ফিচার ডেস্ক:
আনা ফ্রাঙ্ক। ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাত্র ১৫ বছর বয়সে এক নাৎসি বন্দিশিবিরে মারা যাওয়া ইহুদি কিশোরী। তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত একটি ডায়েরি সারা বিশ্বজুড়ে ব্যাপক আলোচিত হয়।
কিন্তু মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি কীভাবে বন্দি শিবিরে মারা গেলেন এবং তার পরিবারের নাৎসি বাহিনীর কাছে ধরা পড়ার পেছনে কী কারণ ছিলো- সেই রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-এর সাবেক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে ইতিহাসবিদ ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি তদন্ত দল।
মৃত্যুর ৬ মাস আগে নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডামের একটি গোপন জায়গা থেকে আনা ফ্রাঙ্ক ও তার পরিবারের সদস্যদের আটক করে নাৎসি বাহিনী। বিশ্বযুদ্ধের ৭৭ বছর গড়িয়েছে। কিশোরী আনাকে ধরিয়ে দেওয়ার পেছনে ‘মূল হোতা’ কে ছিল, তা বেরিয়ে এসেছে নতুন এক তদন্তের মধ্য দিয়ে।
যদিও তা গত ৭৭ বছর ধরেই ছিলো মানুষের কাছে অজানা আর রহস্যে ঘেরা। অত্যাধুনিক নানা কৌশল ব্যবহার করে বহু বছরের অমীমাংসিত প্রশ্নের জবাব খুঁজতে পার হয়েছে ৬টি বছর।
এফবিআই-এর সাবেক কর্মকর্তা ভিন্স প্যানকোকে তদন্ত শেষে আর্নল্ড ভ্যান ডেন বার্গ নামের আমস্টারডামের এক ইহুদি ব্যক্তির নাম প্রকাশ করেছেন। নানা সূত্র মিলিয়ে তিনি বলছেন, নাৎসিদের হাত থেকে নিজের পরিবারকে বাঁচাতেই হয়তো আনা ও তার পরিবারকে ধরিয়ে দিয়েছিলেন ভ্যান ডেন বার্গ।
ভ্যান ডেন বার্গ সে সময় আমস্টারডামের ইহুদি কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। ইহুদি অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় নাৎসি নীতি বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করা হয়েছিল এ কাউন্সিলকে। পরে ১৯৪৩ সালে কাউন্সিলটি বিলুপ্ত করা হয়, এর সদস্যদের পাঠানো হয় নাৎসিদের নানা বন্দিশিবিরে।
তবে ভ্যান ডেন বার্গ ছিলেন ব্যতিক্রম। তদন্তে দেখা গেছে, তাকে বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়নি। আর দশজনের মতোই আমস্টারডামে স্বাভাবিক জীবন কাটাচ্ছিলেন তিনি।
কেন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন ভ্যান ডেন বার্গ— টেলিভিশন চ্যানেল সিবিএস-এর ‘সিক্সটি মিনিটস’ অনুষ্ঠানে এফবিআই-এর সাবেক ওই কর্মকর্তা এ নিয়ে কথা বলেছেন।
ভিন্স প্যানকোকে বলেন, বন্দিশিবিরে যাওয়া এড়াতে ভ্যান ডেন বার্গের সব সুরক্ষা হাতছাড়া হয়ে যায়। নিজের ও স্ত্রীর নিরাপত্তার জন্যই এমনটি করেছিলেন তিনি।
তদন্তকারী দলটি বলছে, এক ইহুদির সঙ্গে আরেক ইহুদি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে— বিষয়টি মানতে কষ্ট হয়েছিল তাদের। কারণ, ইহুদি সমাজে এমনটি একেবারেই বিরল।
তদন্তে এ-ও উঠে এসেছে, আনার বাবা ওটো ফ্রাঙ্ক বিশ্বাসঘাতকের সম্পর্কে জানতেন। তবে চেপে গিয়েছিলেন তিনি। বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে এ নিয়ে আগের তদন্তকারীদের নথিপত্রে। সেখানে দেখা যায়, ওটো ফ্রাঙ্কের কাছে পরিচয়হীন একটি চিরকুট এসেছিল। ভ্যান ডেন বার্গই যে বিশ্বাসঘাতক, তা জানিয়ে দিতেই ওই চিরকুট পাঠানো হয়।
ওটো ফ্রাঙ্ক বিশ্বাসঘাতকের নাম সামনে আনেননি কেন? এফবিআই-এর সাবেক ওই কর্মকর্তার মতে, এর পেছনের কারণ হতে পারে ইহুদিবিদ্বেষ। ওটো ফ্রাঙ্ক হয়তো ভেবেছিলেন, বিশ্বাসঘাতকের নাম প্রকাশ করলে তা শুধু আগুনে ঘিই ঢালবে।
তদন্তকারী ভিন্স প্যানকোকে এটাও বলেন, আমাদের এটা মনে রাখতে হবে ভ্যান ডেন বার্গ ইহুদি ছিলেন। এর অর্থ নাৎসিরা তাকে এমন কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলেছিল যে, জীবন বাঁচানোর জন্য কোনো কিছু একটা করতেই হতো।
এদিকে এর কয়েক বছর পর ১৯৫০ সালে ভ্যান ডেন বার্গের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডি ভোকসক্রান্ট।
আরেক বিবৃতিতে আনা ফ্রাঙ্ক হাউজ মিউজিয়াম জানিয়েছে, তদন্তকারী দলের কাজে তারা অভিভূত।
মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, তারা তদন্তের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। তবে দলটিকে নানা নথি ও মিউজিয়াম ব্যবহার করতে দিয়ে সহায়তা করেছেন।
১৯৪৪ সালের ৪ আগস্ট গ্রেপ্তার হন আনা ফ্রাঙ্ক ও তার পরিবার। আনাকে পাঠানো হয় ওয়েস্টারবর্কের শিবিরে। এরপর তাঁকে নেওয়া হয় জার্মানিতে নাৎসি বাহিনীর বার্গেন-বেলসেন শিবিরে। সেখানে ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আনা।
মেয়ের মৃত্যুর পর বাবা ওটো ফ্রাঙ্ক আনার হৃদয়স্পর্শী একটি ডায়েরি পান। প্রথম সেটি বই হিসেবে প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালের ২৫ জুন। বিশ্বজুড়ে ডায়েরিটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। ডায়েরিটি ২০০৯ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ রেজিস্ট্রারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।