প্রবাস ডেস্ক:
প্রবাস জীবনটা বড়ই কষ্টের জীবন। মাঝে মধ্যেই আলো আঁধারের বিষণ্ন এক ছায়া আর চাপধরা এক কঠিন নীরবতার হাহাকার গ্রাস করে নেয় প্রবাসীদের। অসহনীয় এক শূন্য একাকীত্ব মাঝরাতেও প্রবাসীকে জাগিয়ে রাখে। দেশে আত্মীয়-স্বজন রেখে প্রবাসে যিনি থাকেন শুধুমাত্র তিনিই বিষয়টি বুঝতে পারেন।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে এক প্রবাসীর জীবনের চাপা কষ্ট ও রুঢ় বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে। ভিডিওটি দেখে অনেকেই সেই প্রবাসীর মতো নিজেদেরও দুঃখ কষ্ট শেয়ার করেছেন। প্রবাসে থেকে দেশের ফোন কখনো মধুর; আবার কখনো কষ্টের!
ভিডিওটি ওমান প্রবাসী এক বাঙালির। একটি ক্যারাভান শেয়ার করেন ৩ প্রবাসী। সিঙ্গেল বেডে তাদের রাত্রি যাপন। গভীর রাতে ফোনে ঘুম ভেঙে যায় ওই প্রবাসীর। তিনি ঘুম থেকে উঠে সিঙ্গেল বেডের খাটে বসে ফোনটি রিসিভ করেন। (তার ঠিক সামনে যে প্রবাসী থাকেন তিনিই এই ভিডিওটি করেছেন।)
কথোপকথন:
– হ্যালো! কী হইছে? (দরদভরা কণ্ঠ। বোঝাই যাচ্ছিল দেশ থেকে স্ত্রীর ফোন। লোকটি চোখ কচলান) এখন কয়টা বাজে? ট্যাহা তো তোমারে ২ মাস আগেই পাঠাইছি না? (ওপাশের কথা শুনে হঠাৎ লোকটির দরদভরা কণ্ঠ বদলে যায়) খালি ট্যাহা ট্যাহা ট্যাহা করো, খালি ট্যাহা ট্যাহা ট্যাহা করো!
বোঝা যাচ্ছে লোকটি তার স্ত্রীর ফোনে বিরক্ত হয়েছেন। স্ত্রী ফোন করেই শুধু টাকা চান। তার রুমে যারা থাকেন, তারাও বিষয়টি সম্পর্কে অবগত। আর সে কারণেই তাদের একজন ভিডিওটি করেছেন।
ট্যাহা তো পাঠামুই, কিন্তু বেতন না দিলে কী করতাম। খালি ট্যাহা ট্যাহা ট্যাহা করো। (ওপাশ থেকে হয়তো তার স্ত্রীর টাকার চাহিদা থামছেই না।) ঘুমাইতেও দিতা না? তুমগো ঠেলায় ঠেলায় আমার চুলডি পর্যন্ত উইঠ্যা গেলো গা। বুজজো?
(এ কথা বলে লোকটি চুল উধাও হওয়া মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। তারপর চিৎকার করে ওঠেন!) ওরে বাবারে বাবা! ট্যাহা না দিতে পারলে বাংলাদেশে আইবার পারতাম না! কথার ইশটাইল কি? ট্যাহা কি বলদের পু* দিয়া আহে?
(মনে হলো স্ত্রীর কথায় তিনি অস্থির-পেরেশান। সারাদিন কড়া রোদের মধ্যে পরিশ্রম করে রাতে যে একটু ঘুমাবেন সেটাও পারছেন না।) ঘুমাইতে পারি না। খালি ফোন আর ফোন। ফোন আর ফোন। খালি ফোন আর ফোন! আমি ট্যাহা পয়সা পাঠাতে পারতাম না এহন। বেতন না পাইলে পাঠাতে পারতাম না।
(ওপাশ থেকে হয়তো তার স্ত্রী অভিমান করে বলেছেন তাকে আর ফোন দিবে না। লোকটি আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠেন।) ও আচ্ছা… আচ্ছা ফোন দিও না। হ্যাঁ, আর ফোন দিবো না। ফোন দিলে দিবা। না দিলে না দিবা। খালি ট্যাহা ট্যাহা ট্যাহা! ট্যাহা কি বলদের পু* দিয়া আহে? ঘুমাইতে দেয় না।
এই পর্যায়ে রুমের অন্য প্রবাসীরা তাকে বাইরে গিয়ে কথা বলতে বলেন। তাদেরও তো ঘুমের সমস্যা হচ্ছে। ফের সকাল হলেই তো আবার কাজ আর কাজ। একজন তাই বলেন- ‘এই মিয়া বাইরে গিয়ে কথা কন না?’ লোকটি তার সঙ্গেও উত্তেজিত হন- ‘ক্যা। বাইরে গিয়ে কথা কইবো?’
(হঠাৎ লোকটি দাঁড়িয়ে যান। ফোনে চিৎকার করে ওঠেন।) ট্যাহা কামাইয়া দ্যাহো। তোমরার লাইগা মান সম্মান সব শেষ অইয়া গেলো গা। হ্যায় জনে কয় আমার ফোন আহে। হ্যায় জনে কয় আমার ফোন আহে। হ্যায় জনে কয় আমার ফোন আহে। ফোন ফোন ফোন ফোন… মোবাইল আমি আজ ভাইঙ্গাই ফালাইমু।
বলেই লোকটি তার স্মার্টফোনটি মেঝেতে আছাড় মারেন। তারপর বেডের নিচ থেকে মশলা পেষার হামানদিস্তা দিয়ে মোবাইলটি ছেঁচতে থাকেন। আর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকেন- ‘মোবাইলই রাখতাম না আর। মোবাইলই আর রাখতাম না।’
কিন্তু তার মোবাইলটি ভাঙছিল না। তখন তিনি বেডের নিচে পেয়ে যান হাতুড়ি। এরপর তিনি হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তার মোবাইলটি ভেঙে ফেলেন। তারপর বুকভরা অভিমান নিয়ে বেডে গিয়ে শুয়ে পড়েন।
ভিডিওটি দেখে এক প্রবাসী প্রতিক্রিয়ায় লিখেছেন, সকাল থেকে ভিডিওটি বারবার দেখেছি আমি। আবুধাবিতে ৪৫ ডিগ্রি রোদে কাজ করার স্মৃতি বারবার উঁকি দিচ্ছিল মনে। আমি যখন আবুধাবি ছিলাম; তখন প্রথমদিকে আমরা চার কলিগ একটি ক্যারাভান শেয়ার করতাম। এক প্রবাসীর কষ্ট আরেক প্রবাসীকে গ্রাস করবেই। হঠাৎ হাত চলে যায় চোখের কোণে … আঙুল বুঝতে পারে সেখানে পানি জমেছে!
অনেকেই ভিডিওটি শেয়ার করেছেন তাদের ওয়ালে। অপর একজন লিখেছেন, প্রবাস জীবনের বাস্তবতা। আবার কেউ লিখেছেন, সত্যি বলতে এটাই হলো একজন প্রবাসীর দুঃখ।
তবে প্রবাস জীবনের নির্মম আর রূঢ় বাস্তবতা তুলে ধরা ভিডিওটির সত্যাসত্য নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাদের ধারণা, এটি হয়তো পরিকল্পনা করে বানানো ভিডিও- উদ্দেশ্য সামাজিক মাধ্যমে তোলপাড় তৈরি করা।
তবে এর সত্যাসত্যের প্রশ্ন-উত্তর একপাশে সরিয়ে রেখেও ভিডিওটি দেখলে একটি বাস্তবতা প্রবাসী মাত্রকেই আত্মমগ্ন করে ফেলছে- তা হচ্ছে এর ভেতরকার তিক্ত বাস্তবতা, একজন প্রবাসীর গুমরে ওঠা কান্না যা সে কারও কাছেই প্রকাশ করতে পারে না।
হাজারো প্রবাসীর মর্মবেদনা ফুটে উঠেছে এই ভিডিওতে। দেশে রেখে যাওয়া প্রিয় স্বজন, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন, এমনকি মা-বাবাও প্রবাসীদের বিষয়ে যে অবহেলা দেখান, দেশে পাঠানো টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলেন, প্রতারণা করেন তার অদৃশ্য দগদগে ঘা ফুটে উঠছে এই ভিডিওর আড়ালে।
নিজে যখন কঠিন রোদে পুড়ে, জীবনকে হাতে নিয়ে রেমিটেন্স কামাই করেন তখন হয়তো দেশে তার সন্তান বখে যাচ্ছে, আসক্ত হয়ে পড়ছে ইয়াবা-ফেন্সিডিলে, স্ত্রী বা স্বামী পরপুরুষে বা পরনারীতে আসক্ত হয়ে পড়ছে, জমিটা কেড়ে নিতে ভাই-বোন দিচ্ছে দাবার চাল…।
মোট কথা, প্রবাসীর চোখের লোনাপানি ধারা যেন এই ভিডিওটি। দেশে থাকা প্রবাসীর স্বজনরা যদি এর বাণী কিছুটা হলেও হৃদয়ঙ্গম করেন তবে অনেক প্রবাসীই উপকৃত হতে পারেন, এটা আশা করাই যায়। আমরা চাই না- কোনো প্রবাসী দুঃখ পান। আমরা চাই না- আর কোনো প্রবাসী কান্নায় ভেঙে পড়ুক। প্রবাসীরা যে আমাদেরই সম্পদ।
ভিডিওটা দেখুন: