রাজশাহী প্রতিনিধি:
সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে চলছে রমরমা কোচিং ও প্রাইভেট বাণিজ্য। কেউ সাইনবোর্ড সরিয়ে, আবার কেউ পুরানো কৌশল পরিবর্তন করে শিক্ষকরা নতুনভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের এই শিক্ষা বাণিজ্য।
এর মধ্যে উপজেলার সরকারি স্কুল কলেজ ও এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বাসা ভাড়া নিয়ে বেনামে চালাচ্ছেন এই কোচিং বাণিজ্য। তেমন কোন অভিযান না চলায় তারা আরও বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছেন কোচিং, প্রাইভেট বাণিজ্য।
এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে সকল প্রকার কোচিং বাণিজ্য বন্ধ থাকার সরকারি নির্দেশ থাকলেও রহস্যজনক কারণে সেটা মানা হচ্ছে না। কোচিং সংশ্লিষ্ট সকলের বক্তব্য সব কিছু ম্যানেজ করে চালানো হচ্ছে কোচিং বাণিজ্য। আর উপজেলা প্রশাসনের বক্তব্য- আমরা অভিযানে গেলে তারা কোনভাবে আগাম সংবাদ পেয়ে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। সকাল ৬টা থেকে ৭টা ৫০ পর্যন্ত আর বিকালে ৪টা থেকে ৬টা পর্যন্ত চলছে কোচিং বাণিজ্য দেখার যেন কেউ নেই।
কোন কোন শিক্ষক নিজের বাড়িতে ৩০/৩৫ জোড়া বেঞ্চ তৈরি করে ৫০ থেকে ৬০ শিক্ষার্থী নিয়ে চালচ্ছে কোচিং প্রাইভেট বাণিজ্য, একদিন পর পর একেক ব্যাচকে পড়ানো হয়। ৭/৮টি ব্যাচকে পড়ানো হচ্ছে। ফলে ওই স্কুলে বিভিন্ন অজুহাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত থেকেও দেদারসে চালাচ্ছে কোচিং প্রাইভেট কোচিং বাণিজ্য।
কেউ কেউ সরকারি দলের জোরে চালাচ্ছেন কোচিং সেন্টার এবং বীরদাপটে বলছেন সারাদেশে অভিযান চললেও আমাদের কোচিং সেন্টারে কেউ অভিযান চালাতে পারবেন না, সব ম্যানেজ করা আছে।
উপজেলা আইন শৃংঙ্খলা সভায় কোচিং প্রাইভেট বাণিজ্যের বিষয়টি জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হলেও প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব অবৈধ কার্যক্রম চলায় দরিদ্র শিক্ষার্থী, অভিাবক, সচেতন মহল দারুন হতাশ। আর এসব কোচিং সেন্টারে সকাল সাড়ে ৫টা থেকে দুপুর ও বিকালে এমনকি সন্ধ্যা পর্যন্ত চলেছে শিক্ষকদের প্রাইভেট পাঠদান।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলা সদরেই রয়েছে প্রায় অর্ধশতাধিক কোচিং সেন্টার। এর মধ্যে উপজেলার পশু হাসপাতাল রোড, সততা ক্লিনিকের গা ঘেষে রাজকীয় ভবনে চলছে কোচিং সেন্টার, শহিদ ফিরোজ চত্ত্বরের বিদ্যুৎ অফিসে পাশে, গোদাগাড়ী আফজি পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আশেপাশে, সুলতানগজ্ঞ, মহিশালবাড়ীতে ১০টি স্থানে রয়েছে কোচিং ও প্রাইভেট সেন্টার।
শিবসাগর, পিরিজপুর, বিদিরপুর, প্রেমতলী, রাজাবাড়ী, বাসুদেবপুর, ফরিদপুর, কাশিমপুর, কাঁকনহাটসহ কামারপাড়া, হুজরাপুরসহ পাড়া-মহল্লায় বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকরা গড়ে তুলেছেন তাদের বাণিজ্য প্রাইভেটকেন্দ্র। গোদাগাড়ী পৌরসভা, কাঁকনহাট পৌরসভা ও উপজেলায় রয়েছে দেড় শাতাধিক কোচিং প্রাইভেট বাণিজ্য। আইন থাকলেও এর বাস্তব প্রয়োগ না থাকায় দিনে দিনে কোচিং, প্রাইভেট সেন্টার ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে উঠেছে। আর গোদাগাড়ীতে কোচিং প্রাইভেট সেন্টার গুলিতে রহস্যজনকভাবে কোন অভিযান না চলার কারণে এ সুযোগটি জামায়াত শিবির ক্যাডার তাদের দলীয় নেতাদের বাড়িকেও কোচিং সেন্টারের আড়ালে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার প্রায় সব বিদ্যালয়ের কোনো না কোনো শিক্ষক কোচিং, প্রাইভেট বাণিজ্যের সাথে জড়িত রয়েছেন। দেখা গেছে, ছোট্ট একটি ঘরে বেঞ্চে বসিয়ে ১ ঘণ্টার কোচিংয়ে ৪০ থেকে ৫৫ জন শিক্ষার্থীকে একত্রে পড়ানো হচ্ছে। এতে দায়সারা গোছের পাঠদান হলেও মূলত শিক্ষার কোনো পরিবেশ নেই।
গোদাগাড়ী পৌর সদরের শিক্ষার্থী নাইম, ইসরাইলসহ কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১ ঘণ্টা করে মাসে ১২ দিন তাদের পড়ানো হয়। তাদের কোচিং ফি বাবদ মাসে ৫’শ থেকে ১ হাজার ৯’শ টাকা করে দিতে হচ্ছে।
কোচিংয়ের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, কী করবো, কোচিংয়ে না পড়লে পরীক্ষায় পাস করবো কীভাবে? ক্লাসে তো আর সব কিছু শেখানো হয় না। আর স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় জানুয়ারী মাসের বিনামূল্যে বই দেয়া হলেও ভর্তি, পরীক্ষা নানা অজুহাতে এখনও পুরো ক্লাস শুরু হয়নি। সকাল ৯টায় ক্লাস শুরু করে দুপুরের পূর্বে তালা ঝুলানো হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে।
তাই কোচিং প্রাইভেট ছাড়া আর কি উপায় বলেন? বাবা মা খুব কষ্ট করে কোচিং প্রাইভেটের টাকা আমাদেরকে দেন যদি প্রতিষ্ঠানে সরকারি নির্দেশ মত ৬ ঘন্টা ক্লাস হত তা হলে আমাদের এত টাকা নষ্ট কওে কোচিং প্রাইভেট বাণিজ্যের সাথে যুক্ত হতে হত না। আমরাও চাই একেবারেই বন্ধ হউক।
এএম শাহিন নামের এক অভিভাবক বলেন, স্কুল কলেজ মাদ্রাসাগুলিতে ঠিকভাবে ক্লাস হয় না। বছরের শুরুতে বিনামূল্যে বই সরকার দেন, শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কিন্তু ক্লাস শুরু হয় না। বিভিন্ন অজুহাতে জানুয়ারী মাস পার করে ফেব্রুয়ারি মাসেও অনেক স্কুল কলেজে ফুল ক্লাস শুরু হয়নি।
কলেজগুলিতে শিক্ষকদের কথিত অফ ডে’র কারণে সপ্তাহের ৩/৪ দিন পালা করে শিক্ষকগণ কলেজে আসেন না। কলেজে ৯টায় ক্লাস শুরু করে দুপুরের আগে তালা ঝুলিয়ে দেন। শিক্ষক শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে যায়। কোন কোন শিক্ষক ক্লাসের ৫/১০ মিনিট পূর্বে আসেন আর ক্লাস করে চলে যান। এদের শিক্ষার্থীর অবস্থা আরও করুণ, পাবলিক পরীক্ষায় ফেল করে অনেকে।
বেশিরভাগ স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় সরকারি নির্দেশ মানা হয়না। সরকারি নির্দেশমত ৬ ঘন্টা না চালিয়ে চালানো হয় ৩/৫ ঘন্টা। আর বৃহস্পতিবারে কথিত হাফ ডে’র কথা বলে প্রতিষ্ঠান চালানো হয় ২ থেকে ৩ ঘন্টা। সিলেবাস শেষ না। বাধ্য হয়েই ছেলে মেয়েদের কোচিং, প্রাইভেট বাণিজ্যে পড়তে দিতে হচ্ছে।
এমনও শিক্ষক রয়েছে তার কাছে প্রাইভেট না পড়লে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া যায় না। কোচিংয়ে পড়ানোর বিষয়ে একাধিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তারা বিষয়টি স্বীকার করেন।
তবে অনেকেই বলেন, আমাদের আমাদের এলাকায় এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যার ২/৪ জন্য শিক্ষক প্রাইভেট কোচিং বাণিজ্যের সাথে যুক্ত নাই। কিন্তু আমরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি না। কারণ তার অনেক প্রভাবশালী, দলীয় অনেক প্রভাব। কিছু কিছু শিক্ষক তাদের বাসা বাড়িতে প্রকাশ্যে প্রাইভেট পড়িয়ে থাকেন। তাদের বাসায় লাইন দিয়ে অগ্রীম টাকা দিয়ে ছেলেমেয়েদের কোচিং প্রাইভেটে ভর্তি হয়।
এ ব্যাপারে গোদাগাড়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিমুল আকতারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমরা কোচিংবাজ শিক্ষক ও কোচিং সেন্টারে অভিযান চালালে তার লোক বসিয়ে রাখেন। আমাদের দেখে তালা লাগিয়ে পালিয়ে যায়। পুলিশ সংকটের কারণে অনেক সময় সময়মতো অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। আগামীতে কিছু আনসার রেখে অভিযান পরিচালনার চেষ্টা করবো।
তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, কোচিং প্রাইভেট বাণিজ্যের সাথে তাদের কোনভাবে ছাড় দেয়া হবে না।
২/১ কোচিং প্রাইভেট বাজ শিক্ষকদের ও কোচিং সেন্টারে যুক্তদের শাস্তির ব্যবস্থা করলে এগুলি আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যাবে, স্কুল কলেজ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতিগণ সরকারি নির্দেশমত চালাচ্ছেন কি না তা যদি প্রশাসনের লোকজন নিয়মিত তদারর্কী করেন তা হলেই শিক্ষারমান বৃদ্ধি পাবে এবং কোচিং প্রাইভেট বাণিজ্য চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে।
ভুক্তভোগী অভিভাবক, শিক্ষার্থী সচেতন মহল গোদাগাড়ীর অবৈধ কোচিং, প্রাইভেট বাণিজ্য বন্ধের জন্য শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাসচিব, প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।