সময় এখন ডেস্ক:
তারা পেশায় সরকারি চাকরিজীবী। তবে নেশা ওদের ছিনতাই। ৬ জনের এই দলের এক জন কমলাপুর রেলস্টেশনের বুকিং সহকারী। আরেকজন ডিপিডিসির (ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি) মিটার রিডার, তিনি আবার দলনেতাও। অপারেশনে তারা কখনো হয়ে ওঠেন র্যাব, কখনো প্রশাসনের লোক, আবার কখনোবা ডিবি পুলিশ। প্রথমে টার্গেট ব্যক্তিকে আটকের পর সর্বস্ব হাতিয়ে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে ছেড়ে দিতেন তারা। বিভিন্ন সময় ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে গেলেও এবার শেষ রক্ষা হয়নি তাদের।
গত বুধবার সন্দেহজনকভাবে রাজধানীর ফকিরাপুল এলাকা থেকে এই চক্রের তিনজনকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। বেরিয়ে আসে ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ১৫ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের কাহিনী। এক দিনের রিমান্ড শেষে আদালতের নির্দেশে গতকাল আসামিদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, গ্রেফতার ব্যক্তিদের মধ্যে শাহাদত হোসেন ওরফে দীপ্ত (২৮) কমলাপুর রেলস্টেশনের বুকিং সহকারী পদে কর্মরত। বাকি দুজনের একজন নওশাদ আহাম্মদ ওরফে কনক (৩৭) একসময় প্রিন্টিংয়ের ব্যবসা করতেন। আর অপরজন পারভেজ আলী পিকি (৪৫) ইয়াবায় আসক্ত।
ডিবির (পূর্ব) অতিরিক্ত উপকমিশনার আতিকুল ইসলাম বলেন, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পলাতক আরও ৩ জন আসামির কথা জানিয়েছেন, যাদের মধ্যে আজিজ নামের একজন ডিপিডিসির মিটার রিডার। তাকেসহ বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে। গ্রেফতার ব্যক্তিদের কাছ থেকে একটি ওয়াকিটকি ও দুটি র্যাবের জ্যাকেট উদ্ধার করা হয়েছে।
ডিবি সূত্র জানায়, ছিনতাইকারী চক্রের মূল হোতা আজিজের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ। ডিপিডিসির পরীবাগ কার্যালয়ে মিটার রিডার পদে তিনি কর্মরত। তার সহযোগী সজল হক মতিঝিল এজিবি কলোনির বি-৮১ হাসপাতাল জোনের ৫/সি ফ্ল্যাটে থাকেন। অপর সহযোগী এনামুল হাসান ওরফে রাজনের বাসা ৪১ নম্বর র্যাংকিন স্ট্রিট, কেএফসি বিল্ডিংয়ের অষ্টম তলায়। গ্রেফতারকৃত রেলওয়ের বুকিং সহকারী শাহাদতের স্ত্রীও বুকিং সহকারী পদে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে কর্মরত। তারা রাজধানীর খিলগাঁওয়ের ২১২/৩ মেরাদিয়ার ভূঁইয়াপাড়ায় থাকেন। পারভেজ আলী পিকির বাসা পুরান ঢাকার ৫ নম্বর হেয়ার স্ট্রিটের আফসার প্রপার্টিজের ৩/ডি ফ্ল্যাট। ইয়াবায় আসক্ত হওয়ায় তিনি আগে ব্যবসা করলেও এখন কিছু করেন না। কনকের বাসা ২৭৯/ক দক্ষিণ গোড়ানে।
ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনা জানার পর তারা ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। ছিনতাইয়ের পর ওই ব্যক্তি থানায় কোনো মামলা করেছিলেন কি না তা জানার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে কনকের ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি কোথায় আছে এবং থানায় করা জিডির বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ ছাড়া তাদের কাছ থেকে অন্যান্য ছিনতাইয়ের ঘটনাও জানার চেষ্টা চলছে।
যেভাবে ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই:
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার ব্যক্তিরা জানান, আজিজ তাদের এই চক্রের মূল হোতা। গত ১৬ জানুয়ারি মতিঝিলের দিলকুশা এলাকার ডাচ-বাংলা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বের হওয়া এক ব্যক্তির পিছু নিয়ে ১৫ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় তারা। ওই ঘটনায় ৬ জনের এই চক্র অংশ নিয়েছিল। এরা হলেন- রাজন, আজিজ, কনক, সজল, দীপ্ত ও পিকি। দীপ্ত জানান, ২০১৩ সালে তিনি রেলওয়ের বুকিং সহকারী হিসেবে যোগদান করেন। তার বাবাও রেলের কর্মচারী ছিলেন।
১৬ জানুয়ারি সকালের শিফটে কমলাপুর স্টেশনে দায়িত্ব শেষ করে বের হওয়ার পর রাজন ও সজল তাকে দিলকুশা ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সামনে যেতে বলেন। রাজন ব্যাংকের ভিতর থেকে বের হয়ে এক ব্যক্তিকে দেখিয়ে দেন পিকিকে। পিকি ওই ব্যক্তিকে আজিজ, সজল ও কনককে দেখিয়ে দেন। আজিজ ওই ব্যক্তির পিছু পিছু বাসে গিয়ে ওঠেন। বাকিরা দুটি মোটরবাইকে করে বাসের পিছু নেন। টাকার ব্যাগ নেওয়া ওই ব্যক্তি যাত্রাবাড়ীতে নামার পর তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক পরিচয় দিয়ে ঘেরাও করে ধরে ছিনতাই চক্র। পরে রাজন ও কনক টাকার ব্যাগসহ ওই ব্যক্তিকে নিয়ে একটি মোটরবাইকে ওঠেন।
দীপ্ত জানান, মোটরবাইক কিছুদূর এগোতেই মাঝখানে থাকা ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তি তাকে ধাক্কা দিয়ে পেছনে ফেলে দেন। মোটরসাইকেলটি পড়ে গেলে ওই ব্যক্তি চিৎকার শুরু করেন। এ সময় আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে প্রথমে আজিজ দৌড়ে পালিয়ে যান। পরে দীপ্ত নিজেও দৌড়ে গিয়ে একটি ভবনের সিঁড়িতে লুকিয়ে থাকেন। সন্ধ্যার দিকে ওই বাসা থেকে বের হয়ে তিনি বাসায় চলে যান। পরে রাতে অন্যদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ২ লাখ ১০ হাজার টাকার ভাগ নেন। পরদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দীপ্ত বগুড়া ও দিনাজপুরের হিলিতে গিয়ে কয়েক দিন আত্মগোপনে থেকে আবার ঢাকায় আসেন।
গ্রেফতার কনক জানান, আজিজ ও শাহাদত যাত্রাবাড়ী এলাকায় যে মোটরবাইকটি ফেলে এসেছিলেন সেটি তার (কনক) নামে রেজিস্ট্রেশন করা ছিল। মোটরবাইক ফেলে আসার কারণে ধরা পড়ার ভয়ে তিনি ওই দিন সন্ধ্যায় রাজনের পরামর্শে খিলগাঁও থানায় গিয়ে মোটরসাইকেলটি হারিয়ে গেছে উল্লেখ করে জিডি করেন।
গ্রেফতার পারভেজ আলী পিকি জানান, একসময় নার্সারির কাজে ব্যবহৃত পটারির ব্যবসা করলেও ইয়াবায় আসক্ত হয়ে তিনি এখন কিছুই করেন না। পুরান ঢাকায় নিজের ফ্ল্যাটে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকেন তিনি। স্ত্রীর টিউশনির উপার্জনে তিনি চলেন। মাঝে-মধ্যে রাজনদের সঙ্গে ছিনতাই করে অর্থ উপার্জনও করেন তিনি।