মুক্তমঞ্চ ডেস্ক:
চণ্ডীর বর্ণনা অনুযায়ী, দূর্গম নামক অসুরকে বধ করায় দেবী মায়ের নাম হয়েছে দুর্গা। দূর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দূর্গতিতে ফেলা। দূর্গমকে বধ করে যিনি স্বর্গ বিতাড়িত দেবগণকে হৃতরাজ্যে ফিরিয়ে দেন এবং জীবজগতকে দূর্গতির হাত থেকে জীবন রক্ষা করেন তিনিই মা দুর্গা। শ্রী দেবী দুর্গা, গণদেবতা এভাবে অশুভশক্তি নিধন করে শুভশক্তি তথা ধর্মশক্তির জয় করলেন।
ত্রিনয়নী মহাদেবী দুর্গাপূজার সর্বোত্তম পূজাতত্ত্বে বিভাসিতা। তিনি দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনে আবির্ভূতা এ পূজার মূর্তি কল্পনায় ফুটে উঠেছে শৌর্যবীর্য (কার্তিক), জ্ঞানভক্তি (সরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ), সম্পদ (লক্ষী) এবং মানবজীবনের ইহকালের বস্তুলাভ এবং অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়। আর মায়ের পদতলে মহিষাসুর অশুভ এবং অহঙ্কারের প্রতীক, যা জগতের অমঙ্গলের হেতু। তাকে আবার শাসন করছেন স্বয়ং দেবী, যিনি কল্যাণময়ী বরাভয়দায়িনী হিসেবে জগতের কল্যাণ করে আসছেন।
মা দেবী দুর্গার আশীর্বাদে শ্রীরামচন্দ্র রাক্ষসরাজ রাবণকে পরাজিত করার পর সীতাকে উদ্ধার করলেন সেই থেকে শরতকালে হয়ে আসছে দুর্গাপূজা। পূজার ষষ্ঠীতে দেবীর ষষ্ঠাদিকল্প অর্থাৎ আবাহন, বোধন, আমন্ত্রণ, অধিবাস প্রভৃতি অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। এই ষষ্ঠীতে সন্ধ্যাকালে দেবীর বোধন হয়। পুরাণ শাস্ত্র মতে, দেবীর বোধন হয় বিল্ববৃক্ষে বা বিল্বশাখায়। অন্যদিকে সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত প্রতিমায় দেবীর অর্চনা করা হয়ে থাকে সপ্তমীতে অন্যতম অনুষ্ঠান নবপত্রিকা প্রবেশ কদলীবৃক্ষসহ আটটি উদ্ভিদ এবং জোড়াবেল একসঙ্গে বেঁধে শাড়ি পরিয়ে বধূর আকৃতির মতো তৈরি করে দেবীর পাশে স্থাপন করা হয়, প্রচলিত ভাষায় একে কলাবউ বলে।
পূজার অষ্টমীতে বিশেষ অনুষ্ঠান অষ্টমী ও নবমী তিথির সন্ধিতে দেবীর বিশেষ পূজা ‘সন্ধিপূজা’। অষ্টমী তিথিতে কোনো কুমারী বালিকাকে পূজা করা হয়। নবমীকে হোমযজ্ঞের দ্বারা পূজার পূর্ণহুতি দেয়ার রীতি। দুর্গাপূজায় দশমী তিথিতে হয় দেবীর বিসর্জন। পূজায় দশমী তিথি বিজয়া দশমী নামে খ্যাত। হিন্দুদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে এই দিনে শ্রীরামচন্দ্র কর্তৃক রাবণ নিহত হয়েছিলেন। একই কারণে স্বর্গ-মর্ত্যওে দূর্দিনে দূর্গতিনাশিনী দুর্গার আবির্ভাবও হয়েছিল। সকল দেবতার সম্মিলিত তেজ সৃষ্টি করেছিল মহামায়াকে। আবার সেই শক্তি বলীয়ান হয়েই দেবী চণ্ডী অশুভকে বিনাশ করে স্বর্গ-মর্ত্যরে মতো আর শান্তি প্রতিষ্ঠা করে ধর্মের অন্তর্নিহিত অর্থকেই আবার ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল।
দুর্গাপূজাতে আমাদের বাসায় সব সম্প্রদায়ের লোকই আসত কারণ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মঙ্গল কামনায় দেবী দুর্গা এই ধরণীতে আসেন। তাই সবাইকে সঙ্গে নিয়েই আমরা দুর্গাপূজা করি। আমাদের আনন্দ আমরা সবার সঙ্গেই ভাগ করে নেই। সবার সঙ্গে পূজা করতে আনন্দ করতে আর পূজার প্রসাদ সবাই একসঙ্গে খেতে কি যে আনন্দ, তা বলে বুঝানো যাবে না। পূজাতে প্রসাদ সবাইকে নিয়ে খাওয়া হতো প্রথম দেয়া হতো ফলমূল তাতে আপেল, কলা, আঙ্গুর, পেঁপে আর কত কি। দুপুরে দেয়া হতো ভোগ, তাতে খিচুড়ি সঙ্গে লাবড়া অর্থাৎ নানান রকম শাক-সবজি দিয়ে তৈরি নিরামিষ। সবাই প্রসাদ খেয়ে বলত আহা কি মজা, এমন মজার খাবার কতদিন খাইনি। আমরা তাদের এই আনন্দ আর তৃপ্তি দেখে নিজেরাই আনন্দিত হতাম। সন্ধ্যায় হতো আরতি, সেই আরতির সময় ধূপ ধোঁয়ায় চারদিক হয়ে যেত গন্ধময় একটি ধোঁয়াচ পরিবেশ আর ঢাকঢোল কাঁসার শব্দ ধ্বনিতে আমরা সবাই নাচতাম। প্রতিমার সামনে হাতে ধূপের পাতিল নিয়ে আমিও নাচতাম।
দুর্গাপূজায় সব ধরনের লোকের আগমন হয়। এক কথায় বলা যায় সব স্তরের জনগণের মিলিত প্রয়াসই দুর্গাপূজা। সবার মিলনই দুর্গাপূজার আসল রূপ। তাই তো দুর্গাপূজা সার্বজনীন মহামিলনোৎসব। বিশ্বমৈত্রী স্থাপনের নিমিত্তেই দুর্গাপূজা মানুষের মহামিলন তীর্থ। প্রতি বছর মা আসেন, ভক্তের পূজা নিয়ে আবার ফিরেও যান কৈলাশে। শরতের কাশবনে যখন ফুলের শুভ্রতা, সনাতনী বাঙালিরা তখন প্রস্তুতি নেয় মা দুর্গাকে মর্ত্যে বরণ করার জন্য। মায়ের আগমনে সন্তানের আনন্দ। যে কোনো সংকটে একজন আরেকজনের পাশে দাঁড়াতে পারলেই শুধু সম্মিলিত শক্তিতে অসুর শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব।
শরৎকালের দুর্গাপূজায় ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচু সবাই মিলিত হয় পরমানন্দে। মায়ের কাছে সন্তানের অধিকার সমান। কারণ তিনি বিশ্বজননী। সনাতন ধর্মশাস্ত্রে দুর্গা নামটির ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে ‘দ’ অক্ষর দৈত্যনাশক, ঊ-কার বিঘ্ননাশক, রেফ রোগনাশক, গ অক্ষর পাপনাশক ও অকার ভয় শত্রুনাশক। তার মানেই দৈত্য, বিঘ্ন, রোগ, পাপ ও ভয়-শত্রুর হাত থেকে যিনি রক্ষা করেন, তিনিই শ্রী দুর্গা। অন্যদিকে শ্রী শ্রী চণ্ডী অনুসারে এই দেবীই ‘নিঃশেষদেবগণশক্তিসমূহমূর্ত্যা’ বা সকল দেবতার সম্মিলিত শক্তির প্রতিমূর্তি। তিনি আমাদের দূর্গতি থেকে ত্রাণ করেন বলেই দেবীর নাম হয়েছে দুর্গা।
দেবী মা দুর্গা ব্রহ্মশক্তি স্বরূপিনী, তিনি বিভাসিতা মাতৃশক্তি, তিনি জগজ্জননীরূপে সর্বভূতে বিরাজমান। তিনি সকল প্রাণীতে চেতনারূপে, বুদ্ধিরূপে, শক্তিরূপে, শান্তি রূপে, শ্রদ্ধারূপে, দয়ারূপে ইত্যাদি নানা রূপে বিরাজিতা সকল প্রকার অকল্যাণের হাত থেকে তিনি আমাদের অর্থাৎ তার সন্তানদের রক্ষা করে থাকেন। শাস্ত্র মতে দেবতা ও অসুরদের সংগ্রামে শরণাগত শুভবুদ্ধি ও কল্যাণকামী দেবতাদের তিনি সব সময় বরাভয় দান করেছেন। প্রাচীনকালে রাজা, জমিদার আর ধনাঢ্য বণিক সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই এ পূজার প্রচলন বেশি লক্ষণীয়। বহুকাল থেকে আর্থিকভাবে সচ্ছল ও ধনী ব্যক্তিরাই পারিবারিকভাবে বংশপরম্পরায় দুর্গাপূজা করে আসছেন।
আমাদের দেবগণ নিজ নিজ দেহ নিঃসৃত তেজ দ্বারা যেমন দেবীর অঙ্গ সকল সৃষ্টি করে তাকে পূর্ণরূপ দিয়েছিলেন, সেভাবেই তারা নিজ নিজ শ্রেষ্ঠ অস্ত্রও তাঁর হাতে তুলে দিয়ে তাকে করেছিলেন রণসাজে সজ্জিতা। অশুভ শক্তির প্রতীক পরাজিত অসুরকে পায়ের তলায় রেখে যুদ্ধ করে মা শিক্ষা দিলেন জীবজগতকে। সংসার সমরাঙ্গনে বাঁচতে মানুষের লাগে বুদ্ধি, ঋদ্ধি, সিদ্ধি ও ক্ষাত্রশক্তি। তাই তো আদ্যশক্তির মহামায়ায় আছেন লক্ষী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিক।
এই জীবনে ধনের দেবী লক্ষী, বিদ্যার দেবী সরস্বতী, দেবসেনাপতি কার্তিক গণদেবতা ও সিদ্ধিদাতা গণেশও হচ্ছেন পূজিত। অন্যদিকে সরস্বতীর বাহন রাজহংস, লক্ষীদেবীর বাহন পেঁচা, গণেশ ঠাকুরের ইঁদুর ও কার্তিকের বাহন ময়ূর- প্রত্যেকটি প্রতীক তত্ত্বই আধ্যাত্মিক তত্ত্বে ভাবমণ্ডিত। দশমীর দিন রাবণ বধ করে সাড়ম্বরে বিজয়া দশমী পালন করেন। তখন থেকে বসন্তকালে ও শরৎকালে দুর্গাপূজা ও শুভ বিজয়া দশমী পালিত হয়ে আসছে। বহুকালের প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই চলে আসছে মাতৃপূজার চিরন্তন ধারা এবং এটি যে কত প্রাচীন তা আজও রহস্যাবৃত। সুদূর অতীতের কোনো ধূসর প্রদোষে মাতৃরূপিনী, শক্তিরূপিনী, বরাভয়প্রদায়িনী, দূর্গতিনাশিনী দুর্গাপূজার হয়েছিল প্রথম প্রচলন তা আজও জানা যায়নি।
কুমারী পূজা
কুমারী পূজা মাতৃভাবে ঈশ্বরেরই আরাধনা। কুমারী কন্যাকে জীবন্ত প্রতিমা করে তাতে জগজ্জননীর উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। দুর্গাপূজার অষ্টমী বা নবমীতে সাধারণত ৫ থেকে ৭ বছরের একটি কুমারীকে প্রতিমার পাশে বসিয়ে দেবীজ্ঞানে পূজা করা হয়। দুর্গাজ্ঞানে পূজা করে সকলের মধ্যে মাতৃভাবেরই সঞ্চার করা হয়। প্রায় সর্বজাতীয়া কন্যাকেই কুমারীরূপে পূজা করা যেতে পারে। তবে স্বত্বগুণ সম্পন্না-শান্ত, পবিত্র, সত্যশীলা এসব দৈবী সম্পদের অধিকারিণী কুমারীই জগজ্জননীর প্রতিমারূপে গ্রহণের বিধি আছে।
অনন্ত ভাবময় ঈশ্বরের অন্তহীন ভাবনাকে কোনো কিছু দ্বারা সীমাবদ্ধ করা যায় না। তিনি এই হতে পারেন আর এই হতে পারেন না এ রকম বলা যায় না। তার ইচ্ছায় এ জগৎ প্রসবিত। এই সমগ্র জগত তাহারই প্রকাশ। এই আকাশ-বাতাস, গাছপালা, জীবজন্তু সবের ভেতর তিনি অনুসৃত হয়ে আছেন। মা যেমন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন, প্রকৃতি-রূপ পৃথিবী তথা সমগ্র বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড তেমনি মাতৃকা শক্তিরূপে তাঁর উদরে ধৃত আছেন। এই বিশ্ব প্রকৃতির উপাসনা প্রকৃতপক্ষে সেই মাতৃরূপেরই উপাসনা। মাতৃভাবে তথা কুমারীভাবে আরাধনা ঈশ্বরের বৈচিত্র্যময় আরাধনার একটি রূপ অর্থাৎ সেই মাতৃভাবেরই আরাধনা। সনাতন হিন্দু ধর্মে এই আরাধনার পদ্ধতি দুটি। একটি সাকার ও একটি নিরাকার, এই সাকার পদ্ধতি হলো প্রতীক পূজা এবং নিরাকার পদ্ধতি হলো জ্ঞান বা বিদ্যাচর্চা অর্থাৎ আত্মোপলব্ধি বা আত্মতত্ত্বকে জানা।
যে চিন্তা সৎ বস্তুতে নিয়ে যায় তাই প্রতীক। এই কুমারী বা প্রতীমা মাতৃশক্তির প্রতীক, তাই তাকে পূজা অর্থাৎ সদ্বস্তুর পূজা; এক অর্থে এটি সেই বিরাটেরই পূজা। উপনিষদের ভাষায় কবি বলেছেন-
‘পুতুল পূজা করে না হিন্দু কাঠ মাটি দিয়ে গড়া
মৃন্ময়ীর মাঝে চিন্ময়ী হেরী হয়ে যায় আত্মহারা।’
অর্থাৎ কাঠ, মাটি দিয়ে গড়া পুতুল শুধু মৃন্ময়ী রূপ নয়, তা মায়ের চিন্ময়ী জীবন্ত রূপ। তাই তাঁকে শ্রদ্ধা বা পূজা করা। শ্রীরামকৃষ্ণদেব সেই তত্ত্বকেই বলছেন প্রতীমা মাটি কেন গো? ও তো চিন্ময়ী জীবন্ত রূপ। সেই প্রতীক রূপেরই জীবন্ত রূপ কুমারী, যা বিশ্বমাতৃত্বের প্রতীক জগন্মাতাকে শ্রীরামকৃষ্ণদেব মা বলে সম্বোধন করছেন। এই মাতৃশক্তিকে উপাসনা করা হয় দুর্গাপূজায় কুমারী পূজার মাধ্যমে। মাতৃভাবে ঈশ্বরের আরাধনা তাঁর বৈচিত্র্যময়ী আরাধনার একটি রূপ। প্রত্যেক নারীকে মাতৃভাবে ভাবনা মহামায়ার শ্রেষ্ঠ উপাসনা এবং নারী মর্যাদার সর্বোচ্চ বিধি। নারী শুধু ভোগ্যপণ্য নয়, যথার্থ মূল্যায়নে সমাজে তাকে উচ্চাসনে সমাসীন করা।
পাখি যেমন একটি ডানায় উড়তে পারে না, সমাজও তেমনি পুরুষ শক্তি দ্বারা চলতে পারে না। কুমারী পূজা নারীকে মূল্যায়নের একটি সর্বোচ্চ শাস্ত্রীয় বিধি। সমগ্র বিশ্বে এই নারীমূর্তি মহামায়া রূপে প্রকাশিতা এবং এরই মাতৃকাশক্তি কুমারী রূপে ঈশ্বরেরই আরাধনা। শ্রীরামকৃষ্ণ এই শক্তিকে মা বলতেন আর অন্য সকলে এই শক্তিকে ঈশ্বর আল্লাহ বা গড বলে থাকেন। নিরাকার জল যেমন ঠাণ্ডায় বরফ আকার ধারণ করে। নিরাকার ঈশ্বরও তেমনি ভক্তের কাছে ভক্তিতে স্বগুণ সাকার রূপ ধারণ করে। কুমারী পূজা এই উপাসনাই বটে।
শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন, কুমারী পূজা করে কেন? সব স্ত্রীলোকই ভগবতীর এক একটি রূপ। শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর বেশি প্রকাশ। তাই দুর্গাপূজায় এই কুমারী পূজার বিধান। তাঁর শক্তি সর্বভূতে ক্রিয়াশীল। এই শক্তি মাতৃরূপে আবির্ভূতা। তাই তিনি বলেছেন ‘মাতৃভাব সাধনার শেষ কথা’। শক্তিপূজা কেবলমাত্র মাতৃমূর্তিতেই হয়। যেমন: দুর্গা, অন্নপূর্ণা, কালী, জগদ্বাত্রী ইত্যাদি। তাই প্রাচীনকাল থেকে শক্তি পূজার অঙ্গ হিসেবে নারীমূর্তিতে কুমারী পূজা প্রবর্তিত হয়েছে।
বর্তমানকালে সমাজ ব্যবস্থায় বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও অনুন্নয়নশীল বিশ্বে সমাজ ব্যবস্থায় নারী নির্যাতিতা। তাই নারীদেহে ভগবানের পূজা সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। শ্রীরামকৃষ্ণদেব নিজ স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করে মাতৃসম্মানের এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন কুমারী পূজার মাধ্যমে নারী সমাজের তথা মাতৃশক্তি জাগরণের এক অত্যুজ্জ্বল ধারা বর্তমান সমাজে তুলে ধরেছেন।
ত্রিনয়নী মহাদেবী দুর্গাপূজার সর্বোত্তম পূজাতত্ত্বে বিভাসিতা। তিনি দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনে আবির্ভূতা এ পূজার মূর্তি কল্পনায় ফুটে উঠেছে শৌর্যবীর্য (কার্তিক), জ্ঞানভক্তি (সরস্বতী), সিদ্ধি (গণেশ), সম্পদ (লক্ষী) এবং মানবজীবনের ইহকালের বস্তুলাভ এবং অন্তিমকালে মাতৃক্রোড়ে চির আশ্রয়। আর মায়ের পদতলে মহিষাসুর অশুভ এবং অহংকারের প্রতীক, যা জগতের অমঙ্গলের হেতু। তাকে আবার শাসন করছেন স্বয়ং দেবী, যিনি কল্যাণময়ী বরাভয়দায়িনী হিসেবে জগতের কল্যাণ করে আসছেন। দশভুজা মায়ের দশটি হাত দশ দিকের প্রতীক। অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই ঈশ্বর বিরাজমান। মা দাঁড়িয়ে আছেন ত্রিভঙ্গ ভঙ্গীমায়। তা হলো সৃজনী, পালনীত ও সংহারী শক্তির প্রতীক- অর্থাৎ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতীক তাহলে দেখা যাচ্ছে যে যিনি ব্রহ্মারূপে সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপে পালন করেন শিবরূপে তিনিই বিশ্ব প্রসারিণী, মাতৃরূপিনী শ্রী শ্রী দুর্গা।
পরাশক্তির অধিকারী অসুরকে বধ করার জন্য মা দুর্গা দশ হাতে দশ অস্ত্রে সুসজ্জিত তার দশ হাত দশ দিকরক্ষার প্রতীক। তার পায়ের নিচে আছে উদ্ধত সিংহ আর উদ্ধত অসুর। সিংহ রাজসিক ও অসুর তামসিক শক্তির প্রতীক। শরতের স্বর্ণিল আবহে স্বর্গের দেবী দুর্গা মর্ত্যবাসীতে নেমে এসে আমাদের যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা ও অশান্তি দূর করে এ পৃথিবীকে শান্তির আলো হিসেবে গড়ে তোলেন। দীর্ঘ একটি বছর পর দুর্গা দেবীর পদতলে পুষ্পাঞ্জল প্রদানের মাধ্যমে সমস্ত বিশ্বের শান্তি ও চিরমঙ্গল কামনা করতে আমরা মিলিত হই এই দিনগুলোতে।
সংঘাতময় এই বিশ্বে দেবী দুর্গার আগমন হয়ে উঠুক শান্তি, কল্যাণ ও সুখ-সমৃদ্ধিময়। দুর্গাপূজা এসেছে। এসেছে তৃণয়নী মা আমার শারদীয় এই দূর্গোৎসবে। আমরা আজ সবাই আমাদের দুর্গা মা’কে বরণ করব, তার পূজা করে আমাদের মাকে স্মরণ করব আর কামনা করব সকলের মঙ্গল হোক, দূর হোক যত অনাচার সবাই শান্তিতে থাকুক। আমরা সবাই যেন সবার জন্য সুখে-দুঃখে এগিয়ে আসতে পারি, সকলে দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিতে পারি। দুর্গাপূজার আনন্দ যেন সকলের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি।
জগন্মাতা দেবীদুর্গা আজও বাঙালি হিন্দুর সবচেয়ে বড় আশ্রয়। মহাশক্তি দেবী দুর্গার পূজা আজ অবধি তাই বাঙালি হিন্দুর সর্বাপেক্ষা বড় উৎসব। আমাদের মধ্যে হিংসা, হানাহানি সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে আমরা সবাই যেন একে অপরের বন্ধু হতে পারি। তবেই দেবী দূর্গতিনাশিনী আমাদের মাঝে আসবেন, অসুরকে নাশ করবেন, আমরা সবাই শান্তি ফিরে পাব। জয় হোক মানবতার।
লেখক: অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী
পরিচিতি: সিনিয়র কনসালটেন্ট ডিপার্টমেন্ট অব ডেন্টিস্ট্রি, বারডেম হাসপাতাল।