৭৫-এর মতো পটভূমি তৈরিতে দেশিয় গণমাধ্যমগুলো আবারও সক্রিয়, এবারের টার্গেট শেখ হাসিনা

0

বিশেষ প্রতিবেদন:

গত ২১শে মে তারিখে ‘মন্ত্রীর ফটোসেশন শেষে ফিরিয়ে নিলো ত্রাণ, খালি হাতে ফিরলেন মাহফুজ’- এমন চটকদার শিরোনামে কুখ্যাত ডেইলি স্টার পত্রিকা একটি সংবাদ পরিবেশন করে। যাতে দাবি করা হয়- প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বন্যা দুর্গত মাহফুজ মিয়ার হাতে ত্রাণ হস্তান্তরের ছবি তোলেন, তবে ফটোসেশন শেষে কর্মসূচির আয়োজকরা তার কাছ থেকে ত্রাণ কেড়ে নেন।

এমন ইচ্ছেকৃতভাবে তৈরি ভিত্তিহীন, মিথ্যা ও নোংরা সংবাদটির স্ক্রিনশট দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্যুৎগতিতে। দেশজুড়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয় মন্ত্রী ইমরান আহমদ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এবং সরকারকে নিয়ে। ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সুনামহানি হয়। সংবাদমাধ্যমের ওপর আস্থাশীল সাধারণ মানুষের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এমন সংবাদে।

সংবাদটি আলোড়ন সৃষ্টির পড়ার পর স্থানীয়দের কাছে খবর নিয়ে জানা যায়, পুরো সংবাদটি ভিত্তিহীন এবং মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। ত্রাণ ফিরিয়ে নেওয়ার এমন কোনো ঘটনা ঘটেইনি। এমনকি ছাপা হওয়া ব্যক্তির ছবি দেখে কেউ তাকে চেনেন না বলে জানান স্থানীয়রা।

‘সাহসিকতা, সততা ও সাংবাদিকতা’ সাইনবোর্ডে টাঙানো এই পত্রিকাটিতে একজন মন্ত্রী সম্পর্কে মিথ্যাচার করার পরদিন ৩ লাইনের গুরুত্বহীন একটি ক্ষমাসূচক বার্তা ছাপা হয়। তাতে বলা হয়- ‘অভিযোগকারীর বক্তব্যের সত্যতা যাচাই না করে খবর প্রকাশের জন্য আমরা ক্ষমাপ্রার্থী এবং আমাদের দায়ী কর্মীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

মাসখানেক আগেই বাগেরহাটের ৫ বছরের শিশু আরিয়ানকে নিয়ে এক মিথ্যাচার চালিয়েছিল প্রথম আলো। সেখানে শিশু আরিয়ান মায়ের জন্য শাক কুড়াতে যায় বলে স্কুলে যেতে পারে না- শীর্ষক ফটো স্টোরি করা হয়েছিল। পরবর্তীদের দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, পুরোটাই ভুয়া। সেই ঘটনার পর কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। প্রথম আলো এবং ডেইল স্টার- দুটোই একই প্রতিষ্ঠানের অধীনস্ত পত্রিকা।

বাংলাদেশবিরোধী শক্তি এবং বিদেশি প্রভুদের গোলামি করা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কুকর্মের ফিরিস্তি অনেক লম্বা। পদ্মাসেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে সবচেয়ে বড় নিয়ামক ছিল ট্রান্সকম গ্রুপের এই পত্রিকা দুটি।

ওয়ান-ইলেভেনের কুখ্যাত মাইনাস ফর্মূলার উদ্ভাবকও ছিল এই দুটি পত্রিকার সম্পাদক- মতিউর রহমান এবং মাহফুজ আনাম। যাদের অপতৎপরতায় অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত কঠোর হতে বাধ্য হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। তাঁর নির্দেশে গণভবনে এই দুটি পত্রিকার প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

তবুও থেমে নেই পত্রিকাগুলো চক্রান্ত। নিয়মিত অপসাংবাদিকতা করে যাচ্ছে এই হাউজের সংবাদকর্মীরা। তথ্য বিকৃতি ঘটানো, সামঞ্জস্যহীন সংবাদ শিরোনাম, ম্যানিপুলেশন, প্রকাশিত সংবাদ দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে অগোচরে লিংক সরিয়ে নেওয়া, বিকৃত শিরোনাম করার পর লিংকের ভেতরে তা বদলে দেওয়া, ফটোশপকৃত ছবি- এমন নানান ঘটনা তাদের ‘বদলে দাও, বদলে যাও’ নীতির বহিঃপ্রকাশ।

অনেকেরই মনে আছে বাসন্তী কাণ্ডের কথা। ইত্তেফাকের মত প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় ছাপা হয় জাল পরা বাসন্তীর ছবিসহ জঘন্য ও নোংরা মিথ্যাচার। বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নকারী সেই মিথ্যা ও বানোয়াট সংবাদের ফলাফল ছিল অত্যন্ত জঘন্য। বাসন্তীকে মাছ ধরার জাল পরানো ছবিটা তোলেন ফটোগ্রাফার আফতাব আহমেদ। প্রকাশিত হয়েছিলো দৈনিক ইত্তেফাকে ১৯৭৪ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর, বুধবার; ইত্তেফাকের ভেতরের ক্রোড়পত্রে।

তৎকালীন ইত্তেফাকের সম্পাদক ছিলো ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা- সিআইএ’র বিশেষ আস্থাভাজন বলে যার ‘সুখ্যাতি’ রয়েছে বিভিন্ন মহলে।

বাসন্তী ও তার কাকাতো বোন দুর্গতিকে নগদ টাকা দিয়ে তোলা সেটপিস ফটোগ্রাফটি ছিল বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে মিডিয়া ক্যু এবং দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের এক জঘন্য ইন্ধন। যা করা হয়েছিল ইত্তেফাক পত্রিকার তত্ত্বাবধানে। যে ইত্তেফাক পত্রিকাকে বাংলাদেশের সংবাদ সংশ্লিষ্ট মহলে অনেকেই সিআইএ’র মুখপাত্র হিসেবে আখ্যা দেন।

১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের বর্বরতম নাশকতা পরিচালিত হয়েছিল যে কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থাটির যোগসাজশে, তারা স্বাধীনতার পর থেকেই যুক্ত ছিল গভীর ষড়যন্ত্রে। যার পটভূমি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল বাংলাদেশি কিছু গণমাধ্যম।

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সারাজীবন শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, দেশের মানুষের কল্যাণে, স্বাধীকারের জন্য লড়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা করে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হাতে সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। বাংলাদেশ স্বাধীন করার পর তাঁর শত্রুর সংখ্যা কমেনি, বরং বেড়েছিল।

কারণ, তিনি স্বাধীনতাবিরোধী চক্র, দেশি-বিদেশি শত্রুপক্ষ, লোভী, ঠগ, কালোবাজারিসহ বিভিন্ন পক্ষের বাড়া ভাতে ছাই ঢেলে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশকে একটি উন্নত সমৃদ্ধ ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ার জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা প্রায় গুছিয়ে এনেছিলেন, যা বাস্তবায়িত হলে আজকের বাংলাদেশ ইউরোপের যে কোনো দেশের মত উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে থাকতো।

কিন্তু সব ব্যর্থ করে দেয় ঘাতক চক্র। জনমানুষের প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধুকে দেশবাসীর হৃদয় থেকে মুছে দেওয়া সহজ নয়। কারণ, ঘাতকরা জানতো, শেখ মুজিব কোনো একক ব্যক্তি নন, মুজিব একটি আদর্শের নাম, একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। ব্যক্তি শেখ মুজিবকে হয়তো হত্যা করা যায়, কিন্তু মুজিববাদ যদি টিকে থাকে, শত শত মুজিব জন্ম নেবে, বঙ্গবন্ধুরর স্বপ্ন পূরণ করে বাংলাদেশকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারবে।

তাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। যেন দেশকে নেতৃত্ব দিতে না পারে তাঁর পরিবারের কেউ। মুজিববাদে বিশ্বাসী চার নেতাকেও হত্যা করা হয় একই কারণে। তবে তারও আগে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলকে বিতর্কিত এবং তাঁর সরকারকে বিপর্যস্ত করে তুলতে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বরের পর থেকেই শুরু হয় ঘৃণ্য পরিকল্পনা।

অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এর লেখা “ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস : বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড” বইয়ে ১৯৮১ সালের ২১শে মে সেনাবাহিনীর ৩ সাবেক সদস্যের সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যের বরাতে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থান এবং সপরিবারে শেখ মুজিব হত্যার ব্যাপারে ১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল- জাসদ দায়ী।

সেই সাংবাদিক সম্মেলনে এই তথ্য প্রকাশকারীদের মধ্যে ছিলেন- সাবেক নায়েক সুবেদার মোহাম্মদ জালালউদ্দিন (সহ-সভাপতি, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা – সাবেক গণবাহিনী, দপ্তর সম্পাদক), সাবেক নায়েক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান আসাদ (সদস্য – বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা)।

বিদেশি শত্রুদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থে সারাদেশে নাশকতা, তাণ্ডব, অগ্নিসংযোগ, ধ্বংসযজ্ঞ, খাদ্য গুদাম লুট, ধান-পাটবাহী নৌকা ডুবিয়ে দেওয়া, দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের অস্ত্রাগার ও ট্রেজারি লুণ্ঠন থেকে শুরু করে হেন কোনো অপতৎপরতা ছিল না, যা তারা চালায়নি। আর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার দায় চাপতো সরকারের কাঁধে। জনমনে অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠছিল এভাবেই।

বোমাবাজি, হত্যা, খুন, ডাকাতি, সন্ত্রাসের খবর ছাপা হতো প্রতিদিন। জাসদ গঠনের পর আড়াই বছরে প্রায় প্রতিদিনই ট্রেন ডাকাতি, ব্যাংক ডাকাতি, পুরো গ্রাম ঘিরে গণডাকাতি, হাটবাজার ঘিরে প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত লোকের ওপর একযোগে সশস্ত্র হামলা, লুট ও ডাকাতির খবরে জনমনে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়।

এমন দিনও গেছে, একই দিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৪/৫টি ব্যাংক ডাকাতির খবরও মিলতো। ১৯৭২ সাল থেকে রাস্তায় রাস্তায়, ঘর-বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে সর্বত্র ‘বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস -জাসদ’ এই বাণী চিকা মারা থাকতো। পাশাপাশি চলছিল নানারকমের প্রোপাগান্ডা।

সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতা থামাতে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠপুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল এবং পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাসহ রাত-বিরাতে টহলে বের হতেন। এসব ঘটনাকে পুঁজি করে শেখ কামালের ব্যাংক ডাকাতি- শীর্ষক জঘন্য মিথ্যাচার পর্যন্ত করে চিহ্নিত কিছু পত্রিকা, যার একটি ছিল হলিডে।

ইত্তেফাকে ছাপা হওয়া জাল পরা বাসন্তীর ছবিসহ জঘন্য ও নোংরা মিথ্যাচারে বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। সামান্য ১০-২০ টাকার শাড়ি না কিনে বাসন্তী কেন ১৫০ টাকা দামের মাছ ধরার জাল পরেছে- সেই প্রশ্ন সেসময় কারো মনে জাগেনি। গণমাধ্যমগুলো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলছিল।

পত্রিকা ছাপতে ব্যবহৃত নিউজপ্রিন্ট উচ্চমূল্যে আমদানি করতে হতো বঙ্গবন্ধু সরকারকে। আর তা ভর্তুকি মূল্যে কিনে নিয়ে সেই বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধেই ছাপা হতো মিথ্যাচার, অপপ্রচার। সেসময় অবাধ তথ্য প্রাপ্তির কোনো বিকল্প উৎস না থাকায়, ছাপার অক্ষরে যা-ই দেখতো জনতা, তা-ই বিশ্বাস করত।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কী ঘটেছে আর কী ঘটেনি, যাচাইয়ের কোনো সুযোগ ছিল না; পত্রিকাই ভরসা। আর এই সুযোগে বিদেশি প্রভুদের অর্থায়নে এবং মদদে সরকারবিরোধী প্রোপাগান্ডার ক্যান্সারের মত আকার ধারণ করে। জনগণকে সরকারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে তোলা হয়।

এদিকে বিভিন্ন স্থান থেকে সন্ত্রাসীদের লুণ্ঠিত ও সংগ্রহীত অস্ত্র জমা হতে লাগলো এক বিশেষ ব্যক্তির বাসায়। সাপ্তাহিক হলিডের সাংবাদিক আনোয়ার সিদ্দিকীর সহযোগী ছিলেন জামাল ওরফে হামিদ ওরফে আবদুল হামিদ ওরফে নজরুল ইসলাম ওরফে খসরু। কিন্তু তার পাসপোর্টের আসল নাম ভিন্ন,- পিটার জোসেফ হুয়ান মারিয়া কাস্টার্স সংক্ষেপে পিটার কাস্টার্স। আরেকটি নাম ছিল তার- রেভো কন্টি। তিনি মূলত ডাচ নাগরিক। সর্বশেষ পরিচয় পাওয়া যায় একটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানবাধিকার সংস্থার কর্ণধার হিসেবে। বাংলাদেশের ওপর অনেক বই লিখেছেন বিতর্কিত চরিত্র মওলানা ভাসানীর এই কঠিন ভক্ত।

ডাচ নাগরিক হলেও পিটারের পড়াশোনাসহ লেজ বাঁধা ছিলো সিআইএ’র সদরদপ্তরে। নিজেকে পরিচয় দিতেন কখনো সাংবাদিক, কখনো রিলিফকর্মী হিসেবে। দৈনিক প্রথম আলোর ইউরোপ প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন আমৃত্যু (২০১৫ পর্যন্ত)। পত্রিকাটি তাকে রিব্র্যান্ডিং করেছে- ‘বাংলাদেশের বন্ধু’ বলে। এই পিটার কাস্টার্সের সাথে অতি মাখামাখি ছিল কর্নেল তাহেরের।

পিটার তখন সর্বহারা, চরমপন্থী এবং উগ্রপন্থী বামদের সংগঠিত করে বাংলাদেশে একটি বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করছিলেন সিআইএ’র নির্দেশে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট একমাত্র বিদেশী হিসেবে তিনি তাহেরের সঙ্গী হয়েছেন বাংলাদেশ বেতারে।

রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে স্বাধীন বাংলাদেশে ১৪ বছর কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া প্রথম এবং একমাত্র বিদেশী এই পিটার। যদিও একদিনও সেই সাজা ভোগ করতে হয়নি তাকে। মামলার রায় বের হওয়ার পরদিনই মার্কিন ও ডাচ দুতাবাসের চাপে কাস্টার্সকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় সরকার। এবং তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়।

জবানবন্দিতে পিটার জানিয়েছিলেন, পরিকল্পিত বিপ্লব সংঘটনের জন্য সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বাধীন সর্বহারা পার্টির সঙ্গে জাসদের গণবাহিনীর সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন তিনি। এজন্য ঢাকায় ৩টি বাড়ি ভাড়া করেন এবং নিবন্ধিত সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।

এ সবই করা হয় বাংলাদেশ ব্যবহারিক শিক্ষা নামে একটি এনজিওর আড়ালে। সারা দেশজুড়ে কর্মী সংগ্রহ ও তাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন কাস্টার্স নিজে। বিভিন্ন দাতা সংস্থা থেকে অনুদান সংগ্রহ করেন তিনি এবং কর্মীদের নির্দেশ দেন দেশের মধ্যে থেকে অস্ত্র সংগ্রহের (থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে)। সরকার এই অভিযোগে ব্যবহারিক শিক্ষার নামে ব্যাঙ্ক একাউন্টে তৎকালীন ১ লাখ ৯৬ হাজার ৬৫৬ টাকা ৪৮ পয়সা বাজেয়াপ্ত করেন।

তার দীর্ঘ জবানবন্দীতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকদের মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টির জন্য জাসদের সাথে মিলিত পরিকল্পনা, সশস্ত্র ক্যাডারদের প্রশিক্ষণের জন্য কর্নেল তাহেরের ৫০ হাজার ডলার দাবি এবং এই বাবদ কিস্তিতে বাহার ও আনোয়ারের (তাহেরের দুই ভাই) মাধ্যমে ৬০ হাজার টাকা প্রদান।

ড. আনোয়ার তাকে প্রতিশ্রুতি দেন, ৬০ হাজার টাকা রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র আক্রমণ ও রাজনৈতিক প্রচারণায় ব্যবহার করা হবে। এলিফ্যান্ট রোডে ভাই আবু ইউসুফের বাসায় তাহের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, শীঘ্রই সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করতে যাচ্ছেন তারা।

জাসদ শুধুমাত্র মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠে রয়েছে পরাজিত পাকিস্থানের নীলনকশা। যার পুরোটা বাস্তবায়ন ঘটায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। ১৯৭১-এ পাকিস্থানের পরাজয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঘটনাকে হেনরি কিসিঞ্জার নিজের ব্যক্তিগত পরাজয় বলে স্বীকার করেছিলেন।

১৫ই আগস্ট তার সেই প্রতিশোধ সম্পন্ন হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। ঢাকায় যা সমন্বয় করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিস ইউজিন বোস্টার এবং ঢাকাস্থ সিআইএ’র তৎকালীন স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি। সেই রাতের ঘটনা ক্ষণে ক্ষণে আপডেট জানানো হচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রে অপেক্ষমান কিসিঞ্জারকে।

১৫ই আগস্টে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের নারকীয় সেই হত্যাযজ্ঞটিকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য’ এবং ‘সময়ের প্রয়োজন’ বলে প্রতিষ্ঠিত করতে ১৯৭২ থেকে এভাবেই পটভূমি তৈরি করা হয়েছিল। যা আজ ফ্যাক্টস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

বিভিন্ন দলিল-দতস্তাবেজ, মাটি খুঁড়ে তুলে আনা ইতিহাসের পর্যালোচনা, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ডিসক্লোজড নথিপত্র বিশ্লেষণ করে বহুমুখী সেই ষড়যন্ত্রের তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের স্বরূপ উদঘাটিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কায়েমি স্বার্থ প্রতিষ্ঠায় মুজিব ছিলেন সবচেয়ে বড় অন্তরায়।

বহু বছরের নানান ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। পাকিস্থানিকরণ এবং শতবর্ষ পিছিয়ে যাওয়াকে ঠেকিয়ে বাংলাদেশকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে এনেছে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার। তাঁর সুদক্ষ পরিচালনায় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্যের সাক্ষর রেখেছে বাংলাদেশ। হেনরি কিসিঞ্জারের উপহাসকৃত ‘তলাহীন ঝুড়ি’ বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।

বৈদেশিক ঋণের জালে বাঁধার সুযোগ নাই বাংলাদেশকে, ভিক্ষা নেয় না এই বাংলাদেশ, উল্টো বিভিন্ন দেশকে ঋণ দিয়ে বিপদে-আপদে পাশে দাঁড়াচ্ছে। শক্তিশালী অর্থনীতির কারণে এশিয়ার ইমার্জিং টাইগার খেতাব পাচ্ছে এই বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিশ্বের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের একজন। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তাঁকে সমীহ করেন উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরা। তাঁর সাফল্যের মুকুটে যোগ হচ্ছে বিভিন্ন খেতাব আর পদক।

সুদীর্ঘ পরিকল্পনায় স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ এবং উৎপাদন ও উন্নয়নের সমন্বয়ে শক্ত অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ফলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বন্ধু যেমন বেড়েছে, তেমনি চিরশত্রুরাও পেছন থেকে আঘাত করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভূ-রাজনৈতিক কারণে অনেক দেশের চক্ষুশূল এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশকে বাগে আনা যাচ্ছে না, গোলামী করানো যাচ্ছে না, দেশটির সম্পদ লুটেপুটে খাওয়ার সুযোগ হচ্ছে না, ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের ভূখণ্ড ও জলসীমা ব্যবহার করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না, উন্নত সমরাস্ত্র আর সুযোগ-সুবিধার লোভ দেখিয়ে বাংলাদেশকে নিজেদের জোটে আনা যাচ্ছে না, চুক্তিতে স্বাক্ষর করানো যাচ্ছে না, নিষেধাজ্ঞাতেও কাবু নয় পুঁচকে দেশটি, বিশ্বমোড়লদের প্রবল প্রতিপক্ষদের সাথে বাংলাদেশের দহরম-মহরম- এসব সহ্য হবে কেন বাংলাদেশের চিরশত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের? আর তাই আবারও বিশ্বের মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের একমাত্র দোকানদার যুক্তরাষ্ট্র নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ছে বিগত কয়েক বছর ধরে।

সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ও সরকার- বিশেষ করে শেখ হাসিনা এবং মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে সরাসরি বিষোদ্গার এবং তথ্যসন্ত্রাসে লিপ্ত হয়েছে দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা। বঙ্গবন্ধু নিজে ছিলেন সংবাদকর্মী, ভর্তুকি মূল্যে সংবাদপত্রগুলোর জন্য নিউজপ্রিন্ট দিয়েও প্রোপাগান্ডার শিকার হয়েছিলেন।

সংবাদকর্মীদের প্রতি সবসময় উদার মনোভাব পোষণকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুস্থ সাংবাদিকদের কল্যাণে গঠিত তহবিলে নিজে বিপুল অঙ্কের অর্থ সহযোগিতা প্রদান করে এবং তাদের জন্য নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা প্রদানের পরেও ঠিক একইভাবে শিকার হচ্ছেন তথ্যসন্ত্রাসের।

দুটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজে নেমেছে গণমাধ্যমগুলো। সরকারপ্রধান কিংবা মন্ত্রী-সাংসদদের বক্তব্যকে টুইস্ট করে বিতর্ক সৃষ্টি এবং উস্কানির মানসে সংবাদ শিরোনাম করা হচ্ছে এখন। শুধু তা-ই নয়, কাল্পনিক সূত্রের বরাতে বিভিন্ন প্রকল্পে মনগড়া দুর্নীতির গপ্পো ছড়ানো হচ্ছে। যেমন- নাটবল্টু বিষয়ক একটি তথাকথিত দুর্নীতির সংবাদে হাস্যকর হিসাব দেখানো হয়েছিল। একটি পার্টসের ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে সম্মিলিত ব্যয়ের চেয়েও বেশি! অথচ সংবাদ শিরোনাম মানুষ ঠিকই গিলেছে যাচাই-বাছাই ছাড়াই।

এমনকি বিভিন্ন সময় গৃহীত সরকারি প্রকল্পের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জনগণের জন্য বিস্তারিত তুলে না ধরে চটকদার ও বিতর্কিত শিরোনাম ছাপা হচ্ছে। মূলত সংবাদ শিরোনাম আর সংবাদের বিষয়বস্তুতে কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে ছড়ানো হচ্ছে প্রোপাগান্ডা। দুর্নীতি রুখতে ও স্বচ্ছতা আনতে অনেক বছর ধরেই সরকারি টেন্ডার প্রক্রিয়া অনলাইন করা হয়েছে। সেই প্রক্রিয়ার একটি অংশের অর্থ না বুঝেই তাকে প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের কোম্পানি বলে হাস্যকর সংবাদও ছাপে কয়েকটি পত্রিকা।

সুইডেনভিত্তিক একটি বিতর্কিত ও প্রোপাগান্ডামূলক পত্রিকা ‘নেত্র নিউজ’, যার বাংলা সংস্করণের সম্পাদক হলেন দেশ ছেড়ে পালানো ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক তাসনিম খলিল এবং ইংরেজি সংস্করণের সম্পাদক ডেভিড বার্গম্যান- যিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে বেইমানি করা ড. কামাল হোসেনের জামাতা। বার্গম্যান যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করতে বিপুল অর্থের বিনিময়ে লবিস্টের করেছেন ইতিপূর্বে। রাজাকার সাকাচৌধুরীর বিশেষ আস্থাভাজন ছিলেন তিনি।

এই বার্গম্যান বাংলাদেশে নিউএজ, বিডিনিউজ এবং ঢাকা ট্রিবিউনে চাকরি করেছেন। দুর্নীতি, অসততা এবং সংবাদকর্মী হিসেবে অনৈতিক কাজে জড়িত থাকার দায়ে বিডিনিউজ কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করেছিল। সেই বার্গম্যান-খলিলের প্রোপাগান্ডা মেশিন নেত্র নিউজে ২০২০ সালে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন করেছে কুখ্যাত সংস্থা এনইডি।

এই তথ্য তাসনিম খলিল নিজেই স্বীকার করেন তার ফেসবুক পোস্টে। মূলত লিয়াজোঁ হিসেবে নেত্র নিউজ কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। সেই অর্থের একটি ভাগ পাচ্ছে বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সংবাদকর্মীরা। এই ৫০০ মিলিয়নই শেষ নয়। এই খাতে আরও অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এনইডি- ন্যাশনাল এনডৌমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি।

বিভিন্ন দেশের সরকার পতনের নেপথ্যে কাজ করা কুখ্যাত সংস্থা- এনইডি মূলত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র একটি ফ্রন্ট। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মার্কিনিদের বিতর্কিত ভূমিকা এবং পাকিস্থানের সাথে সখ্যতার ইতিহাস পুরনো। এনইডি বিশ্বের প্রগতিশীল ও উদীয়মান অর্থনীতির বিভিন্ন দেশকে ধ্বংস করতে এবং সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত সেই ষাটের দশক থেকে। দেশগুলো যেন মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে না পারে, তাই এনইডি নেপথ্যে সরকারবিরোধী প্রতিপক্ষ তৈরী করতে অর্থায়ন ও সাহায্য দেয়।

এনইডি’র পরিকল্পনায় কাজ করে সুবিধাভোগী গণমাধ্যমগুলো। যেখানে সরকারবিরোধী অপপ্রচার, গুজব, প্রোপাগান্ডা চালিয়ে জনমতকে ভিন্নপথে পরিচালিত করতে উসকানো হয়। যেন ক্যু ঘটালে জনগণ তা সহজেই মেনে নিতে পারে- এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এনইডি’র কারণে বহু দেশের সরকার উৎখাত হয়েছে ইতিপূর্বে।

১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পূর্বে ইত্তেফাক, হলিডেসহ অনেকগুলো পত্রিকাকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে কাজ করেছে সংস্থাটি। ইত্তেফাকের মালিক ব্যারিস্টার মঈনুল ৭৫-এর মত আজও সিআইএ’র বেতনভোগী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন- এমন মত অনেকেরই।

এনইডি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং গবেষক জেফরি টি রিচেলসন-এর লেখা বই থেকে। তিনি জানান, এনইডি যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র একটি আন্ডারকাভার প্রতিষ্ঠান। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সরকার পরিবর্তনের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষায় কোনো দেশের কোনো গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় নিয়ে আসা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে কোনো দেশের সরকারকে কৌশলে সরানোর পটভূমি তৈরি করে এনইডি।

এজন্য তারা ওসব দেশের স্থানীয় বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে নেগোশিয়েট করে বিভিন্ন ইস্যুতে জনগণ ক্ষেপিয়ে তোলে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ওই দেশ ও সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশ করে চাপ সৃষ্টি করে। একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ওই দেশের ভাবমূর্তি খারাপ হয়ে যায়। দেশের অভ্যন্তরেও নৈরাজ্য বৃদ্ধি পায়। নাড়া খায় সরকার।

এভাবেই এজেন্ডা সেট করে, মাঠ তৈরি করে, স্থানীয়দের সামনে রেখে, সুযোগ বুঝে হুট করেই অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কোনো দেশের সরকারের পতন ঘটায় মার্কিন গোয়েন্দারা।

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কাইভের সাবেক সিনিয়র ফেলো জেফরি টি রিচেলসন দীর্ঘদিন কাজ করেছেন জাতীয় নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের বিষয়ে। অনেক বছর গবেষণার পর কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তার দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ- দ্য ইউএস ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি এবং দ্য উইজার্ড অব ল্যাংলি: ইনসাইড দ্য সিআইএ’স ডিরেক্টরেট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি। ৫৯২ পৃষ্ঠার ‘দ্য ইউএস ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি’ গ্রন্থের ১৬তম অধ্যায়ের নাম ‘কাভার্ট অ্যাকশন’। এখানে মার্কিন গোয়েন্দাদের আধুনিক কার্যক্রম সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন রিচেলসন।

সেই গ্রন্থ থেকে জানা যায়- নিকারাগুয়ায় ক্ষমতাসীন সান্দিনিস্তাদের সরকারের বিরুদ্ধে এই পরিকল্পনা গণতান্ত্রিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য বিরোধীদের সঙ্গে নিয়ে অপারেশনে নামে এনইডি। প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়ে জনমত গঠন করে, তারপর রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে ১৯৯০ সালে নিকারাগুয়া সরকারের পতন ঘটায় তারা। একইভাবে ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, চিলিসহ অন্তত এক ডজন দেশে উগ্রবাদীদের দিয়ে সহিংসতা ছড়াতে মোটা অর্থ বিনিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র।

এর আগে ষাটের দশকের শুরুতে ইরানের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের সরকারকে হঠাতে পাহলভী বংশের রাজতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এটিও করেছিল সিআইএ।

নেত্র নিউজের পেছনে এনইডি’র ফান্ডিংয়ের বিষয়ে তাসনিম খলিলের বক্তব্যে স্পষ্ট, সিআইএ আবারও বাংলাদেশবিরোধী তৎপরতায় নেমেছে। যার অংশ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের মানবাকিধার নিয়ে সিআইএ’র মদদপুষ্ট ১৩টি তথাকথিত মানবাধিকার সংগঠনের চিঠি, র‌্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি কার্যক্রম। মার্কিন গোয়েন্দাদের দেওয়া অর্থই ডোনেশনের নামে বিভিন্ন দেশের ব্যক্তি ও সংস্থাকে দিচ্ছে এনইডি, যাদের মাধ্যমে তারা ওই দেশগুলোতে সরকারবিরোধী প্রচারণার অপারেশন চালাচ্ছে।

যত হাত ঘুরেই আসুক, উন্নয়ন খাতের নামে সরবরাহ করা এসব ফান্ডের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল অনুমোদন লাগে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা আছে যাদের, তারা এসবের উদ্দেশ্য জানেন। তাসনিম খলিল ও ডেভিড বার্গম্যানরা এসব ফান্ডকে মানবাধিকারের ছদ্মবেশে ঢাকার চেষ্টা করছেন। তবে এটি তার নিতান্তই একটি দুর্বল অপচেষ্টা। প্রকৃতপক্ষে, মার্কিনিদের সাম্রাজ্যবাদ ও বিভিন্ন দেশে দখলদারিত্বের নতুন মুখোশ এখন এসব ফান্ড ও বেসরকারি সংস্থাগুলো।

মার্কিন গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ টি রিচেলসন-এর গ্রন্থ ছাড়াও ডেভিড মারপলস-এর ‘দ্য ময়দান রেভল্যুশন ইন ইউক্রেন’ বইটি থেকেও অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিনিদের কৌশলী হস্তক্ষেপের ব্যাপারে বিস্তারিত জানা যায়। যাকে বলা হয় ‘ইউক্রেন স্টাইল’ অর্থাৎ গুজব ছড়িয়ে অস্থিতিশীলতা তৈরীর কৌশল। ১৯৯০ সালে নিকারাগুয়ায় সরকার পতনের সাফল্যে অনুপ্রাণিত সিআইএ’র গোয়েন্দারা একই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ইউক্রেনের ওপর।

২০১৩-১৪ সালে ইউক্রেনের ইউরো-ময়দান (কিয়েভ ইন্ডিপেন্ডেন্ট স্কয়ার) গণবিপ্লবের ছদ্মবেশে সরকারের পতন ঘটায় তারা। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে জনগণকে বিভিন্ন ইস্যুতে উত্তেজিত করে রাশিয়াসমর্থিত সরকারের বিরোধীপক্ষকে নিয়মিত অর্থায়ন করতো। জনরোষ সৃষ্টির পর এক রাতে হুট করে ফেসবুকে বিপ্লবের ডাক দেওয়া হয়, জমতে থাকে ক্ষুব্ধ জনতা। উত্তেজিত জনগণের আবেগকে ব্যবহার করে ইউক্রেনের ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটায়।

একইভাবে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক উগ্রবাদী গোষ্ঠীর চূড়ান্ত পরাজয়ের পর বাংলাদেশের সরকারকেও বদলানোর ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। ২০১৩’র ৫ই মে শাপলা চত্বরের ঘটনার নেপথ্যেও এমন ষড়যন্ত্রের আভাস মেলে। এজন্য এনইডি ইউক্রেনের ইউরো-ময়দান স্টাইলে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই অনুসারে ফেসবুকে গুজব ছড়িয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা চলে।

নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করেও চেষ্টা করা হয় ক্যু ঘটানোর। বিশেষ করে ধর্মীয় উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড দিয়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অনুভূতিকে ট্রিগার করে সরকারবিরোধি কর্মকাণ্ডে উদ্দীপ্ত করার প্রচেষ্টা চালানো হয় প্রায়ই।

মূলতঃ মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত এনইডি বাংলাদেশের সরকার বদলানোর গ্রাউন্ড তৈরিতে ‘এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশান’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানেও অর্থায়ন করেছে। এ কারণে গত নির্বাচনের সময় বিদেশি পর্যবেক্ষদের বিভিন্নভাবে সরকারের ব্যাপারে নেতিবাচক বার্তা দিয়েছে তারা। ক্যু ঘটানোর পটভূমি তৈরির অংশ হিসেবে এনইডি’র ফর্মূলায় কাজ করছে নেত্র নিউজ, প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ দেশের অন্তত ৭-৮টি ছাপা সংবাদপত্র, এক ডজনেরও বেশি অনলাইন পোর্টাল, কয়েকটি টিভি চ্যানেলসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাচ্ছেন সাংবাদিকরা।

ফুলে-ফেঁপে ওঠা সাংবাদিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব দাখিলের প্রস্তাব উঠলে গত বছর ক্ষেপে ওঠে সাংবাদিকদের কয়েকটি সংগঠন। প্রথম আলো পত্রিকার বিতর্কিত সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম ও তার স্বামীর নামে কোটি কোটি টাকার সম্পদের হদিসও মিলেছিল গত বছর। এমনকি রোজিনার এক সহকর্মীর ফাঁসকৃত ফোনালাপেও সেই তথ্যের সত্যতা মেলে।

এভাবে রোজিনা যখন দেশব্যাপী বিতর্কিত একটি নাম হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছিলেন, তাকে বাঁচাতে বিদেশি সংস্থা কর্তৃক ধরিয়ে দেওয়া হলো সাংবাদিকতার জন্য পুরস্কার! ভাড়াটে পত্র-পত্রিকায় রোজিনা বন্দনায় ঢেকে গেল তাকে নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কিত ইস্যুগুলো। রোজিনা একা নয়, দেশের শতাধিক সাংবাদিক রয়েছেন এনইডি’র পে-রোলে। নিষ্ঠার সাথে প্রোপাগান্ডা এবং মিথ্যাচারের কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন তারা সাংবাদিকতার নামে।

পরিশেষে বলতে হয়, বিদেশি-দেশি শত্রুদের হাত থেকে বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা তথা আধুনিক বাংলাদেশের রূপকার শেখ হাসিনাকে রক্ষায় মুজিববাদের কোনো বিকল্প নাই।

মুজিববাদে বিশ্বাসী প্রকৃত আওয়ামী লীগার এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের প্রতিটি মুহূর্তে তৎপর থাকতে হবে, যেন শত্রুপক্ষ আবারও ১৯৭১-এর মত একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, ১৯৭৫-এর মত ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে না পারে। কারণ, শেখ হাসিনা যদি থেমে যান, বাংলাদেশেরও ইতি ঘটবে- এটা আজ দেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক মানুষ জানেন এবং বিশ্বাস করেন।

শেয়ার করুন !
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  
  •  

এই ওয়েবসাইটের যাবতীয় লেখার বিষয়বস্তু, মতামত কিংবা মন্তব্য– লেখকের একান্তই নিজস্ব। somoyekhon.net-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে এর মিল আছে, এমন সিদ্ধান্তে আসার কোনো যৌক্তিকতাই নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে somoyekhon.net আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো প্রকার দায় বহন করে না।

Leave A Reply

error: Content is protected !!