সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও শিক্ষামন্ত্রীর নাম জড়ানোর উদ্দেশ্য কী?

0

বিশেষ প্রতিবেদন:

চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) জন্য জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ। সম্প্রতি ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক প্রতিবেদনে তিনি দাবি করেছেন, ‘ওই প্রক্রিয়ায় সরকারের প্রায় ৩৬০ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে।’

এ নিয়ে বেশ আলোচনা তৈরি হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন অনেকে। কয়েকটি চিহ্নিত পত্রিকায় এ সংক্রান্ত খবর বেরিয়েছে। যদিও খবরের চেয়ে শিরোনামগুলো বেশ উল্লেখযোগ্য। জেলা প্রশাসক তার প্রতিবেদনে কারও নাম উল্লেখ না করলেও পত্রিকাগুলোতে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির নাম চলে আসছে শিরোনামে। শিক্ষামন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য প্রমাণ না থাকলে রসিয়ে রসিয়ে শিরোনাম দেওয়া হচ্ছে। যাকে ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেশন (চরিত্রহনন) বলা চলে।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর ‘চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১৯’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। সংসদে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে বিল পাস হয় ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। ১৫ সেপ্টেম্বর সরকারি গেজেটের মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু। ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি থেকে চাঁবিপ্রবির উপাচার্য হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব পান অধ্যাপক ড. মো. নাছিম আখতার।

ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চাঁদপুর জেলা শহর থেকে ৪ কিলোমিটার দক্ষিণে চাঁদপুর–হাইমচর উপজেলা সড়কের ঠিক পূর্বপাশে সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে ৬০ একর জায়গা অধিগ্রহণের কাজ চলমান। মূলত এই কাজেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লবিস্ট নিয়োগের খবর ফাঁস হওয়ার পর নিজেদের কুকীর্তি ঢেকে মিথ্যাচার করতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, চাঁবিপ্রবির ভূমি অধিগ্রহণে শিক্ষামন্ত্রীর দুর্নীতির যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাতে বিএনপির পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে।

বিএনপি নেতা ‘শিক্ষামন্ত্রীর দুর্নীতি’ শব্দবন্ধটি জেনেশুনে অপপ্রচারের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করেছেন সেদিন। যার ভিত্তি হলো ভিত্তিহীন হলুদ পত্রিকাগুলোর শিরোনাম। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীসভার অত্যন্ত সজ্জন এবং ক্লিন ইমেজের অধিকারী এই মন্ত্রীর সুনাম হানির উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ শ্রেণি কোমর বেঁধে নেমেছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই বিশেষ চিহ্নিত গোষ্ঠী যেভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ ছাড়ের আগেই কাল্পনিক দুর্নীতির গন্ধ পেয়ে গিয়েছিল, আর সেই গন্ধের ওপর ভিত্তি করে বায়বীয় প্রতিবেদন তৈরি করে সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রীর জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল, দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করেছিল, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করেছিল, আবারও একই মিশনে নেমেছে।

যার নাম জড়িয়ে এত গালগল্প আর অভিযোগের তির, এসব বিষয়ে তার কাছে জানতে চাওয়া হয়। জবাবে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, আমার বড় ভাই (জে আর ওয়াদুদ টিপু) একজন চিকিৎসক। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অল্প অল্প করে জমি কিনেছিলেন, হাসপাতাল ও বৃদ্ধাশ্রম করার জন্য। যখন ওই জমিটা আমরা চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) জন্য পছন্দ করি, অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরুর পর আমার ভাই তার জমি বিক্রি/হস্তান্তর করেছেন।

এর বাইরে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) জন্য যে জমি চিহ্নিত আছে, সেখানে আমার বা আমার পরিবারের কারও কোনো জমি নেই। গত ১৩ বছরে আমার নির্বাচনী এলাকায় অনেক অবকাঠামো হয়েছে, হচ্ছে। আজ পর্যন্ত অধিগ্রহণকৃত জায়গায় আমার বা আমার পরিবারের কারও এক ছটাক জমিও ছিল না। বাস্তবিক অর্থে চাঁদপুরে আমার কোনো জমিই নেই।

যাদের জমি আছে বলে নাম এসেছে- জাহিদুল ইসলাম রোমান ও সেলিম খান; তাদের বিষয়ে ডা. দীপু মনি বলেন, ওখানে আমার পরিবার বলতে আমার একমাত্র ভাই। তবে জাহিদুল ইসলাম রোমান আমার জ্ঞাতি হিসেবে আত্মীয়। জাহিদুল ইসলাম রোমানের নানা এবং আমার দাদা, তারাও ডিস্টেন্ট (দূর সম্পর্কীয়) কাজিন। সেই অর্থে তিনি আমার ভাই।

তার থেকে অনেক বড় সম্পর্ক হলো— রাজনৈতিকভাবে আমরা ঘনিষ্ঠ। আমার রাজনৈতিক পরিবার অনেক বড়। চাঁদপুরে আমার রাজনৈতিক পরিবারের মানুষের সংখ্যা লাখেরও বেশি। সেলিম খান অধিগ্রহণকৃত এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনিসহ প্রতিটি ইউনিয়ন চেয়ারম্যানই আমার ঘনিষ্ঠ, এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই হওয়া উচিত।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, যখনই অধিগ্রহণ হয়, সেখানে জমি কেনার একটা প্রবণতা থাকে। কিংবা যাদের জমি আছে, স্থাপনা বানিয়ে ফেলে। এই অনুশীলন বাংলাদেশের সর্বত্র আছে। আমার ওখানেও (চাঁদপুর) সেটা ঘটে থাকতে পারে। সেটা আমি জানি না। কে আমার সঙ্গে রাজনীতি করেন বা করেন না, কে জমি কিনেছেন? ওটা আমার দেখার বিষয় নয়। ওটা দেখার সময়ও নেই আমার। রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ বা আত্মীয়-অনাত্মীয় কেউ জমি কিনলেও আমার কিছু বলার নেই।

তিনি বলেন, ওই জায়গায় যে অধিগ্রহণ করা হচ্ছে, সেটা আইনসম্মতভাবে অধিগ্রহণ বা প্রাক্কলন হয়েছে কি না, এটা ভূমি মন্ত্রণালয় দেখবে। এটা তাদের কাজ। বা সরকারের অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ থাকলে তারা দেখবে। সেই জায়গায় যদি জমির মূল্য সঠিক না হয়, তাহলে সে ব্যাপারে যা ব্যবস্থা নেওয়ার সেটাও সরকারই নেবে। সেখানেও আমার কোনো বিষয় নেই।

আমার যেটা দেখার দরকার, আমার এলাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করার কথা, সেটি যথাসময়ে স্থাপিত হবে। এটা যেন ভূমি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা বা তৈরি করা কোনো সমস্যা দিয়ে ঝুলে না যায়, বিলম্বিত না হয়।

ডা. দীপু মনি অভিযোগ করে বলেন, এর আগে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের জায়গার অধিগ্রহণ নিয়ে এই রকম একটা মহল প্রশ্ন তুলেছে। যখনই কোনো বড় উন্নয়নমূলক কাজের কথা হয়, তখনই এই জমি ভেঙে যাবে, এটা নষ্ট হবে, এরকম নানান কিছু বলা হয়। এই বলে মেডিকেল কলেজের জমি অধিগ্রহণের কাজটাও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

হাইমচরে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। সেটার জমি অধিগ্রহণ কাজও হচ্ছে ধীরে। কারণ একটা মহল কিছুতেই চাইছে না— ওখানে (চাঁদপুর-৩) আমার মাধ্যমে এই বড় বড় কাজ হোক। সব জায়গায়ই রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ থাকে। আমার ওখানেও হয়তো কম-বেশি কিছু আছে। সেটা একটা ভিন্ন দিক।

আমার মত একটাই, যে মূল্য যথাযথ হয়; সে মূল্যেই সরকার আইন অনুযায়ী অধিগ্রহণ করবে। কোনো বিলম্ব ছাড়াই যেন আমার বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। যারা আমার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আপত্তি তুলছেন, তারা যেন সফল না হন। কারণ তারা চাঁদপুরের উন্নয়ন চান না, বললেন শিক্ষামন্ত্রী।

মন্ত্রীর দাবি, যে অপপ্রচারটা চলছে, এটা ভাঙণপ্রবণ এলাকা, এখানে বিশ্ববিদ্যালয় করা যাবে না; সেটা সঠিক নয়। দেখে-শুনেই সেই জায়গায় করা হচ্ছে। অনেকগুলো দিক বিবেচনা করে এই জায়গা ঠিক করা হয়েছে। শহরের মধ্যে নয়, মহাসড়কের পাশে নয়, অনেকগুলো জেলার সঙ্গে যাতায়াত সুবিধা আছে— এরকম একটা জায়গা এটি।

এটি নদীর পাড়ে বা নদীর কাছের জায়গা। তবে ওখানে বেড়িবাঁধও আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডও মত দিয়েছে যে, জায়গাটিতে এই স্থাপনা করা যায়।

মন্ত্রীর বক্তব্যের পর এ বিষয়ে মতামত জানতে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশের মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তার সাড়া মেলেনি। সাংবাদিক পরিচয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠালেও মেলেনি জবাব।

এছাড়াও গত কিছুদিন আগে এ বিষয়ে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদকে একটি সমাবেশে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনিও সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে দেন, কেউ যদি জমির মূল্য নিয়ে কারসাজি করার চেষ্টা করে, তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। ভূমি মন্ত্রণালয় কোনো অপকর্ম বরদাশত করবে না বলে তিনি জানিয়ে দেন।

দুর্নীতি দূর করে সুষ্ঠু নাগরিক সেবা প্রদানের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক জনসেবা পদকপ্রাপ্ত ভূমি মন্ত্রণালয় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশ্বস্ত করেছেন যেখানে, যেখানে খোদ শিক্ষামন্ত্রী নিজের অবস্থান ব্যক্ত করেছেন, সেখানে বিশেষ মহল যে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার উদ্দেশ্যেই গুজব, অপপ্রচার আর চটকদার শিরোনামে হলুদ সংবাদ তৈরির উদ্দেশ্য পরিস্কার।

যেসময় দেশ উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের একটি উজ্জ্বল ভাবমূর্তি বিরাজমান, সেসময় বাংলাদেশকে নিয়ে চলছে বিভিন্নমুখী ষড়যন্ত্র। বিএনপি-জামায়াত আমলে মন্ত্রীদের বিভিন্ন দুর্নীতির খবর আসত, দেশ পরপর পাঁচ বার দুর্নীতি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন পর্যন্ত হয়েছিল। আর বর্তমান সকারের মন্ত্রীদের প্রায় সবারই রয়েছে সুনাম, জনবান্ধব এবং প্রতিশ্রুতিশীল হিসেবে পরিচিত, সেসময় সরকারকে বিতর্কিত করার অভিপ্রায়ে এমন রঙ চড়ানো সংবাদ পরিবেশন অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

বাংলাদেশকে অকার্যকর এবং বিতর্কিত করে তুলতে পারলে, বিশ্বজুড়ে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ণ করতে পারলে প্রকৃত অর্থে কাদের জন্য লাভজনক, সেটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়ার প্রয়োজন নেই।

শেয়ার করুন !
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!