স্পেশাল করেসপন্ডেন্স:
চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) জমি অধিগ্রহণ নিয়ে এখন সারা দেশে তোলপাড় চলছে। চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ ভূমি অধিদপ্তরে এক অভিযোগ করেছেন। সেই অভিযোগে তিনি বলেছেন, ৬২.৫ একর জমি মৌজা দরের ২০ গুণ ধরে দলিল করা হয়েছে।
প্রকৃত মৌজা দরে জমি অধিগ্রহণ করলে তার ব্যয় হবে ১৯৪ কোটি টাকা। উচ্চমূল্য দেখানোয় দর দাঁড়ায় ৫৫৩ কোটি টাকা। এরপর বিভিন্ন মহল থেকে এ নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ইতিমধ্যে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, চাঁবিপ্রবি জমি অধিগ্রহণ থেকে আমার পরিবারের সদস্যদের আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার কোন সুযোগ নাই। জমি অধিগ্রহণে পরিবারকে জড়িয়ে দুর্নীতির অভিযোগ অসত্য, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। এ নিয়ে এখন রাজনীতি অঙ্গনে এখন নানামুখী আলোচনা চলছে।
প্রশ্ন হলো, হঠাৎ করে কেন ডা. দীপু মনিকে টার্গেট করা হয়েছে। এই প্রশ্ন উঠেছে এই কারণে, এখন পর্যন্ত চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ভূমি মন্ত্রণালয় যে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে সেই প্রতিবেদনেই অসঙ্গতি এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিছু বিষয় পাওয়া গিয়েছে। যেমন-
প্রথমত, ভূমির মূল্য নির্ধারণ করে জেলা প্রশাসন। কাজেই ভূমির মূল্য কমবেশি ইত্যাদি নির্ধারণ করবে জেলা প্রশাসক। যেমন- ঢাকার গুলশানের কথাই ধরা যাক। সেখানে প্রকৃত ভূমির দাম আর সরকার নির্ধারিত ভূমির দামের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক।
এখন সরকার কি যে দামে জমি কেনাবেচা হয় সেই দামে জমি কিনবে নাকি সরকার নির্ধারিত যে মূল্য রয়েছে গুলশানের জন্য সেই দামে কিনবে? কাজেই, প্রথম যে অভিযোগটি করা হয়েছে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে, সেটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং কাউকে প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করার একটি প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
দ্বিতীয়ত, বলা হয়েছে, ৬২.৫ একর মৌজা দরের ২০ গুণ দামে দলিল করা হয়। আবার দেখানো হয়েছে, প্রকৃত মৌজার দরে অধিগ্রহণের ব্যয় ১৯৪ কোটি টাকা। আর উচ্চমূল্য দেখানো হয় এটার ব্যয় হবে ৫৫৩ কোটি টাকার। প্রশ্ন উঠছে, ১৯৪ কোটি টাকার ২০ গুণ কি ৫৫৩ কোটি টাকা? তাহলে তো অংকের নতুন হিসেব-নিকেশ করতে হবে।
পুরো ঘটনাটার মধ্যে কোথাও নেই, ডা. দীপু মনি কোথাও জমি কিনেছেন। তার ভাই জমি কিনেছেন বা তার আত্মীয় বা তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা জমি কিনেছেন। তাহলে তার ভাই বা রাজনৈতিক সহকর্মীদের জমি কেনার দায় ডা. দীপু মনিকে বহন করতে হবে?
একটি বিষয় অস্পষ্ট, দেখা গেছে যে ডা. দীপু মনির ভাই যে জমি কিনেছেন, তা কেনা হয়েছে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় জমি নির্ধারণের বহু আগেই। তিনি সেখানে একটি হাসপাতাল ও বৃদ্ধাশ্রম করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন অনেক বছর আগেই। কাজেই, তিনি জেনে-শুনে এখানে জমি অধিগ্রহণ করেছে এমনটিও ধোপে টেকে না।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আমার বড় ভাই একজন চিকিৎসক। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অল্প অল্প করে জমি কিনেছিলেন, হাসপাতাল ও বৃদ্ধাশ্রম করার জন্য। যখন ওই জমিটা আমরা চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) জন্য পছন্দ করি, অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরুর পর আমার ভাই তার জমি বিক্রি/হস্তান্তর করেছেন।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, আমার বড় ভাই (জে আর ওয়াদুদ টিপু) একজন চিকিৎসক। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি অল্প অল্প করে জমি কিনেছিলেন, হাসপাতাল ও বৃদ্ধাশ্রম করার জন্য। যখন ওই জমিটা আমরা চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) জন্য পছন্দ করি, অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরুর পর আমার ভাই তার জমি বিক্রি/হস্তান্তর করেছেন।
এর বাইরে চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চাঁবিপ্রবি) জন্য যে জমি চিহ্নিত আছে, সেখানে আমার বা আমার পরিবারের কারও কোনো জমি নেই। গত ১৩ বছরে আমার নির্বাচনী এলাকায় অনেক অবকাঠামো হয়েছে, হচ্ছে। আজ পর্যন্ত অধিগ্রহণকৃত জায়গায় আমার বা আমার পরিবারের কারও এক ছটাক জমিও ছিল না। বাস্তবিক অর্থে চাঁদপুরে আমার কোনো জমিই নেই।
যাদের জমি আছে বলে নাম এসেছে- জাহিদুল ইসলাম রোমান ও সেলিম খান; তাদের বিষয়ে ডা. দীপু মনি বলেন, ওখানে আমার পরিবার বলতে আমার একমাত্র ভাই। তবে জাহিদুল ইসলাম রোমান আমার জ্ঞাতি হিসেবে আত্মীয়। জাহিদুল ইসলাম রোমানের নানা এবং আমার দাদা, তারাও ডিস্টেন্ট (দূর সম্পর্কীয়) কাজিন। সেই অর্থে তিনি আমার ভাই।
তার থেকে অনেক বড় সম্পর্ক হলো— রাজনৈতিকভাবে আমরা ঘনিষ্ঠ। আমার রাজনৈতিক পরিবার অনেক বড়। চাঁদপুরে আমার রাজনৈতিক পরিবারের মানুষের সংখ্যা লাখেরও বেশি। সেলিম খান অধিগ্রহণকৃত এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনিসহ প্রতিটি ইউনিয়ন চেয়ারম্যানই আমার ঘনিষ্ঠ, এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই হওয়া উচিত।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, যখনই অধিগ্রহণ হয়, সেখানে জমি কেনার একটা প্রবণতা থাকে। কিংবা যাদের জমি আছে, স্থাপনা বানিয়ে ফেলে। এই অনুশীলন বাংলাদেশের সর্বত্র আছে। আমার ওখানেও (চাঁদপুর) সেটা ঘটে থাকতে পারে। সেটা আমি জানি না। কে আমার সঙ্গে রাজনীতি করেন বা করেন না, কে জমি কিনেছেন? ওটা আমার দেখার বিষয় নয়। ওটা দেখার সময়ও নেই আমার। রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠ বা আত্মীয়-অনাত্মীয় কেউ জমি কিনলেও আমার কিছু বলার নেই।
তিনি বলেন, ওই জায়গায় যে অধিগ্রহণ করা হচ্ছে, সেটা আইনসম্মতভাবে অধিগ্রহণ বা প্রাক্কলন হয়েছে কি না, এটা ভূমি মন্ত্রণালয় দেখবে। এটা তাদের কাজ। বা সরকারের অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ থাকলে তারা দেখবে। সেই জায়গায় যদি জমির মূল্য সঠিক না হয়, তাহলে সে ব্যাপারে যা ব্যবস্থা নেওয়ার সেটাও সরকারই নেবে। সেখানেও আমার কোনো বিষয় নেই।
আমার যেটা দেখার দরকার, আমার এলাকায় যে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থাপন করার কথা, সেটি যথাসময়ে স্থাপিত হবে। এটা যেন ভূমি সংক্রান্ত কোনো সমস্যা বা তৈরি করা কোনো সমস্যা দিয়ে ঝুলে না যায়, বিলম্বিত না হয়।
ডা. দীপু মনি অভিযোগ করে বলেন, এর আগে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের জায়গার অধিগ্রহণ নিয়ে এই রকম একটা মহল প্রশ্ন তুলেছে। যখনই কোনো বড় উন্নয়নমূলক কাজের কথা হয়, তখনই এই জমি ভেঙে যাবে, এটা নষ্ট হবে, এরকম নানান কিছু বলা হয়। এই বলে মেডিকেল কলেজের জমি অধিগ্রহণের কাজটাও দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লবিস্ট নিয়োগের খবর ফাঁস হওয়ার পর নিজেদের কুকীর্তি ঢেকে মিথ্যাচার করতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, চাঁবিপ্রবির ভূমি অধিগ্রহণে শিক্ষামন্ত্রীর দুর্নীতির যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাতে বিএনপির পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে।
বিএনপি নেতা ‘শিক্ষামন্ত্রীর দুর্নীতি’ শব্দবন্ধটি জেনেশুনে অপপ্রচারের উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করেছেন সেদিন। যার ভিত্তি হলো ভিত্তিহীন হলুদ পত্রিকাগুলোর শিরোনাম। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীসভার অত্যন্ত সজ্জন এবং ক্লিন ইমেজের অধিকারী এই মন্ত্রীর সুনাম হানির উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ শ্রেণি কোমর বেঁধে নেমেছেন বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই বিশেষ চিহ্নিত গোষ্ঠী যেভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থ ছাড়ের আগেই কাল্পনিক দুর্নীতির গন্ধ পেয়ে গিয়েছিল, আর সেই গন্ধের ওপর ভিত্তি করে তৈরি বায়বীয় প্রতিবেদনে সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রীর জীবন দুর্বিষহ করে পড়ে, দেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করেছিল, আবারও একই মিশনে নেমেছে।
তার মানে পুরো বিষয়টিতে একটি নাটক সাজানো হয়েছে, যে নাটকে ডা. দীপু মনির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা যায়।
তাছাড়া ডা. দীপু মনি দুই দফায় প্রায় ৮ বছর মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন, তার বিরুদ্ধে কখনই কোনো অনিয়মের অভিযোগ আসেনি। তাই তাকে কোনো সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য টার্গেট করা হয়েছে কি না এটি খতিয়ে দেখা দরকার।