যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর পর এবার আজহারীকে আজীবন নিষিদ্ধ করলো যুক্তরাজ্য

0

সময় এখন ডেস্ক:

সর্বশেষ আইনি লড়াইয়েও হেরে গেলেন বাংলাদেশের বিতর্কিত ও জামায়াতপন্থী ইসলামী বক্তা মিজানুর রহমান আজহারী। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মত তার রুহানি পুত্র হিসেবে স্বীকৃত আজহারীকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে যুক্তরাজ্যে।

গত ১৮ অক্টোবর লন্ডনের হাইকোর্টে কুইন বেঞ্চ ডিভিশনে মিজানুর রহমান আজহারীর ব্রিটেনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে করা মামলার জুডিশিয়াল রিভিউর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। বিচারক জাস্টিন থ্রনটন শুনানি শেষে আজহারীর ভিসা বাতিলের পক্ষে রায় দেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

উল্লেখ্য, বিচারক জাস্টিন থ্রনটন সাবেক লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ডের স্ত্রী। বিভিন্ন সূত্র মতে Authority to carry Scheme 2021 এর 14,e অনুযায়ী আজহারীর করা আবেদনটি খারিজ করে দেওয়া হয়।

আজহারীর যুক্তরাজ্যে প্রবেশের ভিসা বাতিল নিয়ে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে অক্টোবর থেকেই আলোচিত বিষয় ছিল। সর্বশেষ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এমপি বব ব্ল্যাকম্যান আজহারীর যুক্তরাজ্য সফরের নিষেধাজ্ঞা চেয়ে বক্তব্য রাখায় আরো বেশি গুরুত্ব পায়।

সংসদে দেওয়া তার বক্তব্যে বব বলেন, আজহারীর বক্তব্যে ব্রিটেনের মুসলিম কমিউনিটি বৃহৎ অংশ বিভ্রান্ত হতে পারে, সমাজে ঘৃণা ছড়াতে পারে, তাই তাকে ব্রিটেনে প্রবেশ করতে না দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন।

পার্লামেন্টে তার নির্ধারিত বক্তব্যে বলেছেন, বাংলাদেশের ঘৃণা ছড়ানো ইসলামিক বক্তা মাওলানা আজহারীকে লণ্ডনে রয়েল রিজেন্সী হলে ইসলামী কনফারেন্সে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল, সে যুক্তরাজ্যে আসার জন্য কাতারে এসে আটকে আছে। এরকম ঘৃণা ছড়ানো ব্যক্তি যে হিন্দু ও ইহুদি ধর্মের প্রতি ঘৃণা ছড়ায় তাকে ব্রিটেনে ঢুকতে দেওয়া ঠিক হবে না।

মিজানুর রহমান আজহারী ব্রিটেনে ঢুকলে তার বক্তব্যের মাধ্যমে এখানকার শান্তিপ্রিয় বৃহৎ মুসলিম জনগোষ্ঠী ভুল তথ্য পেয়ে বিভ্রান্ত হতে পারে। এমনকি সে অনলাইনেও এই ধরনের ঘৃণা ছড়াতে পারে।

ব্ল্যাকম্যান এমপি সংসদে মিজানুর রহমানের ভিসা বাতিল বহালের আলোচনার জন্য হোম সেক্রেটারী প্রীতি প্যাটেলের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন।

ব্ল্যাকম্যান এমপির এই বক্তব্যের পর সংসদ লিডার স্যার জ্যাকব রিস বলেন, বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, এই দেশে ঘৃণা ছড়ানো একটি মারাত্নক অপরাধ। ঘৃণা ছড়ায় এমন কাউকে আমরা এই দেশে প্রবেশ করতে দিতে পারি না। ঘৃণা ছড়ানোর বিরুদ্ধে আমাদের একটি অবস্থান রয়েছে সেটার ভিত্তিতে হোম সেক্রেটারীর কাছে বিষয়টি অবগত করা হয়েছে।


ছবি: মিজানুর রহমান আজহারীর বিতর্কিত ওয়াজের কিছু নমুনা।

অন্যদিকে আজহারীকে ব্রিটেনে নিয়ে আসতে আয়োজক, আতাউল্লাহ ফারুক একটি পিটিশন ক্যাম্পেইন শুরু করেছিলন। মিজানুর রহমান আজহারী নিজে ও তার ফেসবুকে এই সংক্রান্ত একটি বক্তব্য প্রচার করে পিটিশনে তার পক্ষে স্বাক্ষর দেওয়ার অনুরোধ জানান। সর্বশেষ সেখানে প্রায় ৩৯ হাজার মানুষ স্বাক্ষর করেন।

তবে এত কিছু করেও শেষ রক্ষা হয়নি আজহারীর।

গত ৩১ অক্টোবর একটি ইসলামী কনফারেন্সে যোগ দিতে মালয়েশিয়া থেকে লন্ডনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন মিজানুর রহমান আজহারী। কিন্তু লন্ডনে আসার পথে কাতারে ট্রানজিটে আটকা পড়েন মিজানুর রহমান আজহারী। কাতারের ইমিগ্রেশন থেকে আজহারীকে লন্ডনের বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি।

২ দিন দেন দরবারের পরে ব্রিটিশ সরকার তার ভিসা বাতিল করে দেয়। বাতিল করা ভিসা বহালের জন্য লণ্ডনে আজহারীর পক্ষে আইনি লড়াই চালিয়েছিলেন আয়োজকগণ। যদিও ব্রিটেনে যে অনুষ্ঠানে মিজানুর রহমান আজহারী উপস্থিত থাকার কথা সেই অনুষ্ঠান আয়োজক আইওন টিভি অনুষ্ঠানটি স্থগিত ঘোষণা করেছে।

এই ব্যাপারে হোম অফিসের মিডিয়া এন্ড প্রেস অফিসে যোগাযোগ করা হলে তারা এই বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে।

মিজানুর রহমান আজহারীর বিষয়টি নিয়ে তাদের কাছে আরো অনেকেই জানতে চেয়েছেন। কিন্তু বাধ্যবাধকতা থাকায় তার কোনো তথ্য দেননি। আমন্ত্রণকারীদের পক্ষ থেকেও কোনো ধরনের স্বচ্ছ ধারণা না দেওয়াতে নানা রকম আলোচনা সমালোচনা চলছিল।

লন্ডনের আয়োজকগণ আইনিভাবে আজহারীর যুক্তরাজ্য সফর নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন এবং জরুরী জুডিশিয়াল রিভিউর আবেদন করেছিলেন এবং ভার্চুয়াল আদালতে তার শুনানি হয়। বিচারক ব্রিটেন প্রবেশে আজহারীর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি বহাল রাখেন। ভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে যুক্তরাজ্যে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় আজহারীকে।

গত ১৮ নভেম্বর হাইকোর্টের রায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে আইওন টিভির সিইও আতাউল্লাহ ফারুক কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি। তিনি বলেন, যেহেতু আইনি বিষয়, আমার আইনজীবীরও নিষেধ আছে এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে।

গত ৩১ অক্টোবর রবিবার থেকে লণ্ডনসহ ব্রিটেনের ৬টি শহরে ইসলামী বক্তব্যের আয়োজন করা হয় ব্রিটেনের আইওন টিভির পক্ষ থেকে। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে সারা ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে ১৫ পাউন্ড থেকে ১০০ পাউণ্ডের মূল্যের ১২ হাজার টিকিট বিক্রি হয়েছিল।

মিজানুর রহমান আজহারীর যুক্তরাজ্যে সফরের সংবাদ প্রকাশের পর থেকেই কমিউনিটিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। অনেকেই আয়োজক আইওন টিভির ব্যানারে আজহারীর আগমনকে স্বাগত জানিয়েছেন আবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি থেকে শুরু করে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অনেক মানুষ আজহারীর সফরের বিরোধীতা করে আসছিলেন।

অনেকেই ব্রিটিশ এমপি থেকে শুরু করে হোম অফিসসহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট জায়গায় মিজানুর রহমান আজহারীর বিভিন্ন বক্তব্য যেখানে অন্য ধর্মকে আঘাত করা হয়েছে, যেসব বক্তব্য ঘৃণা ছড়ায় এমন সব ভিডিও পাঠানো হয়েছে। এমনকি আজহারীর ওপর হযরত মোহাম্মদ (স.) কে অবমাননা করে বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগও আছে।

উল্লেখ্য, বিতর্কিত বক্তব্যের কারণে দেশের বিভিন্ন জায়গায় আজহারীর সভা বন্ধ করে দেওয়া হয় গতবছর। তারপর তিনি সভা করতে না পেরে দেশ ছেড়ে যান। বছরের প্রায় পুরোটা সময় থাকেন মালয়েশিয়ায়। উপার্জিত অর্থ দেশের কোনো ব্যাংকেও রাখেন না। বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা চলে যায় মালয়েশিয়ায়।

ধর্মীয় সভায় সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে আদালত অবমাননাকারী মন্তব্য করার কারণে অনেক জায়গায় প্রশাসন তার সভার অনুমতি বাতিল করে দেয়। এরপরই তিনি দেশ ছেড়ে যান। তার সভা বন্ধ করার বিষয়ে সরকারি দপ্তরগুলো প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে।

জানা গেছে, আজহারী তার ধর্মসভার নামে রাজনৈতিক সভা থেকে উপার্জিত বিপুল অর্থ নিয়ে মালয়েশিয়া চলে গেছেন। আজহারী তার প্রতিটি সভায় ন্যূনতম ৩ লক্ষ থেকে সর্বোচ্চ ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত চার্জ করেন। এই অর্থ তাকে বুকিংয়ের সময় পুরোটা বুঝিয়ে দিতে হয়। অনেক জায়গায় তাকে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যেতে হয়। সভা শেষে গন্তব্যে একইভাবে পৌঁছে দিতে হয়।

অনেক সময় সভা সমাপ্তির পর অনুরাগীরা তাকে নগদ টাকা উপহার দেন। সেসবের পরিমাণ হিসেবের বাইরে। শীতকালীন এ সময়ে তিনি শতাধিক ধর্মসভা করেন। সে হিসেবে তার এ সময় আয় ৩ থেকে ৫ কোটি টাকা। যা থেকে এক পয়সাও তিনি সরকারকে আয়কর দেন না।

প্রসঙ্গত, এর আগে ২০০৬ সালে, যুক্তরাজ্যে তৎকালীন ৪ দলীয় জোটের সরকারের সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত রাজাকার দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকেও যুক্তরাজ্যে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল দেশটির প্রশাসন।

শেয়ার করুন !
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!