শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ডেস্ক:
তানভীর পিয়াল মূলত তরুণ কবি হিসেবে চট্টগ্রামের সাহিত্য অঙ্গনে পরিচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মুক্ত চলচ্চিত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবেও তাকে চেনেন শিল্প-সংস্কৃতি অঙ্গনে সম্পৃক্তরা। বেশ কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, নাটক, তথ্যচিত্র নির্মাণ, অভিনয়, স্ক্রিপ্ট লিখনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। লম্বা সময় যুক্ত ছিলেন সাংবাদিকতায়। বর্তমানে জনসংযোগ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন ইস্ট ডেল্টা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এবারের অমর একুশে বইমেলায় চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে চলচ্চিত্র বিষয়ক বই ‘সিনেমা দেখার চোখ’। লেখকের সাথে একান্ত আলাপচারিতার প্রকাশিতব্য কিছু অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। সময় এখন-এর পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন শওকত খান।
শওকত খান: পিয়াল, কেমন আছেন?
তানভীর পিয়াল: ভাই, এভাবে না। অস্বস্তিবোধ করছি। সবসময় যেভাবে কথা বলি আমরা সেভাবেই হোক। আপনার মুখে ‘আপনি আপনি’ সম্বোধনটা ঠিক হজম হচ্ছে না। একেবারে ঘরোয়াভাবে আলাপ করি? আমি ভালো আছি ভাই।
শওকত খান: হা হা হা। আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে সেভাবেই হোক। কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা জোনায়েদ রশিদ থেকে যখন শুনলাম তোমার বই বেরোচ্ছে, ধরেই নিয়েছিলাম কাব্যগ্রন্থ পেতে যাচ্ছি। পরে জানলাম কবিতা নয়; ‘সিনেমা দেখার চোখ’ সম্পর্কে জানতে চাই-
তানভীর পিয়াল: নাম থেকেই অনুমেয়, বইটা চলচ্চিত্র নিয়ে। চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন থেকে বের হচ্ছে। প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত। এতে বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আমার মৌলিক ও অনুবাদকৃত রচনা সংকলিত হয়েছে। বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির দশকওয়ারি ইতিহাস নিয়ে একটা লেখা রয়েছে। পুনর্বিবেচনা নামক অধ্যায়ে তিনটা চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা আছে। এগুলো মূলত রিভিউ। তিনটিই পূর্বপ্রকাশিত।
আলাপ-সালাপ অধ্যায়ে তিনজন বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ নির্মাতার সাক্ষাৎকার-নির্ভর লেখা রয়েছে। সাক্ষাৎকার-নির্ভর এজন্যই বলছি- এই তিনটির দুটো রচনা কোনো একক সাক্ষাৎকারের অনুবাদ নয়। বরং অনেকগুলো সাক্ষাৎকার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো নিয়ে এমনভাবে সাজানো, যা পড়ে মনে হবে নির্মাতা নিজেই প্রবন্ধের আকারে এটি লিখেছেন। মনেই হবে না এটা সাক্ষাৎকার।
শেষ অধ্যায় হলো- নির্মাণ প্রসঙ্গে। নিজস্ব নির্মাণশৈলীর গুণে বিশ্ব-চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করা তিন নির্মাতার দিক-নির্দেশনামূলক আলোচনা আছে এতে। তাদের বিভিন্ন মাস্টারক্লাস, সাক্ষাৎকার থেকে বাছাইকৃত অংশের অনুবাদ মূলত এ তিনটি লেখা।
শওকত খান: ফেসবুক পোস্টে বলেছিলে সাড়ে দশটা লেখা থাকছে। এখানে তো মোট দশটা পেলাম। বাকি আদ্ধেকটা?
তানভীর পিয়াল: হা হা হা। ওটা আদতে আমার বইয়ের ভূমিকাটাকেই ইঙ্গিত করা। ওটা পড়তে গিয়েও পাঠক একটা পূর্ণাঙ্গ লেখার স্বাদ পাবে বলেই আমার বিশ্বাস। সিনেমা দেখার চোখ- ব্যাপারটা আসলে কী, তা বোঝানোর জন্যই ওটা লেখা। ভূমিকায় বইটা নিয়ে খুব বেশি কথা আসলে নেই। তাই ওটা আধা লেখা। সব মিলিয়ে সাড়ে দশ।
শওকত খান: সিনেমা দেখার চোখ- ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলো।
তানভীর পিয়াল: এটা তো আসলে অনেক বড় প্রসঙ্গ। অল্প কথায় বলা মুশকিল। চলচ্চিত্র এমন এক মাধ্যম, যা নিয়ে যে কেউ যে কোনো মন্তব্য করতে পারে। রিকশাওয়ালা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সবাই মতামত প্রদান বা মূল্যায়ন করতে পারে, একান্ত অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু সবার রায় আমরা গ্রহণ করি না। কেন? কারণ, সবাই আসলেই একটা শিল্পমাধ্যমকে বিচার করার ক্ষমতা রাখে না। এজন্য প্রস্তুতি ও সাধনার প্রয়োজন আছে।
একটা চলচ্চিত্র কেন ভালো, কেন খারাপ, একজন নির্মাতা কেন সেরা, কেন অন্যদের চেয়ে ভিন্ন, কোথায় তার মুন্সিয়ানা- এগুলো বুঝতে, পার্থক্য করতে যে চোখ দরকার, ‘সিনেমা দেখার চোখ’ বলতে সেটাকেই বুঝাতে চাইছি।
চলচ্চিত্র তো শুধু গল্পটা বা অভিনয়টা নয়। এর পেছনে আরও অনেক কিছুই থাকে। কী থাকে, কী থাকা উচিৎ- এরকম নানা বিষয় নিয়ে বইটাতে আলোচনা আছে। আমি বলছি না, বইটা পড়লেই সবার চলচ্চিত্র দেখার চোখ তৈরি হয়ে যাবে। কেউ যদি সেই উৎকর্ষ অর্জন করতে চায়, বইটা তাকে কিছুটা সহযোগিতা করতে পারে এই যা।
শওকত খান: চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি তো তোমার অনেকদিন ধরেই। চলচ্চিত্র নির্মাতা জোনায়েদ রশিদ সম্পাদিত জুম ইন-এ নিয়মিত লিখছো।
তানভীর পিয়াল: হ্যাঁ, ২০১২ থেকে শুরু। তবে, অনেক লিখে ফেলেছি এই ক’বছরে, বিষয়টা আসলে এমন না। লেখা সবমিলিয়ে অল্পই বলা যায়।
শওকত খান: সেক্ষেত্রে প্রশ্ন তোলা নিশ্চয় অসঙ্গত হবে না, বই বেরোতে এতোদিন কেন লাগলো?
তানভীর পিয়াল: টুকটাক লেখালেখি করে কি আর বই বের করা যায় ভাই? তাছাড়া নিজের প্রস্তুতির ব্যাপার জড়িত। এ বইটার পরিকল্পনা হুট করেই। আমি গত তিন বছর ধরে অন্য দুটো বই নিয়ে কাজ করছি। সে দুটো আকারে এবং বিষয়গত দিক থেকে বেশ বড়। এ বছর বা আগামী বছর নাগাদ দুটোই প্রকাশিত হবে বলে আশা করছি।
‘সিনেমা দেখার চোখ’ আসলে সেই কাজের মাঝখানে ছোট্ট টিফিন ছুটির মতো ব্যাপার। এটা বের না হলে ঐ দুটোর যে কোনোটাই আমার প্রথম বই হিসেবে প্রকাশ পেতো, হয়তো।
শওকত খান: সে দুটোও কি চলচ্চিত্র নিয়েই?
তানভীর পিয়াল: একটা ইতিহাস নিয়ে, আরেকটা চলচ্চিত্র। এ সম্পর্কে এর বেশি আপাতত বলতে চাই না।
শওকত খান: ঠিক আছে। একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। তোমার কবিতার খবর বলো। আমাদের সবারই প্রত্যাশা ছিলো কবিতার বই দিয়েই যাত্রা শুরু করবে তুমি। কবিতা কি আপাতত কুলুঙ্গিতে তুলে রেখেছো? হঠাৎ গদ্য কেন?
তানভীর পিয়াল: আসলে, কিছু ভেবে গদ্যে আসা বা কবিতায় যাওয়া, এমন না। বয়সটা এসব ভাবারও নয়। সবকিছুকেই এক্সপ্লোর করছিলাম। সব ধরনের বই পড়ছিলাম। শুরু থেকেই গদ্য আমাকে টানতো। উপন্যাস শুধু না, ইতিহাস বা প্রবন্ধও পড়া শুরু কৈশোরেই।
গদ্য লেখার শুরুটা জুম ইন সম্পাদক, নির্মাতা জোনায়েদ রশিদের হাত ধরে। তার পত্রিকার জন্য রিভিউ লিখতে বলেন। দুটো লিখেওছিলাম। শুরুটা সেভাবে হলেও, গণজাগরণ মঞ্চ চলাকালীন বাংলার ধর্ম ও সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে আমার এক প্রবন্ধ পড়ে কবি হাসনাত শোয়েব আমাকে প্রথম গদ্য নিয়ে সিরিয়াস হতে বলেন।
তো এরপরই গদ্যে মনোযোগী হই। লিখন-ভঙ্গিমা, শব্দ নিয়ে টুকটাক এক্সপেরিমেন্ট করতে শুরু করি। এখনও ঐ পর্যায়েই আছি। ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে তা দাঁড়ায়, আমি নিজেও তা দেখতে চাই।
শওকত খান: চলচ্চিত্র নির্মাণের ইচ্ছের কথা আবারও বলেছিলে সেদিন চেরাগির আড্ডাতেও-
তানভীর পিয়াল: চলচ্চিত্র তো মনে মনে প্রতিনিয়তই বানাই। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যেমন করতেন। চলচ্চিত্র বানানোর ইচ্ছে আমার নেই সে কথা বলবো না। তবে, চলচ্চিত্র নির্মাণ এক ধরনের ফুলটাইম জব। এটাকে পেশা হিসেবে নেয়ার মতো পরিস্থিতি বা আর্থিক-মানসিক দৃঢ়তা আপাতত আমার নেই। বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রিরও বর্তমানে সেই অবস্থা নেই।
ভবিষ্যতে যদি সুযোগ তৈরি হয়, কেন বানাবো না! আমি তো কী কী চলচ্চিত্র বানাবো, তার গল্পও বুনে রেখেছি। তাদেরকে লালন করে চলেছি দীর্ঘদিন ধরেই। দেখা যাক, কখনও পর্দায় তাদেরকে আনতে পারি কি না।
শওকত খান: বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে তুমি কতটা আশাবাদী?
তানভীর পিয়াল: চলচ্চিত্র-টিভি দুই ইন্ডাস্ট্রিরই অবস্থা বর্তমানে যাচ্ছেতাই। তবে, ইউটিউব, ওটিটির মতো প্ল্যাটফর্মকে কাজে লাগানো গেলে ভালো কিছু হলেও হতে পারে। আর, আশা করতে তো দোষ নাই।
শওকত খান: পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলো-
তানভীর পিয়াল: স্বাস্থ্যবিধি মেনে মেলায় আসুন। বই কিনুন আর না কিনুন, প্রচুর বই পড়ুন, যেভাবেই হোক।
‘সিনেমা দেখার চোখ’ বইয়ের ফ্ল্যাপে লেখকের কথা- চোখের শিক্ষিত-অশিক্ষিত বলে ব্যাপার আছে। অশিক্ষিত চোখ কেবল তাকায়, দেখে না। দেখতে হলে চোখকে দেখার জন্য প্রস্তুত করে তুলতে হয়। এই চোখ শারীরিক নয়; পিট পিট করে, কেতুর জমে কিংবা ছলো ছলো জল ঝরিয়ে দেয় যে, সেও নয়।