ফিচার ডেস্ক:
যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সরব হলেও তাদের নিজেদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। আর এই ভয়াবহ চিত্র উঠে আসে খোদ তাদের দেশের মিডিয়া আর মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে।
মার্কিন মিডিয়া ওয়াশিংটন পোস্ট ২০১৫ সালের শুরু থেকে এ বছর ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ হাজার ৮০০ পুলিশি হত্যার তথ্য নথিভুক্ত করেছে। তাদের হিসাবে গড়ে প্রতিবছর সেখানে ১ হাজার পুলিশি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়।
এদিকে মার্কিন মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর কারাগারে থাকতে বাধ্য হওয়া (এক দিনের জন্য হলেও) মানুষের সংখ্যা ২৩ লাখ। ওই বছর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে ৮ জনের।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, মার্কিন পুলিশ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান অনুসরণ করে না।
স্বনামধন্য মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই শান্তি, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, জাতিগত সমতার মতো বিষয়গুলোতে নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে চিত্রিত করতে চাইলেও বাস্তবতা হলো তারাই বিশ্বশান্তির জন্য সব থেকে বড় হুমকি। মার্কিন সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলকে শোচনীয় পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দুই কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড ও ব্রেয়োনা টেলরের পুলিশি হত্যা এবং জ্যাকব ব্লেককে গুলির ঘটনা ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। পুলিশের জবাবদিহিতা, তাদের ক্ষমতা হ্রাস, আদালতের জরিমানা এবং ফি বর্জন এবং কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়গুলোতে ব্যাপক পরিমাণে বিনিয়োগের প্রশ্নকে সামনে এনেছিল ওই ৩টি ঘটনা।
এইচআরডব্লিউ বলছে, অপরাধে মুখ্য ভূমিকা পালনকারী দারিদ্র্য কিংবা স্বাস্থ্য-সঙ্কট মোকাবিলা করার পরিবর্তে মার্কিন বিচারব্যবস্থা দরিদ্র ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণাত্মক পুলিশিংকে প্রাধান্য দেয়, কারাগারে এবং পুলিশের সহিংসতার একটি দুষ্টচক্রকে ইন্ধন দেয়।
ওয়াশিংটন পোস্টের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশি হত্যার শিকার হয়েছেন ৯১৮ জন। এইচআরডব্লিউ বলেছে, যদিও কোনো সরকারি সংস্থা পুলিশি হত্যাকাণ্ডের খোঁজ রাখে না, তবে ওয়াশিংটন পোস্টের ডাটাবেজ বছরে গড়ে ১ হাজার হত্যা লিপিবদ্ধ করেছে, যা উল্লেখযোগ্যভাবে জাতিগত বৈষম্যকে সামনে এনেছে।
এতে দেখা যায়, কৃষ্ণাঙ্গরা শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় উচ্চতর স্তরে বল প্রয়োগ, নির্বিচার গ্রেপ্তার, আটক ও হয়রানিসহ নানা ধরনের পুলিশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। নেটিভ আমেরিকানদের ওপরও একই কায়দায় নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়, এবং কালো মানুষদের চেয়েও তারা বেশি হত্যার শিকার হয়।
এদিকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালে পুলিশি হত্যার শিকার হওয়া মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে ১ হাজার। তারা বলেছে, এ সংক্রান্ত তথ্য খুব ভালোভাবে জনসম্মুখে না এলেও এটা স্পষ্ট, হত্যার শিকাররা বেশিরভাগই কৃষ্ণাঙ্গ।
অ্যামনেস্টির মতে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অঙ্গরাজ্যেই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান মানা হয় না।
কারাবন্দি রাখার ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বনেতার ভূমিকায় রয়েছে। এইচআরডব্লিউর হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর নতুন করে কারাগারে যেতে হয় ১০ লাখ মানুষকে। ২০২০ সালে কোনো না কোনোদিন কারাগারে থাকতে বাধ্য হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা ২৩ লাখ।
ওই বছরে বিচার-পূর্ববর্তী অবস্থায় কোনো না কোনোদিন কারাগারে থাকতে বাধ্য হয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা ৫ লাখ।
বিচার-পূর্ব কারাবাস অনেক মানুষকে অপরাধ না করেই দোষ স্বীকারে অথবা অর্থ পরিশোধ করে জামিন নিতে বাধ্য করে। এক্ষেত্রেও তীব্র বর্ণবাদের উপস্থিতি পেয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এই সংগঠনটি বলেছে, এই বিনা-বিচারে কারাযাপনে বাধ্য হওয়া মানুষদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
২০১৭-১৮ সালের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রাপ্তবয়স্ক মার্কিন জনসংখ্যার প্রায় ৪.৪ শতাংশ প্রবেশন কিংবা প্যারোলে ছিল। আগস্ট মাসে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ রিপোর্ট করেছে, প্রবেশন এবং প্যারোল লঙ্ঘন করায় কারাবন্দি মানুষ বেড়েছে। কোভিডের প্রাদুর্ভাবের সময় কারাগারে থাকা ১ লাখ ৬৯ হাজার ২৮৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়।
ওই বছর নভেম্বর পর্যন্ত করোনায় কারাগারে মৃত্যু হয় ১ হাজার ৩৬২ জনের। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, কিছুসংখ্যক কারাগারে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার অভাব ছিল।
এইচআরডব্লিউ জানিয়েছে, ২০২০ সালে ৫টি মার্কিন রাজ্য মোট ৭ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছিল; ফেডারেল সরকার নভেম্বরে আরও একটি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৮।
এ বছর আগস্টের শেষ সপ্তাহে বিকল্পধারার সংবাদমাধ্যম কাউন্টার পাঞ্চের পক্ষে জন র্যাচেলকে একটি সাক্ষাৎকার দেন স্বনামধন্য মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কি।
র্যাচেল এ সময় চমস্কির কাছে জানতে চান- যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই শান্তি, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, জাতিগত সমতার মতো বিষয়গুলোতে নিজেকে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে চিত্রিত করতে চায়। তবে জনমত অনুযায়ী, বেশিরভাগ অন্য দেশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে। আপনার দৃষ্টিতে এখানে সত্যটা কী?
জবাবে নোম চমস্কি বলেন, এমনকি ওবামার শাসনামলেও আন্তর্জাতিক জরিপগুলোতে দেখা যায়, বিশ্বজনমত যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বশান্তির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে, অন্য কোনো দেশ এমনকি কাছাকাছিও ছিল না।
আমেরিকানদের কাছ থেকে এসব খবর আড়াল করে রাখা হয়, যদিও কেউ কেউ বিদেশি মিডিয়া এবং ভিন্নমতাবলম্বী উৎস থেকে এটি সম্পর্কে জানতে পারে। কালে-ভদ্রে রিপোর্টে চিত্রগুলো তুলে ধরা হয়।
চমস্কি উদাহরণ হিসেবে হাজির করেছেন কিউবার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রশ্ন। এই নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে গোটা দুনিয়া, পক্ষে কেবল যুক্তরাষ্ট্র আর ইসরায়েল। এটাকে ‘সাম্রাজ্যিক সংস্কৃতির আদর্শ’ আখ্যা দিয়েছেন চমস্কি।
সেপ্টেম্বরে ট্রুথ আউটকে দেওয়া অপর এক সাক্ষাৎকারে চমস্কি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলকে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দিয়েছে।