সময় এখন ডেস্ক:
যশোরে মেয়েদের একটি মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রীদের ড্রেস কোড হিসেবে হিজাবকে বেছে নেয়ায় সব ধর্মের শিক্ষার্থীরা তা পরতে বাধ্য হচ্ছেন।
ছাত্রীদের ভর্তির সময়েই এ বিষয়ে লিখিত ‘সম্মতি’ নিচ্ছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে কলেজটির একজন চিকিৎসক দাবি করেন, তারা একে হিজাব বলেন না। এটাকে প্রতিষ্ঠানের ‘ড্রেস কোড’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ভারতের কর্ণাটকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করার পর এক নারী শিক্ষার্থীর প্রতিবাদ ভাইরাল হওয়ার পর বাংলাদেশের ওই মেডিক্যাল কলেজে ধর্মীয় পোশাক বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে।
যশোরের পুলের হাটে আদ্-দ্বীন ফাউন্ডেশনের পরিচালনায় কার্যক্রম চালানো আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিক্যাল কলেজের হিন্দু ধর্মাবলম্বী এক ছাত্রী জানান, তাদেরও হিজাব পরেই ক্যাম্পাসে যেতে হয়।
কারণ কী- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভর্তির সময় স্বাক্ষর করে নেয়া হয়েছিল যেন ড্রেস কোড মেনে চলি। এ জন্য চাইলেও আমাদের প্রতিবাদ করার সুযোগ নেই।’
আরেক ছাত্রী জানান, ২০২০ সালে তাদের এক সহপাঠীর একটি আপত্তিকর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়। পরে মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ সেই ছাত্রীর পাশে না দাঁড়িয়ে তার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেয়। এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয় তাকে।
অন্য এক ছাত্রী বলেন, ‘আসলে আমাদের কিছু বলার সুযোগ নেই। ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়। তাই আমরা কোনো ধরনের প্রতিবাদ করি না। বাবা-মা টাকা খরচ করে এখানে ভর্তি করে। ফলে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয় আমাদের।’
মেডিক্যাল কলেজটি বলছে, এটি তাদের প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত। সবাই এটি মেনে নিয়েই সেখানে পড়াশোনা করছে। তবে এমন সিদ্ধান্ত কোনো প্রতিষ্ঠান নিতে পারবে না বলে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে।
২০১০ সালের ৪ অক্টোবর হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছে, বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে কোনো ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যাবে না।
তবে উচ্চ আদালতের এই রায়ের পরের বছর যাত্রা শুরু করা যশোরের আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিক্যাল কলেজে এই আদেশের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে।
সেখানে মুসলিম মেয়েদের পাশাপাশি অমুসলিম শিক্ষার্থীদেরও হিজাব পরতে বাধ্য হতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানের একাধিক শিক্ষার্থী।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুব্রত বসাকও এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘২০১১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই নিয়ম চালু রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের কারণে।’
হাইকোর্টের রায়ের পরও এ ধরনের আদেশ কীভাবে জারি করা হয়- জানতে চাইলে তিনি কোনো জবাব না দিয়ে কলেজ অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
তবে কলেজের অধ্যক্ষ গোলাম মুক্তাদিরকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আকিজ গ্রুপের চেয়ারম্যান শেখ নাসির উদ্দিনও ফোন ধরেননি।
পরে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির জন্য দেয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে চিকিৎসক সালাহউদ্দিন খান বলেন, ‘এটা কলেজের ড্রেস কোড। এটাকে হিজাব বলা ঠিক হবে না। অন্য ধর্মের সবাই এই ড্রেস কোড মেনেই ক্লাস করছে। কেউ আপত্তি করেনি।’
ড্রেস কোড হিসেবে যে পোশাক বেছে নেয়া হয়েছে, উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী যেটি পরা যায় না- এমন বিষয় স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘এটা আপনারা ভুল করছেন। এটাকে আমরা ড্রেস কোড বলছি। হিজাব নয়।’
২০১০ সালের ২২ আগস্ট দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় ‘নাটোরের সরকারি রানী ভবানী মহিলা কলেজ, বোরকা না পরলে আসতে মানা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
এরপর সুপ্রিম কোর্টের দুই আইনজীবী মাহবুব শাফি ও কে এম হাফিজুল আলম স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালতে জনস্বার্থে রিট আবেদন করেন।
বিষয়টি নিয়ে শুনানি শেষে আদালত বলে, ‘ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কোনো ব্যক্তিকে কোনো ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যায় না। সব মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। কোনো ধর্মীয় পোশাক কারও ওপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না।’
রায়ে আরও বলা হয়, ‘একই কারণে কাউকে কোনো ধর্মীয় পোশাক পরতে নিষেধও করা যাবে না। প্রতিটি মানুষের অধিকার রয়েছে শালীনতা বজায় রেখে তার পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরিধানের।’
আদ্-দ্বীন সকিনা মেডিক্যাল কলেজে হিজাব বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. এ কে এম আহসান হাবীব বলেন, ‘বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর, আমাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি।
‘আপনাদের মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখব এবং এ ধরনের অভিযোগ পেলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ নিউজবাংলা।