সময় এখন ডেস্ক:
শুধু উদ্যম আর আকাশছোঁয়া স্বপ্ন থাকলে যে মানুষ অসাধ্যও সাধন করতে পারে, তার উদাহরণ নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার পশ্চিম লামাপাড়া এলাকার আকাশ আহমেদ। তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টায় তৈরি করেছেন বিশ্বখ্যাত বিলাসবহুল স্পোর্টস কার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ‘ল্যাম্বরগিনি’র অনুরূপ একটি গাড়ি।
নারায়ণগঞ্জের টক অব দ্যা টাউন হয়ে দাঁড়িয়েছে আকাশের এই গাড়ি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে তার গাড়ির ছবি। তবে এ কৃতিত্ব একদিনে অর্জিত হয়নি। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে দীর্ঘ ১৪ মাসের প্রচেষ্টার ফল এই ছোটখাট দেখতে দৃষ্টিনন্দন গাড়িটি।
কথা হলো আকাশের সাথে। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই গাড়ি বানানোর স্বপ্নটা ছিলো। নানারকম গাড়ির মাঝেই আমার বেড়ে ওঠা। গাড়ির যন্ত্রপাতি ছিলো আমার খেলার জিনিস। বাবা অন্যের গ্যারেজে চাকরি করতেন। দাদাও গাড়ি মেরামতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বাবা-দাদাকে দেখতাম ভাঙা গাড়ি মেরামত করছেন, আবার কখনো বা কারও গাড়ির পার্টস বানিয়ে লাগিয়ে দিতো। তখন থেকেই আমি স্বপ্ন দেখেছি একদিন নিজের একটা গাড়ি হবে।
আকাশ আরও বলেন, গ্যারেজে বা রাস্তায় নতুন মডেলের কোনো গাড়ি দেখলেই ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠতো। কিন্তু বাবাকে বলার সাহস পেতাম না। গাড়ির স্বপ্ন পূরণের সামর্থ্য নেই আমার পরিবারের। আর তাই একদিন নিজেই একটা গাড়ি বানাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। নিজের বানানো গাড়িতে করেই দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়াবো।
এটা শুধু স্বপ্নেই থেমে গেলো না। আকাশ জানালেন তারপরের গল্পটা।
তরুণ স্বপ্নচারী বলেন, আমার ঘরের ক্যালেন্ডারে পর্যন্ত গাড়ির ছবি। ক্যালেন্ডারের পাতায়ই ইতালির বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ‘ল্যাম্বরগিনি’র একটা গাড়ির মডেল দেখে চোখ আটকে যায়। তখনই মনে হয় গাড়ি যদি বানাই তবে এই মডেলেই বানাবো। বাবাকে বলে কাজে থেকে লেগে পড়ি। শুরুতে অনেকেই উপহাস করতো। মানুষের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য কম সহ্য করতে হয়নি। কিন্তু সেসবে পাত্তা না করে নিজের কাজ করে যেতে থাকি। সাথে পরিবারেরও সমর্থন ছিল। অর্থের যোগান, মানসিকভাবে সাহস জুগিয়েছেন তারা।
আকাশের কাছে জানতে চাওয়া হলো, অর্থ জোগাড়ের বিষয়ে। তিনি জানান, বাবার কাছ থেকে প্রতিদিন হাত খরচের ১শ/২শ করে টাকা নিয়ে অল্প অল্প করে কাজ শুরু করি। অভিজ্ঞতা না থাকায় প্রথম দিকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। একবার কোনো দিকে একটু ভুল হয়ে গেলে আবার নতুন করে শুরু করতে হতো।
আকাশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বলতে কেবল মাদ্রাসায় ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত। আর ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা বলতে কেবল গ্যারেজে গাড়ির পার্টস তৈরি আর জাহাজের ভারী ভারী ইস্পাতের পাত কাটার অভিজ্ঞতাটা। আর নতুন কিছু শেখার একমাত্র উৎস ছিল ইউটিউবের ভিডিও টিউটোরিয়াল।
আকাশ বলেন, জাহাজের ইস্পাতের পাত কাটার অভিজ্ঞতা থাকার সেটা কাজে লাগালাম। ইস্পাতের পাত কেটে কেটে গাড়ির বডি শেপ তৈরি করি। টিউটোরিয়াল দেখে দেখে চাকার সাসপেনশন, হেডলাইট, ব্যাকলাইট, গিয়ার নিজেই বানিয়ে ফেলি। চাকা আর স্টিয়ারিং হুইলটাই কেবলমাত্র কিনে আনতে হয়েছে।
সম্পূর্ণ দেশীয় ও পরিবেশবান্ধব এই গাড়িটির জ্বালানি শক্তির যোগান দেয় ব্যাটারি। এতে ব্যবহার করা হয়েছে ৫টি ব্যাটারি। যা প্রায় টানা ১০ ঘণ্টা চলতে সক্ষম। এটি পুরোপুরি চার্জ হতে লাগবে ৫ ঘণ্টা। সর্বোচ্চ ২ জন আরোহীকে নিয়ে ঘণ্টায় ৪৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বেগে ছুটতে পারে আকাশের ল্যাম্বরগিনি।
গাড়িটি তৈরীর পেছনে তার খরচ হয়েছে ৩ লাখ টাকা। তবে গাড়ির বডি কার্বন ফাইবারে নিয়ে আসলে আরও কম খরচে বানানো সম্ভব। গাড়িটির আরও কিছু কাজ বাকি আছে বলে জানান আকাশ। সুইচের মাধ্যমেই যাতে দরজা বন্ধ এবং খোলা যায় সে ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছেন আকাশ। তবে শুধু নিজের জন্যই নয়, দেশের মানুষের জন্য এমন আরও অনেক গাড়ি বানাতে চান আকাশ।
এই তরুণ উদ্ভাবক জানালেন, গাড়িটি বানানোর পর বেশ সাড়া পেয়েছি। দেশীয় প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় এরইমধ্যে আরও প্রায় ২৫টি গাড়ির অর্ডার পেয়েছি।
এই গাড়ি বাজারজাতকরণের অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন। কারণ অন্য কারও কাছে তিনি এই গাড়ির নক্সা বিক্রি করতে চান না।