সুনামগঞ্জ সংবাদদাতা:
অভাবের তাড়নার পাশাপাশি সরকারিভাবে বন্দোবস্তপ্রাপ্ত ভূমি উদ্ধারে প্রশাসনের সহায়তা না পাওয়ার ক্ষোভে অবশেষে স্বাধীনতার মাসেই মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে দাঁড়িয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করলেন জলফে আলী (৭৮) নামের এক বয়োবৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা। সুনামগঞ্জে গতকাল প্রয়াত বয়োবৃদ্ধ এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে শেষবারের মত রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় নিজ গ্রামেই দাফন করা হয়।
রবিবার বিকালে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে গিয়ে তিনি কীটনাশক পান করেন। জলফে আলী সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার জাহাঙ্গীরনগর ইউনিয়নের গুদিগাঁও গ্রামের আমির আলীর ছেলে। তিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্থানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীরত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, রবিবার সকালে সিলেটে যাবার কথা বলে জলফে আলী সদর উপজেলার গুদিগাঁও’র নিজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে জেলা শহর সুনামগঞ্জ পৌছে সকাল ১০টায় জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৯তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবসে ৭১’র সহযোদ্ধা, সরকারি-বেসরকারি দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃদ্ধের সাথে জেলা শহরে শিশু সমাবেশ ও বর্ণাঢ্য আনন্দ র্যালিতে অংশগ্রহণ করেন।
এরপর দুপুরে তিনি ফিরে যান জেলা শহরে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে। মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের ৩য় তলার শৌচাগারে যান। কিন্তু ঘন্টা তিনেক পেরিয়ে গেলেও যখন তিনি নিচ তলায় অফিসে ফিরে না আসায় বিকেল ৪টার দিকে তার সন্ধানে ৩য় তলায় যান নৈশপ্রহরী সোহাগ। শৌচাগারের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ দেখেন তিনি। কিন্তু ভেতর থেকে কোন সাড়া না পেয়ে আশপাশের লোকজনকে ও ব্যবসায়ীদের ডেকে তিনি জড়ো করেন। এক পর্যায়ে শৌচাগারের দরজা ফুটো করে দেখেন একজন মানুষের নিথর দেহ পড়ে আছে।
পরবর্তীতে সদর মডেল থানা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে দরজা ভেঙে শৌচাগারের ভেতর পড়ে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধা জলফে আলীর লাশ উদ্ধার করে। লাশের পাশেই পড়েছিল কীটনাশকে বিষের বোতল।
সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার এসআই প্রদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বিষপান করেই বীর মুক্তিযোদ্ধা আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন। সুরতহাল রিপোর্ট তৈরীর পর রবিবার রাতে লাশ মর্গে পাঠানোর পর ময়নাতদন্ত শেষে ওই রাতেই প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধার লাশ পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়।
এ ব্যাপারে প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী মরিয়ম বিবি রবিবার রাতে সদর মডেল থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা ডায়রিভুক্ত করেন। ওই মামলায় তিনি তার স্বামীর মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করেছেন।
জানা গেছে, জলফে আলী একজন রাষ্ট্রীয় ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। প্রথম পক্ষের স্ত্রীর ৪ ছেলে মেয়ে ঢাকায় বসবাস করছে এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে। এদিকে গ্রামের বাড়ি সুনামগঞ্জের গুদিগাঁও দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করতেস জলফে আলী। এই সংসারের ২ মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন অন্যত্র। মেয়ের জামাইরাও দিনমজুরি করেন।
সোমবার দাফন শেষে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গুদিগাঁও নিজ বাড়িতে সদ্য প্রয়াত বীর মুত্তিযোদ্ধা জলফে আলীর বিধবা স্ত্রী মরিয়ম বিবি (৫৫) ও তার পরিবারের সদস্যদের সাথে এ প্রতিবেদকের আলাপকালে তারা জানান, ভূমিহীন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে জলফে আলী সদর উপজেলার নারায়ণতলা মৌজায় প্রায় ২ যুগ পুর্বে ৮০ শতাংশ ভূমি সরকারিভাবে বন্দোবস্ত প্রাপ্ত হন। এরপর ওই জমিতে নিজের খরচে একটি টিনশেডের তৈরী ছোট বসতঘর করে বসবাস করলেও, বাকি অংশ ন্যরা দখল করে ভোগ করতে থাকে।
ওই জমি নিজের দখলে পেতে গত প্রায় ৫ থেকে ৬ বছর ধরে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে আবেদন- অভিযোগ করেও দিনের পর দিন ধর্ণা দিয়েও সরকারি বন্দোবস্ত প্রাপ্ত জমি উদ্ধারে প্রশাসনের তরফ থেকে কোন রকম সহযোগিতাই পাননি বয়োবৃদ্ধ বীর মুক্তিযোদ্ধা জলফে আলী। এসব কারনে তিনি স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি ক্ষোভের পাশাপাশী ক্রমশ হতাশায় ভুগছিলেন। এমন হতাশা থেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে বয়োবৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা শরীরে নানা রোগব্যাধি এবং সংসারে অভাব অনটনও জেঁকে বসে।
প্রথম পক্ষের প্রয়াত স্ত্রীর ৪ ছেলে মেয়ে ঢাকায় থাকলেও দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেয়া ২ মেয়েকে গ্রামেই বিয়ে দেয়া হয়। দুই মেয়ের পরিবারও ছিল অস্বচ্ছল। মেয়ের জামাইরা দিনমজুরি করে কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করতেন।
সোমবার প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী মরিয়ম বিবি জানান, জমিটি পুরোপুরি উদ্ধার হলে জীবনের শেষ সময়ে ঢাকায় ও গ্রামে থাকা ছেলে মেয়েদের বসবাসের জায়গা করে দিয়ে যাবার জন্য তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। কিন্তু জমি উদ্ধারে তিনি প্রশাসনের কোন সহযোগিতা না পেয়ে হতাশায় ভুগতে ভুগতে গত কয়েক মাস ধরেই আক্ষেপ করে বলছিলেন- জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলাম, জাতীর জনকের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সকল মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবার পরিজনকে নানা সুযোগ সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি সম্মান এবং ভালবাসাও দিয়েছেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসনে কোন প্রয়োজনে গেলে আমাদের তেমনভাবে মূল্যায়ন করা হয়না।
মরিয়ম বিবি আরো বলেন, মৃত্যুর দিন কয়েক পুর্বেও তিনি জমি উদ্ধারে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট আরো এক দফা মৌখিকভাবে এমনকি লিখিত আবেদনও করেছিলেন কিন্তু তাতেও সাড়া পাওয়া যায়নি, তাই প্রশাসনের সহায়তা না পাওয়ার ক্ষোভে ও অভাবের তাড়না সইতে না পেরেই তিনি আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন।
সোমবার সন্ধ্যা ৭টা ১৯ মিনিটে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইয়াসমিন নাহার রুমার নিকট এ বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত করে উনার বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, বহু বছর পুর্বে মুক্তিযোদ্ধা জলফে আলী ৮০ শতাংশ ভূমি সরকারিভাবে বন্দোবস্ত পেয়েছেন বলে বিষয়টি আমি জানি। মৃত্যুর দিন কয়েক পুর্বে উনি আমার সাথে অফিসে এসে দেখা করে আমাকে মৌখিকভাবে ওই ভূমি অন্যদের দখলের থাকা ও সেটি উদ্ধারের জন্য সরকারি সহায়তা চেয়েছেন। কিন্তু লিখিতভাবে কোন আবেদন তিনি করেননি।