ফিচার ডেস্ক:
ইতিহাসের বিখ্যাত ও রক্তক্ষয়ী যেসব হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল, তাদের পেছনে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মদদ যুগিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মূলত, তাদের অঙ্গুলি হেলনেই ইতিহাস থেকে ঝরে গিয়েছিল এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা হয়ত বৈশ্বিক পটভূমিকেই পরিবর্তন করে দিতে পারতো অনেকখানি।
ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, যাদের পেছনে মার্কিনিদের মদদ ছিল-
ফিদেল কাস্ত্রো: ঊনবিংশ শতকে পৃথিবীর বুকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, লাতিন আমেরিকান কিউবার বিপ্লবী ফিদেল কাস্ত্রো ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর কিউবার হাভানায় মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, তার মৃত্যুর পেছনে সিআইএ’র হাত রয়েছে।
এটা বিশ্বাস করার কারণও আছে। কিউবার একনায়ক ফিদেল কাস্ত্রোর ওপর সারাজীবনে মোট ৬৩৪ বার আততায়ী হামলা চালানো হয়েছিল। যেসব হামলায় অধিকাংশেই জড়িত ছিল সিআইএ। তার ওপর যেসব হামলা চালানো হয়েছিল, তা পর্যালোচনা করলে বিপর্যয়পূর্ণ তো বটেই, কিছু কিছু হাস্যকর প্রচেষ্টাও ছিল।
১৯৬০ সালে ফিদেল কাস্ত্রোর প্রিয় সিগার বক্সে বিষ মিশিয়ে দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের সময় দুই গ্যাংস্টারকে নিযুক্ত করেছিল ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যা করার জন্য। এই দুই গ্যাংস্টারকে হাত করবার জন্য সিআইএ আবার থার্ড পার্টি কন্ট্রাক্টরদের শরণাপন্ন হয়েছিল।
ফিদেল স্কুবা ডাইভিং করতে খুব পছন্দ করতেন। এই বিষয়টিকে কাজে লাগানোর জন্য ১৯৬৩ সালে সিআইএ একটি বড় আকারের সামুদ্রিক ঝিনুকের মধ্যে বিস্ফোরক লুকিয়ে রেখে তার ওপর রঙ করে দেয়। যেন রঙিন ঝিনুক দেখে কাস্ত্রো আকৃষ্ট হয়ে সেটার কাছে যান এবং বিস্ফোরণে মারা যান।
ঠিক একই বছর, অর্থাৎ ১৯৬৩ সালে ফিদেল কাস্ত্রোর সুইমস্যুটের ভেতরে এমন এক জাতের ফাঙ্গাস রাখা হয়, যার কারণে মারাত্মক চর্মরোগ হতে পারে এবং আক্রান্ত ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে। সৌভাগ্যও বলতে হবে, সেবারও প্রাণে বেঁচে যান কাস্ত্রো।
মারিতা লরেঞ্জ নামের এক নারীর সাথে কাস্ত্রোর প্রণয় ছিল বলে অনেকের ধারণা। লরেঞ্জ ১৯৯৩ সালে ভ্যানিটি ফেয়ারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ১৯৫৯ সালে কাস্ত্রোর সাথে প্রণয় চলাকালীন সময়ে সিআইএ তাকে নিযুক্ত করে কাস্ত্রোকে হত্যার উদ্দেশ্যে।
১৯৬০ সালে সিআইএ কাস্ত্রোর ভাষণকে স্যাবোটাজ করার চেষ্টা করে। কাস্ত্রোর ব্রডকাস্টিং স্টুডিওতে এমন একধরণের রাসায়নিক তরল স্প্রে করা হয়, যার মাধ্যমে যেন কাস্ত্রো হ্যালুসিনেশনের শিকার হন।
চে গুয়েভারা: ‘আমাদের সামনে তিনটি পথ খোলা আছে: আমরা যৌথ উদ্যোগে একটি সমন্বিত উন্নয়নের মাধ্যমে সুখী, সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে পারি; সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী নতুন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পারি অথবা নিজ নিজ দেশে জেঁকে বসা কায়েমি শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের হাতিয়ার কেড়ে নিয়ে শোষণযন্ত্র গুঁড়িয়ে দিতে পারি, কিউবা যে পথ একবার বেছে নিয়েছিল।’- কথাগুলো বলেছিলেন রোমান্টিক বিপ্লবী হিসেবে খ্যাত চে গুয়েভারা।
দেশের আকার, রাষ্ট্রের শক্তি ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্বিশেষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ অসম্ভব করে তুলছে, বলে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন।
১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়াতে নিহত হন বিপ্লবী আর্নেস্তো চে গুয়েভারা। তার মৃত্যু বৈশ্বিক রাজনৈতিক ইতিহাসে আজও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। চে-কে হত্যা করেছিল বলিভিয়ান সৈনিকেরা, কিন্তু অর্থনৈতিক মদদ ও প্রশিক্ষণ যুগিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন ব্যারেট এবং সিআইএ অপারেটিভরা।
প্যাট্রিস লুমুম্বা: দ্য ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ দ্য কঙ্গোর প্রথম বৈধভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী প্যাট্রিস লুমুম্বাকে হত্যা করা হয় ১৯৬১ সালের ১৭ জানুয়ারি। ইতিহাসের অন্যতম জঘন্য এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল আমেরিকান এবং বেলজিয়ান সরকারের ইন্ধনে। হত্যাকাণ্ডে কঙ্গোর সহায়তা নেয়া হয় এবং বেলজিয়ান হন্তারক স্কোয়াডকে নিযুক্ত করা হয় কাজটি করবার জন্য।
রাফায়েল ট্রুহিয়ো: রাফায়েল ট্রুহিয়ো ডমিনিকান রিপাবলিকের একনায়ক ছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি আততায়ীর দ্বারা নিহত হন। ১৯৩৮ সালের পর তিনি দ্বিতীয়বার ডমিনিকান রিপাবলিকের মসনদে বসেন এবং ১৯৪২ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন।
ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়েই রাষ্ট্রের জনগণ রাফায়েলের শাসনের বিরোধিতা করে এবং একইসাথে পররাষ্ট্রগতভাবেও তাকে নানা চাপের মুখোমুখি হতে হয়। সেনাবাহিনীর সহযোগিতাও হারাতে শুরু করেন তিনি। সিআইএ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবার জন্য ডমিনিকান সেনাবাহিনীকে নানাভাবে সাহায্য করে।
রেনে শ্নাইডার: চিলির সামরিক কমান্ডার রেনে ১৯৭৯ সালে অন্তর্ঘাতে নিহত হন। হেনরি কিসিঞ্জার এবং নিক্সন প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তিনি শমন পাঠান, যেখানে প্রায় ৩ মিলিয়ন ডলার অর্থমূল্যের ক্ষতিপূরণ দিতে বলা হয়েছিল।
চিলির প্রেসিডেন্ট হিসেবে সালভাদর আলেন্দে যেন আসীন না হতে পারেন, সেজন্য সেনাবাহিনীদের দ্বারা একই অভ্যুত্থানের আয়োজন করা হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। এই অভ্যুত্থানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শ্নাইডার।
১৯৭০ সালে আলেন্দে ক্ষমতায় আরোহণ করলেও সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭৩ সালে তিনিও নিহত হন। তখন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সুরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। তাকে রেনে শ্নাইডার টেলিফোন মেসেজ পাঠালেও কোনো প্রত্যুত্তর করেননি।
এনজিও দিন দিয়েম: দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট এনজিও দিন দিয়েমের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় ১৯৬৩ সালের ২রা নভেম্বর। ওই একইদিনে তার ভাই এবং উপদেষ্টা এনজিও দিন নহুকেও হত্যা করা হয়। দিয়েমের মৃত্যু দক্ষিণ ভিয়েতনামের জনগণের কাছে উল্লাসের কারণ হয়ে দাঁড়ালেও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নানা অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামের রাজনীতিতে নিজেদের আরও গভীরভাবে যুক্ত করে। তখনকার সময়ে কমিউনিস্ট বিদ্রোহীরা শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মার্কিনিরা তাদের প্রতিহত করতে ভিয়েতনামিজ সেনাবাহিনীকে মদদ যোগায়। দিয়েমকে হত্যার দায় যুক্তরাষ্ট্র না নিলেও পরে প্রকাশিত হয় যে যেসব উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তারা এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছিল, তাদের সাথে আমেরিকান কর্মকর্তাদের বেশ কয়েকবারই বৈঠক হয়েছে ঘটনার ঠিক আগে।
সালভাদর আলেন্দে: চিলির প্রথম কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিহত হয়েছিলেন। কিউবান নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আলেন্দে। কাস্ত্রো মনে করতেন মার্কিন পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে আলেন্দের এই সংগ্রাম সমগ্র লাতিন আমেরিকায় একটি নতুন অভ্যুদয়ের।
খুব স্বাভাবিকভাবেই আলেন্দের এই উত্থানকে মেনে নিতে পারেনি মার্কিনিরা। নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি আলেন্দেকে ক্ষমতা থেকে নানা কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের নানা অপকল্প ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবার পরে আলেন্দের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে দিয়েছিল জনতা ও সেনাবাহিনীকে, পেশাজীবীদের রোষ তুঙ্গে ওঠাতে আশ্রয় নিয়েছিল ধর্মঘটের।
শুধু তাই নয়, অনুগতদের পেছনেও তারা লক্ষ লক্ষ ডলার ঢালতে পিছপা হয় না। সেনাবাহিনী প্রধান পিনোশের নেতৃত্বে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানে সালভাদর আলেন্দে নিহত হন। ওয়াশিংটন প্রথমে সেই সামরিক অভ্যুত্থানের সঙ্গে তাদের যোগসূত্রের কথা অস্বীকার করলেও পরবর্তীকালে মার্কিন দলিলপত্রে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য।
বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। বাঙালির ইতিহাসে এ এমন এক দগদগে ক্ষত, যার ঘা কোনোদিন শুকাবে না, কোনোদিন শুকাবার নয়।
মার্কিন সরকারের একটি সাধারণ স্ট্র্যাটেজি রয়েছে, যা তারা সকল দেশেই প্রয়োগ করে থাকে স্থিতিশীলতা নষ্ট করবার জন্য। প্রথমে তারা উক্ত দেশের বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যমগুলোকে হাত করে। এরপর মিথ্যা ও অসত্য খবর নিয়মিত প্রচার করবার মাধ্যমে দেশটির স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দেয়।
শ্রমিকদের মাঝে বিপ্লব ঘটাবার চেষ্টা করে। একটু লক্ষ্য করলেই খেয়াল করা যাবে যে বঙ্গবন্ধু সরকার পতনের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত সকল কিছুই একই ফর্মূলা মেনে করা হয়েছে। বাংলাদেশের বামপন্থী এবং বিপ্লবের রোমান্টিকতায় ভোগা গোষ্ঠীর পেছনে সিআইএ’র মদদ ছিল।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুকে প্রতিদ্বন্দ্বী জ্ঞাপন করতেন। কিসিঞ্জারের সাবেক স্টাফ অ্যাসিস্ট্যান্ট রজার মরিস এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভ্যূদয়কে কিসিঞ্জারি এর ব্যক্তিগত পরাজয় বলে মনে করতেন। কিসিঞ্জারের বিদেশি শত্রুর তালিকায় সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিরা হচ্ছেন আলেন্দে, থিউ ও মুজিব।… এবং মুজিবের বিজয় ছিল আমেরিকার শাসকবর্গের পক্ষে অত্যন্ত বিব্রতকর।”
১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পরের মাসগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন তারবার্তার মাধ্যমে মার্কিনিদের নানা কূটকৌশলের ব্যাপারগুলো উঠে আসে। দিল্লিতে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম স্যাক্সন, বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার প্রমুখের নাম উঠে আসে। তাদের সাথে খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহাবুব আলম চাষীসহ সেনাবাহিনীর একটা অংশের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল।
মূলত, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকাই তাকে মার্কিনিদের শ্যেনদৃষ্টিতে নিয়ে আসে। এরওপর ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্য।
উপরোক্ত ঘটনাগুলোতে একটা বিষয় নিশ্চিত, মার্কিনিদের স্বার্থে যখনই কোনো আঘাত আসে বা আসবার উপক্রম হয়, তখন ছলে-বলে-কৌশলে তারা যেভাবেই হোক, তা প্রতিহত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে।