সব জায়গা থেকে বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর কিংবা অব্যাহতি দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০১ এর অক্টোবর থেকেই। আর যারা সে সময় নিয়োগ পেয়েছেন দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে, আজও তারা টিকে আছে বহাল তবিয়তে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা চালিয়ে যাচ্ছে। নিয়মিত তাদের পদোন্নতি এবং সকল সুযোগ সুবিধাও যোগ হচ্ছে।
অথচ সে সময় প্রশাসনে যারা বিএনপি-জামায়াতপন্থী নয়, তাদেরকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া শুরু হয়। সেনাবাহিনীতে চলে শুদ্ধি অভিযান। দলীয় ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি পদে বসাতে সংবিধান পর্যন্ত সংশোধন করা হয়। সব ক্ষেত্রে বিএনপির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পরও তারেক রহমান ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেনি।
তারেক বুঝতে পারেন, শেখ হাসিনাই হলো জিয়া পরিবারের রাজতন্ত্রের পক্ষে সবচেয়ে বড় বাধা। হাওয়া ভবনের বৈঠকে আলোচনাও হয় এ নিয়ে। ঐ বৈঠকেই তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠরা বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাদের কিনে ফেলা যাবে কিন্তু শেখ হাসিনাকে সম্ভব নয়। শেখ হাসিনা রাজনীতিতে থাকলে বিএনপি কখনই নিরাপদ নয়। আর এই প্রেক্ষাপটেই শেখ হাসিনাসহ দলের প্রধান ব্যক্তিদের সরিয়ে ফেলার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করা হয়।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা:
পাকিস্থানি কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র পরিকল্পনায়, বিভিন্ন ধরণের মারণাস্ত্রের যোগানে, নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পরিকল্পনাটি তৈরি করা হয়। তাতে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি- খন্দকার আব্দুর রশিদ এবং নূর চৌধুরীও।
তবে এই মিশনে সরকারি সংস্থার কোনো কর্মকর্তা বা সদস্য যেন অংশ না নেয়, আগেই সতর্ক করে দেয় তারেক। তাই দায়িত্ব পায় জঙ্গি প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা। তারেক রহমান চেয়েছিলেন, জঙ্গিদের দিয়ে আওয়ামী লীগের ওপর আক্রমণ করলে দায় দায়িত্ব বিএনপির ওপর পড়বে না।
এ কাজে বাছাই করা জঙ্গিদেরকে পাকিস্থানে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং তাদের সমন্বয়ের দায়িত্ব নিতে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের প্রতিষ্ঠাতা মুফতি হান্নানকে হাওয়া ভবনে ডেকে আনেন তারেক। তার হাতেই হরকাতুল জিহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জেএমবির গোড়াপত্তন হয়। অস্ত্রশস্ত্রের যোগান, অর্থায়ন, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা- সবই করেন তারেক রহমান এবং তার অনুগত সরকারি কয়েকটি সংস্থার কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, ‘প্রিন্স অব বগুড়া’ শিরোনামে তারেক রহমান কর্তৃক জঙ্গিবাদে পৃষ্ঠপোষকতা এবং গ্রেনেড হামলায় সংশ্লিষ্টতার তথ্য প্রমাণসহ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করায় সিএনএন এবং ডেইলি স্টারে কর্মরত তাসনিম খলিল ১/১১-তে গ্রেপ্তার হন। এরপরই তাকে দেশ ছাড়তে হয়। সে সময় রাষ্ট্রীয় কয়েকটি নিরাপত্তা সংস্থায় কর্মরত তারেক রহমানের আস্থাভাজন কয়েকজন কর্মকর্তা তাসনিম খলিলকে আটকের ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।
মূলত তারেক রহমান, খাম্বা মামুন, লাগেজ বাবর, মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী এবং পুলিশ ও সেনা গোয়েন্দা সংস্থার কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আইএসআই’র এজেন্ট, নূর চৌধুরী ও আব্দুর রশিদ ছাড়া কেউই এই পরিকল্পনার কথা জানতেন না। ২১ আগস্টের প্রধান টার্গেট ছিল শেখ হাসিনা। হাওয়া ভবন থেকে পুরো অপারেশন পরিচালনা করেন তারেক। এই পরিকল্পনা এতটাই ফুলপ্রুফ ছিলো যে, কেউ ভাবতেই পারেননি শেখ হাসিনা বেঁচে যাবেন!
৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত কয়েকজনকে জেল থেকে বের করে আনা হয়েছিল, পাকিস্থান থেকে আসে প্রচুর পরিমাণে সামরিক বাহিনীতে ব্যবহৃত আর্জেস গ্রেনেড, যা দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল পদ্মার চরে। প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ছোট ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন। যিনি জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সামরিক প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
এই মাওলানা তাজউদ্দিন আশির দশকে আফগানিস্থানে আল-কায়েদার হয়ে জঙ্গিবাদি কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন, সেখানে সরাসরি ওসামা বিন লাদেনের হাতে প্রশিক্ষণ নেন। উপমন্ত্রী পিন্টুর নির্দেশে পুরান ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় কারাগারে মজুদ করা হয় কিছু গ্রেনেড। যার দায়িত্ব ছিল মানি লন্ডারিংয়ের দায়ে গ্রেপ্তারকৃত জেলার বজলুর হাতে।
২১ আগস্টের সেই দিনে জঙ্গিবাদ বিরোধী আওয়ামী লীগের শান্তি-সমাবেশে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ভাষণ শেষ হতেই হঠাৎ চারপাশ থেকে উড়ে এসে বৃষ্টির মত পড়তে থাকে গ্রেনেড। ঐ ঘটনায় শেখ হাসিনা বেঁচে যাওয়াটা ছিলো এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার।
রাজনীতির পথ শেখ হাসিনার জন্য মসৃণ ছিল না কখনই। বহুবার তাকে হত্যার চেষ্টাও করা হয়েছিল। এসব কারণে প্রবাসী আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ চাঁদা তুলে অত্যাধুনিক একটি বুলেটপ্রুফ মার্সিডিজ জিপ গাড়ি উপহার দিয়েছিল। সেই গাড়িটির কারণেই প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু শহীদ হন ২৪ জন নেতাকর্মী। আহত হন ৫ শতাধিক।
২১ আগস্টের এই ঘটনাটি ছিলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক টার্নিং পয়েন্ট। এই ঘটনা দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক সমঝোতার অবসান ঘটায়। এই ঘটনা যেমন বিএনপির রাজনীতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়, তেমনি ধ্বসে পড়ে হাওয়া ভবনের ভিতটাও।
জার্মান টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি সিমেন্স থেকে কোকোর ঘুষ গ্রহণ:
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে ঘুষ দেয়ার কথা স্বীকার করে সিমেন্স। বিভিন্ন অভিযোগ ও সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে মার্কিন জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট আরাফাত রহমান কোকোর কয়েকটি ব্যাংক হিসাব উল্লেখ করে ২০০৯ সালের ৮ জানুয়ারি সম্পত্তি জব্দের মামলা করে।
এই ব্যাংক হিসাবগুলোতে ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার গচ্ছিত ছিল। আরাফাত রহমান কোকো সিমেন্স এবং চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কাছ থেকে তার অ্যাকাউন্টে ঘুষ হিসেবে নিয়েছিল ওই টাকা। মার্কিন বিচার বিভাগ কোকোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার মামলা করেছিল। কারণ তার সিঙ্গাপুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কিছু টাকা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল।
কোকোর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মার্কিন ডলারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকেই তার ঘুষের টাকা পরিশোধ করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে বিদেশ থেকে ঘুষ ও জোরপূর্বক টাকা আদায় করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের মানি লন্ডারিং আইনের আওতায় পড়ে।
মামলার বিষয়টি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তার অ্যাকাউন্টের লেনদেন হয়েছে বিদেশে বসে এবং ঘুষ ও জোরপূর্বক তিনি ওই অর্থ নিয়েছিলেন। যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রে কোকোর ওই অর্থ জব্দ করা হয়েছিল, তাই বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে কোকোর সিমেন্স ঘুষ কেলেঙ্কারি নিয়ে কাজ করে।
কোকো জাসজ (ZASZ) নামে সিঙ্গাপুরে একটি কোম্পানির নামে তার ঘুষের অর্থ রেখেছিল, যা তার পরিবারের সদস্যদের আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত। (Z হলো যাফ্রিয়া- কোকোর বড় মেয়ের নামের আদ্যাক্ষর, A হলো আরাফাত রহমান কোকোর নিজের নামের আদ্যাক্ষর, S হলো কোকোর স্ত্রী শর্মিলার নামের আদ্যাক্ষর এবং Z হলো যাহিয়া- কোকোর ছোট মেয়ের নামের আদ্যাক্ষর)।
আরাফাত রহমান কোকো ঘুষের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে বিপুল পরিমাণে অর্থ জমা করেছিল, এমন প্রমাণ পাওয়ার পর সে দেশের সরকার ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারকে ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ফেরত দিয়েছিল। এর আগে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনকারী হিসেবে আরাফাত রহমান কোকোকে বাংলাদেশের একটি আদালত ২০১১ সালে ৬ বছরের জেল দিয়েছিল।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর নামে সিঙ্গাপুরে ফেয়ারহিল নামে একটি কোম্পানির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের মামলা হয়। এ মামলায় তাকে আরও ৫.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছিল।
তারেক ও খাম্বা মামুনের মানি লন্ডারিং:
মার্কিন ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-এফবিআই তারেক রহমান এবং তার ঘনিষ্ট বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ওরফে খাম্বা মামুনের বিরুদ্ধে ঘুষ ও মানি লন্ডারিং নিয়ে তদন্ত করেছে। বাংলাদেশের আদালতে তাদের বিরুদ্ধে এসে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন এফবিআই’র সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি।
তদন্তে উঠে এসেছে, তারেক ও মামুন তাদের সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নির্মাণ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড এর পরিচালক এবং চীনের হার্বিন ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড কন্সট্রাকশন এর এদেশিয় এজেন্ট খাদিজা ইসলামের কাছ থেকে সাড়ে ৭ লাখ মার্কিন ডলার ঘুষ নেয়। হার্বিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের লোকাল এজেন্ট হিসেবে টঙ্গীতে ৮০ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ পাওয়ার জন্য তারেক ও মামুনকে ওই টাকা দিয়েছিল ঘুষ হিসেবে।
এফবিআই এজেন্ট ডেব্রা লাপ্রিভেট গ্রিফিথ এই বিষয়ে তারেক ও মামুনের দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের আদালতের সামনে সাক্ষ্য দেন, ব্যবসায়ী খাদিজা ইসলাম সিঙ্গাপুরে মামুনের সিটি ব্যাংকে (তারেকের বন্ধু মামুনের সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বার: ১৫৮০৫২-০১৬-০০৮) ওই টাকা জমা দেন।
ওই একই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তারেক রহমানের নামে সাপ্লিমেন্টারি গোল্ড ভিসা কার্ড (নাম্বার: ৪৫৬৮-৮১৭০-১০০৬-৪১২২) ইস্যু করা হয়। সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকের কাছ থেকে সাপ্লিমেন্টারি গোল্ড ভিসা কার্ড নিতে তারেক রহমান তার পাসপোর্টের একটি ফটো কপি জমা দেন (তারেকের পাসপোর্ট নাম্বার: Y ০০৮৫৪৮৩) যেখানে তার পিতার নামের জায়গাতে লেখা ছিল প্রয়াত জিয়াউর রহমান এবং মাতার নাম ছিল বেগম খালেদা জিয়া।
তারেক রহমান এই কার্ড বিভিন্ন দেশে যেমন; গ্রিস, জার্মানী, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রমোদ ভ্রমণের জন্য ব্যবহার করেন, এমন তথ্যই উঠে এসেছে এফবিআই’র তদন্তে।
এভাবে মোয়াজ্জেম হোসাইন এবং মারিনা জামান ঘুষের টাকা মামুনের সিঙ্গাপুরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেন, যে অ্যাকাউন্টে তারেক রহমানের সরাসরি লেনদেন ছিল। ২১ জুলাই ২০১৬ সালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত তারেক রহমানকে ৭ বছরের জেল এবং ২০ কোটি টাকা জরিমানা করেছে মানি লন্ডারিং এর জন্য।
দেশের সর্বোচ্চ আদালত শুধু রায়ই দেননি তখন রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছিল, এ ধরণের অপরাধমূলক কাজ ‘ফিনান্সিয়াল ক্রাইম’ ছিল এবং এ ধরণের কাজ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বড় ধরণের একটি বাধা।
খাম্বা মামুনের অ্যাকাউন্টে খাদিজা ইসলামের দেয়া ৭ লাখ ৫০ হাজার ডলারে খোঁজ পেয়ে সুপ্রিম কোর্ট তারেক সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন ওই টাকাটা ঘুষের টাকা বলে। কিন্তু তারেক রহমান এবং তার বন্ধু মামুন ওই টাকাকে পরামর্শক ফি হিসেবে দেখিয়েছেন।
নাইকো দুর্নীতি:
২০১১ সালেল ২৩ জুন কানাডার একটি আদালত খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তার সরকারের জ্বালানী প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনের দুর্নীতি মামলার বিষয়ে উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ পেয়েছিল। মোশাররফ কানাডার কোম্পানী নাইকোকে অনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়ার বিনিময়ে একটি দামি গাড়ি উপহার পেয়েছিলেন নাইকোর কাছ থেকে। যার আর্থিক মূল্য ছিল কানাডিয়ান ডলারে ১,৯০,৯৮৪ ডলার।
নাইকো আরও ৫ হাজার কানাডিয়ান ডলার ঘুষ দিয়েছিল মোশাররফকে তার স্বপরিবারে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের জন্য। নাইকো বাংলাদেশ থেকে তাদের ঠিক করা দামে গ্যাস কিনতে ও বিক্রয় করতে পারবে এবং গ্যাসক্ষেত্রে বিস্ফোরণের কারণে সরকার কর্তৃক নির্ধারিত জরিমানা আরো কমিয়ে দেয়া হবে- এটা নিশ্চিত করতেই মোশাররফকে ঘুষ দেয়া হয়।
২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট রিট পিটিশনের (পিটিশন নাম্বার: ৫৬৭৩) রায় দেয়। রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ, এফবিআই এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের সমস্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায়, ২০০৩-০৬ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্বকালীন সময়ে নাইকোর কাছ থেকে বড় ধরণের ঘুষ লেনদেনের ঘটনা ঘটেছিল অনৈতিকভাবে তাদের সুবিধা দেয়ার নামে।
বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আদেশের লক্ষণীয় বিষয় হলো, নাইকোর এই ঘুষ দেয়ার কাজটি ছিল নির্লজ্জের মতো। নাইকো তাদের এজেন্ট কাশিম শরীফকে ৪ মিলিয়ন ডলার এবং ঢাকা ক্লাবের সাবেক সভাপতি সেলিম ভুঁইয়াকে ৫ লাখ ডলার দেয় পরামর্শক হিসেবে, যেন তারা বিএনপি সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়।
এসব তথ্য প্রমাণ জোগাড় করে রয়্যাল কানাডিয়ান মাউন্টেড পুলিশ এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই। তাদের তথ্যপ্রমাণ এটাই প্রমাণ করে, নাইকো তাদের বাংলাদেশি এজেন্টদেরকে সুইস ব্যাংকের মাধ্যমে প্রথমে বার্বাডোজের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে কাশিম শরিফ এবং সেলিম ভুঁইয়ার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকাগুলো দেয়। পরে ওই টাকা চলে যায় তারেকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের অ্যাকাউন্টে।
এফবিআই’র বিশেষ প্রতিনিধির সাক্ষ্য:
এফবিআই’র সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি ডেবরা লাপ্রিভেট গ্রিফিথ কয়েক বছর ধরে দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত করেছেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কীভাবে দুর্নীতি হয়েছিল তা নিয়েই মূলত তিনি তদন্ত করেছেন।
২০১৬ সালের ২১ নভেম্বর আদালতে তারেক ও মামুনের বিরুদ্ধে তিনি যে জবানবন্দি দিয়েছেন সেখানে তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এবং জিয়া পরিবার নিয়ে মন্তব্য করেন। বিএনপি সরকার এবং জিয়া পরিবারের কারণে কীভাবে দেশজুড়ে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি হয়েছিল তা তিনি তুলে ধরেন। গ্রিফিথের মন্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
কিছু “পরামর্শক” এর মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়া হয়েছিল, যারা টাকাটা ঐ সকল সরকারি কর্মকর্তা ও তাদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের কাছে পৌছে দেন। গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ও তার ভাই হাফিজ ইব্রাহিম, এই দুইজনই মুলত তারেক রহমান ও মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপুর্ন ক্ষমতাসীনদের প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের কাছে টাকা স্থানান্তর করে।
যারা পরে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে ঘুষ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেয়। বাংলাদেশ কাজ করতে ইচ্ছুক এমন অনেক প্রতিষ্ঠান এ ধরণের মধ্যস্ততাকারীদের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিতো, যাদের আসলে টেলিযোগাযোগ, জলবিদ্যুৎ, তেল বা গ্যাস এ ধরণের ক্ষেত্রে কোন বিশেষ জ্ঞান নেই। ক্ষমতাশালী লোকদের সাথে তাদের সুসম্পর্ককে ব্যবহার করেই ঘুষ প্রদান করতো।
কয়েকজন আমার কাছে এই বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে যে কোন ধরণের কাজের চুক্তি পেতে হলে প্রতিষ্ঠানটিকে মামুন বা তার ভাই হাফিজ ইব্রাহিমকে টাকা দিতে হতো, যারা পরে সেই টাকা প্রধানমন্ত্রীর দুই ছেলে তারেক ও কোকোর কাছে পৌঁছে দিতেন।
আমরা যতগুলো দুর্নীতির মামলার তদন্ত করেছি প্রতিটি তদন্তই একথা সমর্থন করে। আরও প্রমাণ বের হয় যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী এমনকি নিচুপদস্থ অনেক সরকারী কর্মকর্তারাও ঘুষের টাকার ভাগ পেতেন।
উদাহরণস্বরুপ, সিমেন্স দুর্নীতি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে সিঙ্গাপুরে আরাফাত রহমানের ঘুষের ব্যাপারে সে দেশের তদন্ত কর্মকর্তারা একটি অফিসে তল্লাশি চালান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ওয়ারিদ টেলিকমের আরাফাত রহমানকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে একটি ‘পরামর্শক চুক্তি’র কাগজ খুঁজে পান।
টেলিকম খাতে আরাফাত রহমানের কোন দক্ষতা বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোন প্রমাণ নেই এবং পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্যতাও তার নেই। আরাফাত রহমান আরব আমিরাতে বাড়ি কেনেন এবং সেখান থেকে টাকা তার সিঙ্গাপুরের একাউন্টে টাকা জমা করার তথ্য আমার তদন্তে উঠে আসে।
জিয়া পরিবারের সদস্যদের নামে দুর্নীতির মামলাগুলো:
যেসব মামলায় জিয়া পরিবারের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে সেই মামলার বাইরেও খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং বিএনপির অন্য শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা বিচারাধীন রয়েছে। যা ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে দুদক দায়ের করেছিল। বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কোনো নতুন মামলা করা হয়নি।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা- ২০১১ সালের ৮ আগস্ট দুদক তেজগাঁও থানায় এই মামলা করে। জিয়াউর রহমানের নামে একটি চ্যারিটেবল ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা করে ৩ কোটি ১৫ লক্ষ টাকার অবৈধ লেনদেনের কারণে এই মামলা করা হয়।
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা- ২০০৮ সালের ৩ জুলাই দুদক রমনা থানায় খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও আরও ৪ জনকে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করে। অভিযোগে বলা হয়, অভিযুক্তরা অরফানেজ ট্রাস্টের নামে দেশের এতিমদের জন্য বিদেশি দাতা সংস্থা থেকে আসা ২ কোটি ১০ লক্ষ টাকার অনুদান আত্মসাৎ করে।
বড়পুকুরিয়া খনি দুর্নীতি মামলা- ২০০৮ সালের ২৬ জানুয়ারি দুদক শাহবাগ থানায় খালেদা জিয়াসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করে এই মামলা দায়ের করে। মামলায় বলা হয়, বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে কন্ট্রাক্টর নিয়োগের ব্যাপারে অভিযুক্তরা দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন এবং প্রায় ১৫৯ কোটি টাকা ঘুষ হিসেবে আদায় করেছেন।
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা- ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর দুদক খালেদা জিয়াসহ আরো ১৪ জনের নামে এই মামলা দায়ের করে। মামলায় বলা হয়, চট্টগ্রাম বন্দর ও ঢাকা ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপোর কন্টেইনার ওঠানামার কাজ গ্যাটকোকে দেওয়ার ফলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ১৪৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
নাইকো দুর্নীতি মামলা- ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর দুদক খালেদা জিয়াসহ আরো কয়েকজনের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করে। ২০০৮ সালের ৫ মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে চার্জশীট দাখিল করে।
জিয়াউর রহমানকে জাতির পিতা ঘোষণার ধৃষ্টতা:
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে জাতির পিতা বলে ঘোষণা দেয়ার অভিযোগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের উপ-ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম রমনা থানায় এ মামলা করেন।
বিএনপির ৪১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে লন্ডনে আয়োজিত এক কর্মীসভায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে পলাতক সাজাপ্রাপ্ত আসামি তারেক রহমান তার বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেন, ‘তাহলে নেতৃবৃন্দ আজ কি এই সভায় যারা উপস্থিত আছেন, আজ এই সভায় ক্যামেরার মাধ্যমে, প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে কি আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি?
আমাদের নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের জাতির পিতা। আমাদের নেতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শুধু বাঙালি জাতি না, বাঙালিসহ ৫৫,১২৬ বর্গমাইলের মধ্যে যতগুলো জাতি বাস করে যারা বাংলাদেশি জাতির পরিচয় বহন করে, যারা নিজেদের বাংলাদেশি হিসেবে পরিচয় দেয়, সেই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জাতির পিতা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের জাতির পিতা।
আমরা কি আজ সকলে মিলে এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে পারি? তাহলে আজকে থেকে সিদ্ধান্ত হলো- শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের জাতির পিতা।’
ইতিহাস বিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলুণ্ঠিত করা এবং সংবিধান স্বীকৃত বিষয়কে অবমাননা করায় তারেক রহমানের নামে মামলাটি করা হয়।
তারেক রহমান সম্পর্কে উইকিলিকসের চাঞ্চল্যকর নথিতে যা বলা হয়েছে:
উইকিলিকসের নথিতে তারেক রহমানের অপকর্ম নিয়ে বিপুল নথিপত্র আছে। তাতে উঠে এসেছে অনেক গোপন তথ্য। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ২০০৮ সালের ৩ নভেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টে এক গোপন তারবার্তায় তারেক রহমান সম্পর্কে প্রতিবেদন পাঠান। যা পরে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী উইকিলিকসের ফাঁস করা নথিতে পাওয়া যায়।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টি দেশে পাঠানো সেই গোপন বার্তায় ‘বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান জিয়াউর রহমানের কুখ্যাত বড় ছেলে এবং মায়ের উত্তরসূরি’, ‘ভয়ঙ্কর রাজনীতিক এবং দুর্নীতি ও চুরির মানসিকতাসম্পন্ন সরকারের প্রতীক’ উল্লেখ করে তাকে বাংলাদেশে মার্কিন স্বার্থের প্রতি হুমকি হিসেবেও দেখানো হয়। রিপোর্টে রাষ্ট্রদূত তারেক রহমানকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দুষ্টু এবং ভয়ঙ্কর পুত্র অভিহিত করেন।
মারিয়ার্টির রিপোর্টে তারেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিনিময়ে দেশের মন্ত্রিত্ব বিক্রির অভিযোগও করা হয়। এতে বলা হয়, ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গঠন ও নির্বাচনে জয়লাভে কৌশলগত বুদ্ধি প্রয়োগের কৃতিত্ব তার। ৬০ জনের মন্ত্রিপরিষদের এক-তৃতীয়াংশই তিনি পূরণ করেছেন বা বিক্রি করেছেন।
সমালোচকরা বলেন, তিনি খুবই নির্দয়, দুর্নীতিগ্রস্ত, একাডেমিক পড়াশোনার অবস্থাও খুব ভালো নয়, রাজনীতিতে অপরিপক্ক। ‘হাওয়া ভবন’ নামে একটি বাড়ি থেকে তিনিই মূলত সরকারের বিভিন্ন বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। ওই ভবনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল তার ‘ছায়া সরকার’।
খালেদা জিয়ার ব্যাপারে মারিয়ার্টির ওই রিপোর্টে বলা হয়, সমালোচকরা তাকে অলস, অশিক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে দলের মূল ক্ষমতা তার হাতেই।
উইকিলিকসের নথিতে মারিয়ার্টি ছাড়াও কূটনীতিক হ্যারি কে টমাস, প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস, গীতা পাসি প্রমুখের বরাত দিয়ে এসেছে। নথির এসব তথ্যের অনেক কিছুই দেশের গণমাধ্যমের লোকজন জানতেন। যদিও বিরাগভাজন হওয়ার শঙ্কায় অনেক বড় বড় মিডিয়া হাউজ এসব এড়িয়ে গেছে।
২০১১ সালে প্রকাশিত উইকিলিকসের আরেকটি নথিতে জানা যায় কীভাবে অন্যতম শীর্ষ জঙ্গি সিদ্দিকুর রহমান ওরফে বাংলাভাই’র খাস সাগরেদ কামারুলকে (মাহতাব খামারু) তারেকের টেলিফোন পেয়ে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় র্যা ব! নথিটি এমন সময় প্রকাশ হয়েছিল, যখন শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টায় জঙ্গি সহযোগিতায় ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় খামারুর বিচারের প্রস্তুতি চলছিল।
আরও বলা হয়েছে- সরকারি ক্রয় এবং রাজনৈতিক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রায়ই ঘুষ চাইতেন তারেক। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, ঘুষ কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ ও কর ফাঁকির অনেক মামলার আসামি হওয়া সত্ত্বেও তিনি মুক্তি পেয়েছেন। সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে গভীর আঁতাতের মাধ্যমে তারেক বিচার প্রক্রিয়ায় কারসাজি করতে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার তার জামিন আটকানোর যে চেষ্টা করেছিল তাকে জয় করতে সক্ষম হন তিনি।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে কোটি কোটি ডলার অর্জনের দায়ে গুরুতর অভিযোগ এনেছে। তার বিরুদ্ধে কয়েকটি চাঁদাবাজির মামলাও রয়েছে। যেগুলো বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীর সাক্ষ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে এক রিপোর্টে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি মার্কিন কোম্পানি সিমেন্স কেলেঙ্কারির ঘটনাটিও তুলে ধরেন তার সেই রিপোর্টে।
সিমেন্সের চুক্তির কাজের মোট অর্থ থেকে প্রায় ২% ঘুষ নেন তারেক। যা মার্কিন ডলারে পরিশোধ করা হয়। মামলাটি মার্কিন বিচার বিভাগ এবং এফবিআই’র তদন্তাধীন ছিল। দুদকের বরাত দিয়ে মরিয়ার্টির রিপোর্টে বলা হয়, এসব ঘুষ ও চাঁদাবাজির বাইরেও তারেক ব্যাপক অর্থ তছরুপে জড়িত ছিলেন। কয়েকজন সহচরের মাধ্যমে তিনি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ফান্ডের ৩ লাখ ডলার আত্মসাৎ করেন।
দুদকের বরাতে মরিয়ার্টি আরও বলেন, তারেক ছিলেন ওই তহবিলের সহ-স্বাক্ষরদাতা। ওই ফান্ডের অর্থ দিয়ে তিনি নিজ শহরে একটি জমি কিনেছেন। এছাড়া ওই তহবিলের অর্থ তিনি ২০০৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় বিএনপির সদস্যদের মধ্যেও বিলি করেছেন।
আরও বলা হয়, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের মধ্যে ছিল আরেক ‘ছায়া সরকার’। হাওয়া ভবনে বসে এ সরকার চালাতেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। তার সঙ্গে ছিলেন দল ও জোটের উচ্চপর্যায়ের বেশ কয়েক নেতা। এমন বহু অপকর্মের খতিয়ান মিলেছে উইকিলিকসের সেই নথির পাতায় পাতায়!
উল্লেখ্য, তারেক রহমানকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জন্য বিপজ্জনক, সেদেশে প্রবেশের অনুপযুক্ত ঘোষণা করা হয়েছিল। এর আগে জামায়াত নেতা রাজাকার দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদী আর বিএনপির প্রিয় পুলিশ কর্মকর্তা কোহিনুর মিয়ার ভাগ্যে জুটেছিল এমন কালো তালিকায় নাম ওঠার।
৯/১১’র যুক্তরাষ্ট্র সরকার সারা দুনিয়ায় তাদের বিবেচনায় চিহ্নিত যে সব ব্যক্তিকে বিপজ্জনক চিহ্নিত, নো ফ্লাই প্যাসেঞ্জার্স লিস্টেড করে, সে তালিকায় বাংলাদেশ থেকে শুধু জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদীর নাম ছিল। তখন তারা ওই তালিকাটি বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশন্সকে পাঠিয়ে অনুরোধ করে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রগামী কোন বিমানে যাতে উঠতে দেওয়া না হয় সাঈদীকে।
বিমান কর্তৃপক্ষের একটি সূত্রে তালিকাটি পেয়ে তখন পত্রিকায় রিপোর্ট হলেও জামায়াত অন্তর্ভূক্ত চারদলীয় সরকার বিষয়টি চেপে যায়। কিন্তু ওই তালিকায় নাম ওঠার পর থেকে সাঈদী তার ওয়াজ ব্যবসার লাভজনক গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্রে আর কখনও যেতে পারেনি। পরবর্তীতে একই সূত্রে যুক্তরাজ্যের ওয়াজ-বাজারটিও তার জন্য বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকার মার্কিন দূতাবাস পরবর্তীকালে পুলিশ অফিসার কোহিনুর মিয়াকেও সে দেশের ভিসা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ঢাবির শামসুন্নাহার হলে ছাত্রীদের ওপর এবং রাজপথে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের টর্চারের কারণে কোহিনুর মিয়া তখন বিশেষ আলোচিত-সমালোচিত, বিএনপির বিশেষ পছন্দের পুলিশ কর্মকর্তা। হাওয়া ভবনে তার নিয়মিত যাতায়াত, ‘ভাইয়া’র (তারেক রহমান) বিশেষ আস্থাভাজনে পরিণত হন।
ওই সময় তাকে যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত করা হলেও দূতাবাস কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হন। ঢাকার মার্কিন দূতাবাস ভিসার আবেদন প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দেয়, কোহিনুর মিয়ার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘণকারী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ভিসা পেতে পারেন না।
জঙ্গিবাদ, নাশকতা এবং দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার ষড়যন্ত্রে তারেক রহমান:
এ বছর মার্চের ২৬ এবং ২৭ তারিখে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং চট্টগ্রামে হেফাজত যে তাণ্ডব চালিয়েছে তার মূল হোতা হিসেবে তারেক রহমানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম জামায়াতের নেতা শাহজাহান চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা নিশ্চিত হয়েছে, তারেক রহমানের নীলনকশা অনুযায়ী স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই তাণ্ডব চালানো হয়েছে।
এর আগে ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের তাণ্ডব বিএনপির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। খালেদা জিয়া এই বিষয়ে সম্মতি দিয়েছিলেন। তখন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল, বাংলাদেশে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করা হবে। আহমদ শফী রাষ্ট্রপতি এবং জুনায়েদ বাবুনগরী প্রধানমন্ত্রী হবেন। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তারা শাপলা চত্বরে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি সরকারের দৃঢ়তার জন্য।
আর এ বছরের মার্চে নরেন্দ্র মোদির সফর ঠেকাতে তারেক রহমানের অর্থায়নে হেফাজতের তাণ্ডব পরিকল্পনায় যুক্ত ছিল জামায়াত এবং পাকিস্থানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। বাংলাদেশে ভারতবিরোধী গণজোয়ার তৈরি করে আওয়ামী লীগকে কোণঠাসা করার নীলনকশা প্রণয়ন করেন তারেক রহমান।
জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে তারেক রহমানের সরাসরি যোগাযোগ হয়। শাহজাহান চৌধুরীর সঙ্গে তারেকের মধ্যকার আলাপে নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতার পরিকল্পনা হয়। শাহজাহান চৌধুরী হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী এবং আরও কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন এমন তথ্য প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
তারেককে খুশি করতেই বাস পোড়ানোর প্ল্যান করেন নিপুণ রায়:
নাশকতায় সম্পৃক্ততার দায়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায়কে গ্রেপ্তার করেছিল র্যা ব। হেফাজতের দেয়া হরতালকে কেন্দ্র করে যুবদল নেতা আরমানসহ আরও কয়েকজন বিএনপির ক্যাডারকে বাসে আগুন লাগাতে নির্দেশ দেন নিপুণ রায়। আর এ কারণেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
ফাঁস হওয়া ফোনালাপে জানা যায়, তারেক রহমানকে খুশি করতেই বাসে আগুন লাগানোর নির্দেশ দেন নিপুণ রায়। ফোনে যুবদল নেতা আরমানকে আশ্বাস দিয়ে নিপুণ রায় বলেন, বাস পোড়ানোর ছবি এবং ভিডিও হোয়াটসঅ্যাপে পাঠালে সেটা তারেক রহমানের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে।
মূলত শামা ওবায়েদ, রুমিন ফারহানাসহ বিএনপির অন্যান্য নারী নেত্রীদের মত তারেক রহমানের গুড বুকে ঠাঁই পেতে নিপুণ রায় সে সময় আরমানসহ একাধিক দলীয় ক্যাডারকে বাসে আগুন লাগাতে নির্দেশ দেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধীতাকারীদের পেছনে তারেকের অর্থায়ন:
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধীতাকারীদের পেছনে অর্থায়ন করেছেন বিএনপির পলাতক ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের আলোচনা সভায় বলেন, যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছেন তাদের লক্ষ্য কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ছিল না, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো। এজন্য লন্ডন থেকে তারেক রহমান অর্থ পাঠিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দমন করতে এখনও সক্রিয় তারেক:
গত বছরের অক্টোবরের শুরুতে চট্টগ্রামের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে স্কাইপ বৈঠকে যুক্ত হন তারেক রহমান। আর চট্টগ্রাম থেকে এই আলোচনায় নেতৃত্ব দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। সেই বৈঠকে তারেক রহমান বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের সব নারী কর্মীদেরকে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে ধর্ষ’ণের মামলা করার নির্দেশ দেন।
তারেক রহমান বিএনপির নারী কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন- এলাকায় ছাত্রলীগ, যুবলীগের বড় বড় নেতাদের নামে থানায় গিয়ে ধর্ষ’ণের মামলা দিতে। আর বিএনপির নেতাকর্মীরা এই মামলার সাথে সাথে স্থানীয়ভাবে কর্মসূচী দেবে। সমাবেশ, মানববন্ধন করবে। তবে মামলা করার আগে বিএনপিপন্থী সাংবাদিকদের জানাতে হবে, প্রেস কনফারেন্স করতে হবে। তাহলে পুলিশ চাপে পড়ে মামলা নিতে বাধ্য হবে। মামলা না নিলে মিডিয়াকে বলুন। মিডিয়াকে ম্যানেজ করুন।
ক্ষমতা দখলের প্ল্যান: জেদ্দায় বিএনপি-জামায়াত-আইএসআইর গোপন বৈঠক:
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের জন্য বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে পাকিস্থানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর গভীর ষড়যন্ত্রের তথ্য উদঘাটন করেছে বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থা। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পূর্বে সৌদি আরবের জেদ্দায় বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে পাকিস্থানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র এক গোপন বৈঠক হয়। তাতে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির এক শীর্ষ নেতা।
বাংলাদেশে পাকিস্থানি এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য গত নির্বাচনের পূর্বে ৩০০ আসনে বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থীর তালিকা তৈরি করা হয়। এর আগে ৩২ মাসে আইএসআই’র সঙ্গে অন্তত ২০টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বিএনপি-জামায়াতের। বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থার হাতে এসেছে সাড়ে শতাধিক ফোনালাপ রেকর্ড।
এসব রেকর্ডের মধ্যে আছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশারফ হোসেনের সঙ্গে আইএসআই’র দুবাইভিত্তিক এজেন্ট পাকিস্থানের সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শহীদ মেহমুদের ফোনালাপ। দুবাইতে বসবাসকারী মেহমুদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃবৃন্দের লিয়াজোঁ হচ্ছেন বিএনপির দুবাই শাখার সভাপতি সিলেটের জকিগঞ্জের অধিবাসী জাহিদ হাসান।
জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান থেকে শুরু করে তারেক রহমান পর্যন্ত অনেকেরই ফোনালাপ রেকর্ড করেছে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা।
শহীদ মেহমুদ পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর ৫৪তম লং কোর্স কমিশন্ড। তিনি দুবাইতে বসবাস করেন এবং সেখানে আইএসআই এজেন্ট হিসেবে কর্মরত। তার মাসিক বেতন ৪,৫০০ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের নির্বাচনে পাকিস্থানি এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তার এ্যাসাইনমেন্ট।
সিলেটের জকিগঞ্জের জাহিদ হাসান বিএনপির দুবাই শাখার সভাপতি। তার মাধ্যমেই শহীদ মেহমুদ যোগাযোগ করেন তারেক রহমানের সাথে। আইএসআই কর্তৃক প্রণীত বাংলাদেশের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের ৩০০ প্রার্থীর তালিকাটি তারেককে পাঠিয়েছেন জাহিদ হাসান। সেই তালিকায় কোন কোন প্রার্থী মারা গেছেন এবং তারেক কোন কোন প্রার্থীকে চেনেন না- এমন কথাবার্তাও হয়েছে ফোনালাপে।
বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে আইএসআই এজেন্ট শহীদ মেহমুদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বৈঠক ও ফোনালাপের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এসব বিষয়ে বিএনপি-জামায়াত থেকে কোন প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
ফোনালাপে শহীদ মেহমুদের সঙ্গে বিএনপি নেতা খন্দকার মোশারফের আলাপে ৩০০ প্রার্থীর তালিকা দেয়ার কথা বলা হয়। ফোনালাপে শোনা যায়-
শহীদ মেহমুদ : ইউ রিমেম্বার উই মেট লাস্ট টাইম ইন ইসলামাবাদ (আপনার স্মরণ আছে যে, আমরা সর্বশেষ ইসলামাবাদের বৈঠকে মিলিত হয়েছিলাম)।
জাহিদ হাসান : স্লামালাইকুম।
শহীদ মেহমুদ : ইয়েস ব্রাদার, হাউ আর ইউ?
জাহিদ হাসান : আলহামদুলিল্লাহ।
ফোনালাপের যে শতাধিক কল রেকর্ড রয়েছে, তাতে দেখা যায় অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সাক্ষাত-আলাপের সময় ও স্থান ঠিক করা হয়। নামের বদলে কোড ব্যবহার করা হয়েছে- ‘বড় ভাই’, ‘আমাদের বন্ধু’, ‘নাম্বার ওয়ান’, ‘বস’ ইত্যাদি। জাহিদ হাসানের ‘বস’ আর শহীদ মেহমুদের ‘নাম্বার ওয়ান বন্ধুর’ ‘বস’ এর সঙ্গে একটি বৈঠক চূড়ান্ত হচ্ছিল সৌদিতে।
জাহিদ হাসান : অলরেডি আই সেন্ড…। বিকজ অলরেডি ফাইন্যালাইজ…।
শহীদ মেহমুদ : ওকে। ডেফিনিটলি ইনভলভ দি পিপল…।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার রায় নিয়ে কথা প্রসঙ্গে সেই ‘বস’ এর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। যাতে বলা হয়েছে, বস লন্ডন থেকে ভিডিও বার্তা পাঠিয়ে সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। শহীদ মেহমুদ এবং জাহিদ হাসানের আলাপে তারেক রহমানের নামও এসেছে।
জাহিদ হাসান : ইয়েস্টার্ডে মাই বস অলরেডি গেট দি ভিডিও কল।
শহীদ মেহমুদ : নাথিং মাচ ফ্যাক্ট অন ওরান…।
জাহিদ হাসান : নো, সি দ্য ইস্যু উইল অলরেডি টোল্ড দ্য নো এনি এজ পার উই নো দ্য ডিসাইডেড তারেক রহমান। অলসো দ্য…।
শহীদ মেহমুদ : দ্যাটস আই বি লাভ বেটার আন্ডারস্ট্যান্ডিং ফর দি বিগার গেম। বিকজ দি ইউ নো জেনারেল ইলেকশন।
যে কোন মূল্যে জামায়াতকে জোটে রাখার শর্তে তারেক রহমানকে সকল সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন শহীদ মেহমুদ।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেদ্দায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, শহীদ মেহমুদের সঙ্গে ফোনালাপ হয়েছে বিএনপি নেতা খন্দকার মোশারফের। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান থেকে শুরু করে তারেক রহমানসহ বিএনপি-জামায়াতের নেতৃবৃন্দের অনেকের সঙ্গেই ফোনালাপ ও বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে আইএসআই কানেকশনের অভিযোগ পুরনো। ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি সরকারের সময় এ অভিযোগ উঠেছিল। এমনকি মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গে তার বৈঠকেরও প্রমাণ আছে। জেদ্দার বৈঠক প্রমাণ করে আইএসআই’র সঙ্গে তারেকের সম্পর্ক এখনও অটুট। গোয়েন্দা নথিপত্রে দেখা যায়, দুবাইয়ে বিভিন্ন হোটেলে অন্তত ১১ বার দেখা হয়েছে আইএসআই এজেন্ট এবং জাহিদ হাসানের। নির্বাচনের আগে ৭ ডিসেম্বরও তারা দেখা করেছেন।
বাংলাদেশি গোয়েন্দারা জানান, শহীদ মেহমুদ পাকিস্থান সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল। ২০০৪ সালে অবসরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আইএসআই-এ ছিলেন। এখনও এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। বিএনপি নেতা খন্দকার মোশাররফের সঙ্গে শহীদ মেহমুদের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আইএসআই’র নীতিনির্ধারণী কর্মকর্তা জাভেদ মেহেদীর অধীনে কাজ করেন শহীদ মেহমুদ।
জাহিদ হাসান ও শহীদ মেহমুদের একাধিক কথোপকথনে থেকে জানা যায়, জেদ্দা থেকে তারেক রহমানের সঙ্গে জাভেদ মেহেদীর বৈঠক হয়েছে।
শহীদ মেহমুদ ফোনে জাহিদ হাসানকে জানান, তিনি যেন তার ‘বস’কে বলেন বৈঠকের সময় নির্ধারিত হয়েছে। তারেকের পক্ষ থেকেও বৈঠকে উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। শহীদ মেহমুদ তখন জাহিদকে বলেন, জাভেদ মেহেদীর সঙ্গে যেন তারেক সবকিছু আলোচনা করেন, কেননা তিনি আইএসআইর সর্বময় কর্তা। সেখানেই সব সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
দেশের গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ উসকে দেয়া ও জঙ্গী তৎপরতা সক্রিয় করার ক্ষেত্রে বরাবরই সক্রিয় পাকিস্থানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে শেখ হাসিনাকে হত্যা পরিকল্পনায় হামলা চালানো ও জাতীয় পর্যায়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির উদ্দেশে ছক আঁকে আইএসআই। তবে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতামূলক তৎপরতায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
বিস্ময়কর তথ্য হলো, আইএসআই’র শীর্ষ এজেন্টদের যে তালিকা ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর হাতে রয়েছে, তাতে লন্ডনে পলাতক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামও পাওয়া গেছে।
এর আগে ২০০২ এবং ২০০৩ সালে দুবাই থেকে তারেকসহ বিএনপির দুজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সাথে আইএসআই এজেন্টদের বৈঠক হয়। ভারতে অস্থিরতা এবং সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশকে করিডর হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা নেয় আইএসআই। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে অস্ত্রশস্ত্র ভারতে পৌঁছে দেয়া এবং ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের রসদপত্র ও অর্থ সহায়তায় তারেক রহমান আইএসআইকে সহায়তা করছেন- এমন তথ্য-প্রমাণ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বহু আগেই প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশে যে ১০ ট্রাক অস্ত্র পাওয়া যায় তা কোথা থেকে এসেছে সে সম্পর্কে ইন্ডিয়া টুডের অনুসন্ধানী রিপোর্টে বলা হয়েছিল, তারেক রহমানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে উলফাদের এসব অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করার জন্য সিইউএফএল এর জেটিতে নামানো হয়। এরপর থেকেই তারেক রহমান আইএসআই’র পে-রোলে রয়েছেন। এখনও তিনি তাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন বলে ‘র’ এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সেই প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে, তারেকের সঙ্গে ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সম্পর্ক রয়েছে। তারেক আইএসআই’র সঙ্গে মিলে ভারত সরকারকে দুর্বল করা এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নষ্ট করার জন্যও অত্যন্ত সক্রিয় বলে উল্লেখ করা হয়, এটা গোয়েন্দা নথির তথ্য।
লন্ডনে তারেকের বিলাসী জীবন, নেই কোনো নির্দিষ্ট আয়:
১/১১’র পর দেশ থেকে মুচলেকা দিয়ে চিকিৎসার নামে লন্ডনে পালিয়ে এসে কিংস্টন এলাকার একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন তারেক রহমান। আকারে ওই বাড়িটি ছোট হওয়ায় একই সড়কের নতুন একটি বিলাসবহুল বাড়ি কেনেন। যার মূল্য ১৫ লক্ষ পাউন্ড। বর্তমানে আরও বিলাসবহুল আরেকটি বাড়ি কিনেছেন হোয়াইট রিজে। যার মূল্য ৪৫ লক্ষ পাউন্ড।
তারেকের সঙ্গে স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান ও কন্যা জাইমা রহমানও থাকেন সেখানে। জাইমা লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। তাদের পরিবারে রয়েছে ৫টি বিলাসবহুল গাড়ি। যার মধ্যে রয়েছে- মার্সিডিজ বেঞ্জ ১টি, ল্যান্ডরোভার জিপ ১টি, ল্যান্ডক্রুজার জিপ ১টি, লেক্সাস ১টি এবং ১টি বিএমডব্লিউ গাড়ি।
তারেকের ছোট ভাই প্রয়াত কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিঁথিও নিজের মেয়েদের নিয়ে মালয়েশিয়া ছেড়ে লন্ডনে বসবাস শুরু করেন। তারাও থাকেন লন্ডনের কিংস্টন এলাকার আরেকটি বিলাসবহুল বাড়িতে।
দেশে বিএনপির নেতকর্মীরা পর্যন্ত বলেন, তারেক রহমানের বিলাসবহুল জীবন যাপনের পেছনে ব্যয় হওয়া সব অর্থ যায় বাংলাদেশ থেকেই। দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের সকল কমিটি- এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটির জন্যও স্কাইপে সাক্ষাৎকার দিতে হয় তারেক রহমানকে। তিনি সন্তুষ্ট হলে অনুমোদন পায় কমিটি। এছাড়া রয়েছে নির্বাচনে মনোনয়ন। সেটাও একই প্রক্রিয়ায় স্কাইপে সন্তুষ্ট করতে পারলে পাবেন দলের টিকেট।
তারা আরও অভিযোগ করেন, বিএনপিতে কমিটিতে জায়গা কিংবা মনোনয় পাওয়ার ক্ষেত্রে ফ্রি বলে কিছু নেই। পদ এবং মনোনয়নের নিলামের দৌড়ে যে এগিয়ে থাকবেন, লন্ডনের দানবাক্সে যে যত বেশি অর্থ ঢালতে পারবেন, তার অবস্থান ততটাই মজবুত। এসব ক্ষেত্রে স্থায়ী কমিটি কিংবা শীর্ষ নেতাদের সাথে কোনো আলাপ পর্যন্ত করেন না তারেক রহমান। বিভিন্ন চ্যানেলে এসব অর্থ পৌঁছে যায় লন্ডনে। এজন্য মিডিয়া হিসেবে কাজ করেন ব্যবসায়ী ও বিশ্বস্ত কয়েকজন নেতা।
যদিও তারেক নিজেই তার ট্যাক্স রিটার্ন পেপারে উল্লেখ করেছেন, তার আয়ের উৎস ক্যাসিনোতে জুয়া খেলা। সেই সাথে অনলাইনে বিভিন্ন বেটিং অ্যাপের মাধ্যমে জুয়া খেলে তিনি অর্থ উপার্জন করেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে থাকা বিএনপি নেতারা এসব ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি নন।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে তারেকের ব্যবসায়িক সম্পর্ক:
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের মধ্যে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। তবে ৬ খুনি এখনও বিভিন্ন দেশে পলাতক। পলাতক ৬ জনের মধ্যে সর্বশেষ খুনি মাজেদ গ্রেপ্তার হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমানের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তার সাক্ষ্য গ্রহণের পর ফাঁসিও কার্যকর হয়েছে। এখনও ৫ খুনি পলাতক রয়েছে।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, খুনি খন্দকার আব্দুর রশীদ এবং শরীফুল হক ডালিমের সঙ্গে বিএনপির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। তারা তারেকের ব্যবসায়িক পার্টনার। খন্দকার আব্দুর রশিদ দীর্ঘদিন লিবিয়ায় ছিলেন। পরে পাকিস্থানে চলে যান। সেখানে বসেই ব্যবসা পরিচালনা করছেন। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে রশিদকে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে ২ দফা কূটনৈতিক বৈঠক করলেও পাকিস্থান সরকার অনুষ্ঠানিকভাবে সেখানে রশিদের থাকার কথা অস্বীকার করেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, রশীদ পাকিস্থানেই আছেন, পাকিস্থানি পাসপোর্ট গ্রহণ করে তিনি তারেকের বিজনেস পার্টনার হিসেবে দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যবসা করছেন। তারেক-রশীদের অন্তত ৩টি যৌথ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে বলে জানা যায়।
বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি শরীফুল হক ডালিম কেনিয়ায় ছিলেন। সেখান থেকে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যবসা করছেন। এখনও দক্ষিণ আফ্রিকাতেই ব্যবসা পরিচালনা করছেন এবং মাঝেমধ্যে তিনি ইউরোপেও যান। ২০১৭ সালে ডালিমকে যুক্তরাজ্যে দেখা গেছে। সেখানে তিনি ভিন্ন পাসপোর্ট নিয়ে নাম গোপন করে গিয়েছিলেন। সেখানে তারেকের সঙ্গে তার বৈঠকও হয়েছে।
ডালিম এবং রশীদ দুজনেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত বলে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। ২০০৪ সালে তারা বাংলাদেশে হাওয়া ভবনে বসে বৈঠক করেন কয়েক দফা। বর্তমানে তাদের মূল কাজ হলো বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতা এবং শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করা। এজন্য তারা বিভিন্ন জঙ্গীগোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে এমন তথ্যও পাওয়া গেছে।
‘প্রিন্স অব বগুড়া’ প্রতিবেদনের পরেও এবং খলিল-তারেক এর সুসম্পর্ক:
তাসনিম খলিলের ব্যক্তিগত ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, তারেক রহমানের সাগরসম দুর্নীতি, জঙ্গিবাদে সরাসরি মদদ ও জঙ্গিদেরকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেয়ার ওপর ‘প্রিন্স অব বগুড়া’ শীর্ষক এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে জঙ্গি নেতাদের সাক্ষাৎকার এবং বিশদ তথ্য প্রমাণ নিয়ে প্রতিবেদন করেন তাসনিম খলিল। যাতে রাষ্ট্রীয় কয়েকটি নিরাপত্তা সংস্থার শীর্ষ পদে থাকা বিএনপির আশীর্বাদপুষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তার নাম উঠে এসেছিল।
ওয়ান-ইলেভেনের পূর্বে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে প্রকাশিত সেই প্রতিবেদনে ক্ষুব্ধ হন তারেক এবং তার অনুগত কর্মকর্তারা। যার প্রেক্ষিতে খলিলকে গ্রেপ্তার এবং ব্যাপক নির্যাতন চালানো হয়। সে সময় অভিযোগ করা হয়, বিদেশি কয়েকটি দেশের এজেন্ট হিসেবে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা চালাচ্ছেন খলিল।
এরপর আন্তর্জাতিক কয়েকটি ছদ্মবেশি মানবাধিকার সংস্থা- যাদের বিরুদ্ধেও বিভিন্ন দেশে অপতৎপরতা চালানোর অভিযোগ রয়েছে- সেসব সংস্থার চাপের মুখে তাসনিম খলিলকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ছাড়া পেয়ে রাতারাতি বিদেশি সংস্থাগুলোর সহায়তায় দেশ ছাড়েন খলিল।
বিদেশে গিয়ে তিনি গড়ে তোলেন গুজবের কারখানা- নেত্র নিউজ। বিভিন্ন দেশের সরকার উৎখাতে সম্পৃক্ত সংস্থা এনইডি’র অর্থায়নে পরিচালিত নেত্র নিউজে সম্পৃক্ত হন যুদ্ধাপরাধীদের লবিস্ট ডেভিড বার্গম্যান। সাথে আরও আছেন বিএনপিপন্থী গুজব রটনাকারী ও জঙ্গিবাদে মদদ দেয়ায় বহিষ্কৃত কয়েকজন সেনা সদস্য, কিছু বিতর্কিত প্রতারক সাংবাদিক এবং বিএনপি-জামায়াতের অর্থায়নে দেশবিরোধী অপপ্রচারকারী কয়েকজন ইউটিউবার। আর তাদের সবার পেছনে বিনিয়োগ রয়েছে তারেক রহমানের।
নেত্র নিউজকে দিয়ে বাংলাদেশ, আওয়ামী লীগ, মুক্তিযুদ্ধ এবং শেখ হাসিনা বিরোধী বিভিন্ন ধরণের অপপ্রচার, গুজব এবং মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালানোর উদ্দেশ্যে অবিরত বড় অংকের ফান্ডিং করে যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত। মাসখানেক আগে তারেক রহমানের কাছ থেকে ৫০০ কোটি টাকার একটি বড় অংকের লেনদেনের তথ্য প্রমাণ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
২০ নভেম্বর, ১৯৬৭ সালে জন্ম নেয়া তারেক রহমান বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কর্তৃক হত্যা মামলাসহ বেশ কয়েকটি দুর্নীতি মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি। ২৪ জনকে হত্যা এবং আরও অগুণিত মানুষকে হত্যার প্রচেষ্টায় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি- হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদসহ ১৯ জনের একজন তারেক রহমান।
বিশ্বের অন্যতম সভ্য দেশ যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরে ‘পলাতক’ অবস্থায় সবার চোখের সামনে আরামে দিন কাটাচ্ছেন এই ঘৃণ্য খুনি। সেখানে বসে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছেন। অসাম্প্রদায়িক, শান্তিকামী রাষ্ট্র বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরীর পেছনে অর্থায়ন ও উসকানি দিচ্ছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের জন্য প্রধান হুমকি পাকিস্থানের আজ্ঞাবহ তারেক রহমানকে শীঘ্রই বাংলাদেশে এনে আদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবি সাধারণ মানুষের।