৭ নৌপরিবহন কর্মকর্তার স্ত্রী জাহাজের মালিক, একজনের নামেই আছে ৮টি!

0

সময় এখন ডেস্ক:

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ৭ কর্মকর্তার গৃহিণী স্ত্রীরা জাহাজের মালিক হয়েছেন। এর মধ্যে এক কর্মকর্তার স্ত্রীর নামেই রয়েছে ৮টি জাহাজ। বাকি ৫ জনের রয়েছে একটি করে।

ওই কর্মকর্তারা অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ স্ত্রীদের নামে জাহাজ ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ কর্মকর্তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছে। খবর দৈনিক সমকালের।

দুদক এরই মধ্যে বিআইডব্লিউটিএর এই ৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নদীপথ খননে ঠিকাদারদের জিম্মি, ড্রেজিংয়ের নামে ভুয়া বিল-ভাউচার জমা, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দলীয় বীমা ও ভবিষ্য তহবিলের অর্থ আত্মসাৎসহ নানা দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৩টি জাহাজের নিবন্ধন করা হয়েছে ৭ কর্মকর্তার স্ত্রীদের নামেই। এর মধ্যে বিআইডব্লিউটিএর সাবেক উপ-পরিচালক আবু বকর সিদ্দিকের স্ত্রী ইসরাত জাহান পাপড়ি এককভাবে দুটি এবং অন্য অংশীদারদের সঙ্গে ৬টিসহ মোট ৮টি জাহাজের মালিক।

বাকি ৬ কর্মকর্তার স্ত্রীরা প্রতিষ্ঠা করেছেন মেসার্স ডজনরোজ (১২ গোলাপ) নামে একটি কোম্পানি। এতে পরিচালক ১২ জন। এর পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমেদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. রিয়াজুল ইসলাম।

কোম্পানিটিতে পরিচালক হিসেবে থাকা ৬ কর্মকর্তার গৃহিণী স্ত্রীরা হলেন- বিআইডব্লিউটিএর সাবেক পরিচালক ও সাবেক সচিব মো. শফিকুল হকের স্ত্রী শামীমা আক্তার। ডজনরোজ প্রতিষ্ঠার সময় এই কর্মকর্তা চাকরিতে বহাল ছিলেন। যুগ্ম পরিচালক গুলজার আলীর স্ত্রী সালমা হক। পরিচালক মুহাম্মদ রফিকুল ইসলামের স্ত্রী শাহিদা খানম।

উপ-পরিচালক (নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক) মোহাম্মদ শাহজাহান সিরাজের স্ত্রী হালিমা বেগম, কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজের স্ত্রী ফারজানা আফরোজ এবং আরেক কর্মকর্তা মো. কাউসারের স্ত্রী আঞ্জুমান।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক উপ-পরিচালক আবু বকর সিদ্দিকের স্ত্রী ইসরাত জাহান পাপড়ি এককভাবে যাত্রীবাহী এমভি রাজহংস-৭ ও রাজহংস-১০ জাহাজ দুটির মালিক। অন্য উদ্যোক্তার সঙ্গে তার যৌথ মালিকানার জাহাজগুলোর মধ্যে রয়েছে- এমভি রাজহংস-৮, বন্ধন-৫, আল জামিউ-২, আল জামিউ-৩ ও এমভি শাহরুখ-১।

যৌথ মালিকানায় থাকা অপর একটি জাহাজের নাম সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তার জাহাজগুলোর মধ্যে বন্ধন-৫সহ কয়েকটি যাত্রীবাহী এবং আল জামিউ-২, এমভি শাহরুখ-১সহ কয়েকটি জাহাজ পণ্যবাহী।

এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেকের বক্তব্য জানার জন্য বারবার তার দুটি মোবাইল নম্বরে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। একপর্যায়ে খুদে বার্তা (এসএমএস) পাঠাতে বলেন। পরিচয় দিয়ে বার্তা পাঠিয়ে কথা বলতে চাইলে তিনি ফিরতি বার্তায় কথা বলবেন না বলে জানিয়ে দেন।

তবে অভিযুক্ত বিআইডব্লিউটিএর সাবেক উপ-পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক দাবি করেন, তার নামে কোনো জাহাজ নেই। জাহাজ ব্যবসা করেন তার স্ত্রী ইসরাত জাহান পাপড়ি। এ কারণে তার ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ গেছে।

আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ডজনরোজ কোম্পানির জাহাজ আছে। তার স্ত্রী কোম্পানির পরিচালক।

ইসরাত জাহান পাপড়ির মালিকানাধীন জাহাজগুলোর মধ্যে ঢাকা-ঈদগা ফেরিঘাট রুটে চলাচল করে যাত্রীবাহী এমভি রাজহংস-৭, ঢাকা-ভাসানচর রুটে রাজহংস-৮, ঢাকা-ভাসানচর রুটের রাজহংস-১০ এবং ঢাকা-নুরাইনপুর-কালাইয়া রুটে চলাচল করে বন্ধন-৫।

বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক মোহাম্মদ শাহজাহান সিরাজ বলেন, এমভি ডজনরোজ-১ জাহাজে তার স্ত্রী হালিমা বেগমের শেয়ার রয়েছে।

তার স্ত্রী গৃহিণী হয়েও জাহাজের মালিক, টাকার উৎস কী- জানতে চাইলে শাহজাহান সিরাজ বলেন, টাকার উৎস সম্পর্কে সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠানে জানানো দরকার, সেসব প্রতিষ্ঠানে তথ্য দেওয়া হয়েছে।

ডজনরোজের এমডি রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ১২ জন ১৫ লাখ করে টাকা জমা দিয়ে ২০১৮ সালে ডজনরোজ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। জাহাজ ব্যবসার পাশাপাশি তিনি ঠিকাদারি কাজ করেন।

ডজনরোজের অন্য পরিচালকরা হলেন- ফাতেমা পারভীন, রাফিজা খানম, নুরুন্নাহার পারভীন ও বিলকিস আক্তার। এই ৪ জনের মধ্যে কারও বিআইডব্লিউটিএর সঙ্গে সংশ্নিষ্টতা আছে কি না বা কারও স্বামী ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কি না, তা যাচাই করছে দুদক।

জানা গেছে, পণ্যবাহী ডজনরোজ-১ জাহাজটি নির্মাণে খরচ হয়েছে ৩ কোটি টাকা। জাহাজটির ধারণক্ষমতা ৯০০ টন। এর মাধ্যমে ভারতের দমদম থেকে সিমেন্টের কাঁচামাল ফ্লাই অ্যাশ আনার কাজ করা হচ্ছে।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, দুর্নীতির মাধ্যমে বিআইডব্লিউটিএর কতিপয় কর্মকর্তা পরোক্ষভাবে জাহাজের মালিক হওয়ার অভিযোগটি গত বছরের শেষ দিকে দুদকে পেশ করা হয়। এরপর ওই বছর ১৫ ডিসেম্বর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন উপ-পরিচালক আবু বকর সিদ্দিক।

বর্তমানে তিনি পোস্ট রিটায়ারমেন্ট লিভ (পিআরএল) সময় অতিবাহিত করছেন। এটি শেষ হবে আসছে ১৫ ডিসেম্বর।

দুদক জানায়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জাহাজের মালিক হওয়া আরও কিছু কর্মকর্তা বিআইডব্লিউটিএতে কর্মরত আছেন। তাদের এখনও চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত আছে।

৮টি জাহাজের মালিক হওয়ার বিষয়ে ইসরাত জাহান পাপড়ির সরাসরি বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে এ নিয়ে দুদকে দেওয়া লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেছেন, বে ওয়াটার সার্ভিস লিমিটেডের মালিক আলহাজ মাহমুদুল হক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক থেকে নেওয়া ১ কোটি টাকার ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ৪টি জাহাজ বিক্রি করে দেন।

পরে তিনি এবং অপর ৩ জন মিলে সুদসহ মাহমুদুল হকের ব্যাংক ঋণের ৯৫ লাখ টাকা পরিশোধ করেন। অন্য দু’জন হলেন- এম এ ওয়াহিদুজ্জামান ও মো. ওহিদুজ্জামান। পরে ব্যবসায়ী মাহমুদুল হক ৪টি জাহাজ তাদের কাছে বিক্রি করেন। ওই ৪টি জাহাজের আয়ের অর্থ দিয়ে তারা যৌথ মালিকানায় আরও জাহাজ ক্রয় করেছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ৯৫ লাখ টাকায় ৪টি জাহাজ ক্রয় এবং এই ৪টি জাহাজের আয়ের অর্থ দিয়ে আরও জাহাজ ক্রয়ের বক্তব্য অবিশ্বাস্য ও বিভ্রান্তিকর।

সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, ৯০০ থেকে ১ হাজার টন ধারণক্ষমতার একটি জাহাজের নির্মাণ খরচ পড়ে আড়াই থেকে ৩ কোটি টাকা। সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার টন ধারণক্ষমতার একটি জাহাজ নির্মাণে ৬-৭ কোটি টাকা খরচ পড়ে।

দুদক থেকে জানা গেছে, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের পরোক্ষভাবে জাহাজের ব্যবসা শুরুর অভিযোগ গত বছর দুদকের গোয়েন্দা ইউনিট থেকে যাচাই করা হয়। পরে কমিশন অভিযোগটি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।

উপ-পরিচালক মো. মশিউর রহমানকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় চলতি বছরের ১৭ আগস্ট। অনুসন্ধান কর্মকর্তা গত ২৯ সেপ্টেম্বর বিআইডব্লিউটিএকে চিঠি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কোন কোন কর্মকর্তার জাহাজ ব্যবসা আছে, তা জানতে চান। জবাবে গত ৭ অক্টোবর কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্মকর্তা জাহাজ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত নন।

কর্তৃপক্ষের চিঠির পর কোন কোন কর্মকর্তার মালিকানায় জাহাজ আছে, সেই প্রমাণসহ বিআইডব্লিউটিএর কাছে দুদক চিঠি পাঠায় গত ১১ অক্টোবর। এরপর বিআইডব্লিউটিএর জাহাজ ব্যবসায় জড়িত ৯ জন কর্মকর্তার নাম-পদবিসহ কাগজপত্র দুদকে পাঠায় গত ২১ অক্টোবর।

এরপর জাহাজের রেজিস্ট্রেশনসহ ওই সব কর্মকর্তা সম্পর্কে তথ্য জানতে চেয়ে দুদক নৌপরিবহন অধিদপ্তরে চিঠি দেয় গত ১১ অক্টোবর। এই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে অধিদপ্তর দুদককে চিঠি দিয়ে তথ্য জানায় গত ২ নভেম্বর।

প্রসঙ্গত, বিআইডব্লিউটিএ অভ্যন্তরীণভাবে যাত্রীবাহী নৌযানের অনুকূলে রুট পারমিট দেওয়া, বাংলাদেশ-ভারত নৌ প্রটোকল রুটের ভয়েজ পারমিশন, নদী দখল উচ্ছেদ, ড্রেজিং, বিভিন্ন বন্দর, ফেরিঘাট, উন্নয়ন, নদীতে মার্কা, বয়া স্থাপন করা, নদী জরিপ করার কাজ করে থাকে।

এদিকে বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তাদের এমন লাগামছাড়া দুর্নীতি এবং তাদের গৃহিণী স্ত্রীদের এভাবে জাহাজের মালিক বনে যাওয়া নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশের সচেতন মহল। দুদককে কঠোর হওয়ারও পরামর্শ দেন অনেকেই। সংবাদটি প্রকাশের পর গতকাল ফেসবুকে দেখা গেছে পাঠকদের তীব্র প্রতিক্রিয়া।

পাঠকদের দাবি, নদীখেকো প্রভাবশালী মহলের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের মাধ্যমে বিআইডব্লিউটিএ’র কর্মকর্তারা এবং তাদের পরিবার এভাবে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে। তাদের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক করার দাবি জানিয়েছেন পাঠকরা।

শেয়ার করুন !
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!