ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর অবদান নিয়ে মিথ্যাচারের জবাব- ইতিহাস থেকে

0

সময় এখন ডেস্ক:

১৯৪৮ থেকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষায় পাকিস্থানি শাসকদের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের বীজতলা তৈরি করে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাই আমাদের রক্তস্নাত বর্ণমালার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিক সংগ্রামে এক স্বাপ্নিক কারিগর হিসেবেই ইতিহাসে স্থান সর্বকালের এই সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি।

যে ভাষার জন্য এমন আকুল হয়েছিল বাঙালি, ঢেলে দিয়েছিলো বুকের তাজা রক্ত, সেই ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদান চিরস্মরণীয়।

কিন্তু ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‘বঙ্গবন্ধু ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিলেন’ সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দেয়া এই উক্তিটি নিয়ে অপপ্রচারে নেমেছে স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপি-জামায়াত। বিশেষ করে ফেসবুকের ‘বাঁশের কেল্লা, আই এম বাংলাদেশি, আপনি মানুষ না আওয়ামী লীগ’সহ বিভিন্ন গুজব পেইজের মাধ্যমে তারা জাতির পিতাকে নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।

অথচ ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যথার্থই বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে বাংলা ও পাঞ্জাবকে দুই ভাগ করে ভারত-পাকিস্থান দুই রাষ্ট্রের জন্ম তথা দেশভাগ হলে, সে বছরেরই ৩০শে ডিসেম্বর গঠিত হয়েছিল প্রথম ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।

অবিভক্ত বাংলাকে এভাবে দুই টুকরো করার বেদনা তরুণ শেখ মুজিব মেনে নিতে পারেননি। তাই কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরেই তিনি অবিভক্ত বাংলার রাজনীতি থেকে পূর্ববাংলার নিজস্ব রাজনীতি নির্মাণে মনোনিবেশ করেছিলেন।

যার ফলশ্রুতিতে দেশভাগের ঠিক পরের বছরই তিনি অছাত্র ও এলিটদের নিয়ন্ত্রিত ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম ছাত্রলীগ’-এর বিপরীতে গণতান্ত্রিক ধারায় সক্রিয় ছাত্র-নেতাদের নিয়ে ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ‘পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দেন।

ঠিক পরের মাসেই, ১৯৪৮ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি করাচীতে পাকিস্থান সংবিধান সভায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবে সব মুসলিম লীগ সদস্য সমর্থন দেয়।

এর প্রতিবাদে ‘পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম ছাত্রলীগ’ ও তমদ্দুন মজলিশ যুক্তভাবে সর্বদলীয় সভা আহ্বান করে। ফজলুল হক মুসলিম হলের সেই সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয় এবং ১১ই মার্চ ‘বাংলা ভাষা দিবস’ পালনের ঘোষণা দেয়।

১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সারা দেশে পালিত হয় প্রথম ধর্মঘট। ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট পালনকালে অন্য আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ঢাকার সচিবালয় গেট থেকে মুজিবকে গ্রেপ্তার করা হয়।

১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ ঢাকায় মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে ছাত্ররা মুখের ওপর তা প্রত্যাখ্যান করে। মুসলিম লীগ এলিটদের মদদপুষ্ট ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম ছাত্রলীগ’ জিন্নাহকে অন্ধভাবে সমর্থন দেয় এবং সম্পূর্ণভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

এর বিপরীতে মুজিব ও তাঁর সমমনাদের নেতৃত্ব ‘পূর্ব পাকিস্থান মুসলিম ছাত্রলীগ’ বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

১৯৫২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি মুজিবসহ রাজবন্দিরা পূর্ব পাকিস্থানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বরাবর এ মর্মে চিঠি দেন যে, ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাঁকে ও অপর বন্দি মহিউদ্দিন আহমেদকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া না হলে তারা ১৯শে ফেব্রুয়ারি থেকে আমরণ অনশনে যাবেন।

১৯শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে অন্যায়ভাবে ২ বছরেরও অধিক সময় আটকে রাখার প্রতিবাদে শেখ মুজিবুর রহমান কারাগারে অনশন শুরু করেন। কারাগারে বসেই ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্টভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলি চালানো এবং কয়েকজনের শহিদ হওয়ার খবর পান শেখ মুজিব।

টানা ১০ দিন অনশনের পর ২৮শে ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর কারাগার থেকে অসুস্থ অবস্থায় মুক্তিলাভ করেন শেখ মুজিব। সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার আগেই তিনি টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় যান এবং সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করেন।

রাষ্ট্রভাষার দাবিতে শহিদদের আত্মদানের বিষয়টিকে মুজিব অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন এবং রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যান।

১৯৫২ সালের ৩০শে মে সরকারি নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মুজিব করাচীতে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্মারকলিপি দেন। যেখানে ভাষা আন্দোলনে গ্রেপ্তারকৃত সব বন্দিকে মুক্তির জোর দাবির পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ মিছিলে কেন গুলি চালানো হলো সে বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তেরও কথা বলেন শেখ মুজিব।

পরবর্তী বছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার আরমানিটোলা মাঠে প্রথম শহিদ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ২১শে ফেব্রুয়ারি কেবল ভাষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামের দিন নয়। বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলন, খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের নিশ্চয়তা বিধান, অধিকার, বাক-স্বাধীনতা ও বঞ্চনামুক্ত সমাজ নির্মাণের আন্দোলনের প্রতীক।

এরপরের ইতিহাস সবার জানা। স্বাধিকারের পথ বেয়েই আসে স্বাধীনতা। যার অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দেন জাতির পিতা। সে কারণেই বলা হয়, বাংলাদেশের অপর নাম বঙ্গবন্ধু।

শেয়ার করুন !
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!